তাপসি পন্নুই এখন ‘মহিলা আয়ুষ্মান খুরানা’!
এমনই এক উক্তি উড়ে এল হঠাৎ বসন্তের এক সন্ধ্যায়। ‘বদলা’র ঋজু অভিনেত্রী এখন থাপ্পড়ের অমৃতার ভূমিকায় আরও পরিশীলিত। মার্চের প্রথম সপ্তাহে যখন ঘটা করে বাৎসরিক মহিলা-মুগ্ধতার হিড়িক ওঠে, ঠিক সে সময়েই তাঁর নাম চারপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। সেই থাপ্পড়ের কারণেই। সে ছবি দেখে বেরোনো এক পিতা-পুত্রের সংলাপে কান পাততেই শোনা গেল আয়ুষ্মান আর তাপসির তুলনা। ছেলে বাবাকে জানালেন, তাপসি এখন দারুণ হিট। তাই তাঁকে আয়ুষ্মানের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। তবে সব সময়েই ইনি ‘ফেমিনিস্ট মার্কা’ রোল করেন। ফলে মাঝেমাঝে এক ঘেয়ে লাগে ছেলের। বয়স্ক পিতা অবশ্য আরও একটু মুগ্ধ। তিনি মনে করেন, এমন ‘রোল’ আরও দরকার। এই সব চরিত্র যত তৈরি হবে তাঁদের মেয়েরা ততই জোর পাবেন! তাই তিনি চান, এ বার একটু মেয়েদের দিক থেকে দেখা হোক দুনিয়াটা।
কেন্দ্রে তবে কী থাকবে? ক্ষমতা, ভদ্রতা না কি অস্বস্তি?
নারীকেন্দ্রিক ছবি তৈরির উৎসাহ যখন তুঙ্গে, বিশেষত এই উপমহাদেশে, তখন এমন প্রশ্ন ওঠে বইকি। কে কাকে কেন কেন্দ্রে আনতে চান? কার দিক থেকে গল্পটা দেখতে চান? সে কাজটা সকলে কি বাধ্য হয়ে করেন? না কি গত এক দশকে আমূল বদলে গিয়েছে সমাজটা? তাই কি সেখানে বার বার মহিলারা উঠে আসেন আলোচনার মাঝে? তা-ও আবার বলিষ্ঠ চরিত্র হিসেবে। কারা দেখেন সে সব ছবি? দেখে কিছু কি ভাবেন? নিজেদের নতুন করে তৈরি করার ইচ্ছে হয় সেই ভাবনার মধ্যে? না কি এই পিতা-পুত্রের জুটির মতোই আসলে সব চিন্তা থেকে যায় হিসেবের গণ্ডির ভিতরে? একটা ‘মর্দানি’ দেখে মনে হয় কি ‘সে তো ঝাঁসি কি রানিও ছিলেন এক সময়ে’, এ নিয়ে আর এত কী? পুত্রের অস্বস্তি হয় নিজের বয়সিদের কথা ভেবে। বাবা যখন সেই সঙ্কটের বয়স পেরিয়ে এখন পরিবারের মাথায়, তখন তাঁর ভালই ধারণা হয়েছে বাদবাকি সমাজটা সম্পর্কে। তাই নিজের মেয়ের জন্য চিন্তা হয়। ফলে সামাজিক ভারসাম্য বজায় রেখে দু’-এক পিস লক্ষ্মীবাঈ মার্কা গল্প বলা হলে যে ‘চাপের’ কিছুই নেই, তা-ও হয়তো তিনি বোঝেন।
এ সব প্রশ্নের উৎস খোঁজার জন্য অবশ্যই ‘থাপ্পড়’ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছবি নয়। একমাত্র ছবি তো নয়-ই। তবে ঘটনাচক্রে এটিই এখন বিভিন্ন হলে এমন সংলাপের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে অনেক মানুষকে। তর্ক আসছে কানে, এমন ছবি আদৌ কি কোনও পথে ঠেলে দিচ্ছে সমাজকে? ছোট ছোট সব জিনিসে মেয়েরা এমন ভাবে লড়লে ঘর বাঁচবে তো, প্রশ্ন উঠছে।
আরও পড়ুন: আমার ভেতরের নারীকে গড়া আজও শেষ হয়নি
সত্যিই তো! ঘর বাঁচবে কী করে? ঘর বাঁচার কথা নয় তো এ ভাবে। তবে প্রশ্নটা ঠিক কোথায়? মেয়েদের পরিস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন উঠলে কী করে বাঁচবে ঘর? না কি এখনও ছোট-বড় এমন থাপ্পড় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হলে, ঘর বাঁচানোর চেষ্টা করা উচিত কি না আদৌ? কী বলবে নারীবাদ? কী বলবে পুরুষতন্ত্র? কী বলবেন থাপ্পড়ের অমৃতার স্বামী, অমৃতার প্রতিবেশী, মা-শাশুড়ি সকলে?
আরও পড়ুন: ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?
বছর নয় আগে, ‘নো ওয়ান কিলড্ জেসিকা’ তৈরি হল। জেসিকা লালের মৃত্যু নিয়ে তার আগে চর্চা কম হয়নি। কিন্তু নিন্দার কেন্দ্রে এল কে? রানি মুখোপাধ্যায়ের চরিত্র। যে কি না জেসিকার সঙ্গে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়ছে। এত গালাগালি দিলেই কি কঠিন হওয়া যায়? ছেলেদের মতো ভাষা প্রয়োগ করলেই কি খুব লায়েক বোঝানো যায় নিজেকে? প্রশ্ন উঠল।
যায় না। সত্যি যায় না। কারণ নেই যাওয়ার। কিন্তু যে প্রশ্নটা উঠল না, তা হল, রানির চরিত্রটা কঠোর দেখাতে অতগুলো গালিগালাজ কেন লিখতে হল চিত্রনাট্যকারকে?
‘থাপ্পড়’ তার থেকে একটু এগিয়েছে। সমাজের একেবারে মূলে গিয়ে এক নারী আত্মাভিমান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। খানিকটাই। তবু তো তুলেছে। স্বামীর হাত থেকে বেরিয়ে আসা একটা থাপ্পড় এখানে সবচেয়ে বড় কথা নয়। থাপ্পড়ের বদলা আর একটা থাপ্পড় নয়। থাপ্পড় অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার উৎস। এমন ভাবনার প্রকাশ এক দিনে ঘটেনি বলিউডে। বলিউড ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে, চারপাশের সমাজের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই।
জেসিকা তৈরি হয়েছিল ২০১১-এ। প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গিয়েছে এর মাঝে। তবু ‘থাপ্পড়’ ঘিরে কটাক্ষ আসে ‘ফেমিনিস্ট মার্কা’ বলে। ঠিকই, এ ছবি নারীত্বকে সম্মান করার কথা তো বলছেই। তবে ‘ফেমিনিস্ট মার্কা’-র মানে নিয়েও প্রশ্ন তুলছে। সেখানেই এই ছবি এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে সমাজকে। নারীবাদ নিয়ে ধারণা কী ভাবে সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর হয়েছে, তা দেখা যায় তাপসির এই নতুন ছবির পোস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে একটু পিছনে তাকালে।
মেয়েরা কেন্দ্রে থাকলেই কি সে ছবি ফেমিনিস্ট? ‘কহানি’ তবে কী? ‘কহানি’-র বিদ্যা বালন, ‘নির্জা’-র সোনম কপূর, ‘হাইওয়ে’র আলিয়া ভট্ট কি ফেমিনিস্ট চরিত্র? ফেমিনিজম বা নারীবাদ শুধু নারীর কথা বলে না কিন্তু আর। একবিংশ শতাব্দীর নারীবাদ সমাজের নানা স্তরের মানুষ ও তাঁদের নিজ-নিজ জীবনবোধকে সমান সম্মান এবং অধিকার দেওয়ার আবেদন জানায়। তা কি সকলে বোঝেন বা মানেন? না মানারই কথা। অধিকাংশের কাছে মহিলাদের কথা বলা মাত্রেই ফেমিনিস্ট মার্কা। কিন্তু যদি ‘কিউ কি সাস ভি কভি বহু থি’র পরিবারের সকল বৌয়ের সাজ নিয়ে আড্ডা দেওয়া হয়, সেটাও কি নারীবাদী আলোচনা বলবেন? কারণ, মহিলাদের বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে? কিন্তু কার চোখ থেকে হচ্ছে? তা ভাববে কে?
মেয়েরা আলোচনার মাঝে থাকবেন, এটা স্বাভাবিক ছিল না দেড় দশক আগেও। ফলে সিনেমার দর্শকেরাও তেমনটাই দেখে অভ্যস্ত ছিলেন। নায়িকা থাকতেন নায়কের পার্শ্বচরিত্র হিসেবে। তাঁর প্রেমে পড়ে এক জন পুরুষ প্রকৃত নায়ক হয়ে উঠতেন। তাঁর ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নিতেন ছবির শেষে।
এখনকার ছেলেরা ভাতকাপড়ের দায়িত্ব নেন না এমন নয়। তবে মেয়েরাও নিয়ে থাকেন। আগেও নিতেন।
বাড়ির লোকের মর্যাদা রক্ষার জন্য মেয়েকে সব সময়ে বলতে হয় না যে তার উপার্জনের আসলে কোনও প্রয়োজন নেই পরিবারে। তাই বলে প্রিন্স চার্মিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয় না, বিয়ের রাতে লজ্জা পেতে হয় না, এমনটাও নয়। পরতে পরতে যেমন উপরে হওয়া না হওয়ার কথাগুলো বলা গেল, তেমন ভাবেই পেঁয়াজের খোসা এক এক দফায় ছাড়িয়ে একটু একটু করে ভোল বদলাচ্ছে সমাজ-সংস্কৃতি-পরিবেশ। শিল্প তার অঙ্গ হিসেবে আরও কিছু কথা বলছে। কখনও নতুন, কখনও পুরনোকে নতুন করে। তারই ফলে কিছু মহিলা চরিত্র হঠাৎ নায়ক হয়ে বেরিয়ে আসছে। আরও কারও কারও গল্প বলার দরকার হচ্ছে। একে একে তৈরি হয়েছে কখনও ‘ডোর’, ‘পার্চড’, কখনও ‘চামেলি’- ‘চাঁদনিবার’।
মূল ধারার ভাবনাচিন্তায় মেয়েরা খানিক ঢুকেছে আর কি এ ভাবে। ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র নার্গিসকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এক সময়ে সঙ্কটের মুখে দাঁড়িয়েছিল ‘আর্থ’-এর শাবানা।
এখন সে সব জট ছাড়ানোর সময়। কিছু অহেতুক ‘ব্যাগেজ’ ফেলে দেওয়ার দিন। তাই অর্থ কিংবা ‘ইজাজত’-এর জটিলতা আর প্রয়োজন পড়ে না। মহিলারা এত দিনে ন্যারেটিভের মূল স্রোতে ঢুকেছেন।
এই ঢুকে পড়াটাই বড় ব্যাপার। এর একটা আর্থ-সামাজিক দিক থাকে। কে-কতটা নিজের দায়িত্ব নিলেন কড়ি গুণে তার হিসেব হয়। সে হিসেবের দিক থেকে মেয়েরা যত বার এগিয়েছে একটু একটু করে, ততটাই উদার হচ্ছে গল্প বলার ফ্রেমওয়ার্ক। কাউকে কেন্দ্রে থাকতেই হবে, এই ভাবনাটাও একটু নড়ে গিয়েছে যেন। সকলে মিলে একে-অপরের কথা বলার জায়গা তৈরি হচ্ছে। ড্রিম গার্লের মতো ছবি করছেন আয়ুষ্মান। সেখানে কেন্দ্রে নারী আছে, তবে নারী চরিত্র নেই। সমাজের সঙ্কীর্ণতা বার করে আনতে পুরুষ চরিত্র অন্য পুরুষদের কথা বলছেন। যেমন, কিছু কাল আগে এক মহিলা আর এক মহিলার গল্প বলতেন শুধু। সমাজের নারীদের অবস্থান বোঝাতেন সিনেমার মাধ্যমে। মনে পড়ে সিল্ক স্মিতার চরিত্রে বিদ্যা বালনের চেহারাটা? অথবা ‘ব্যান্ডিট কুইন’-এর সীমা বিশ্বাস? এখন মেয়েদের সমস্যা যেন একটু ‘ইউনিসেক্স’ মোড়ক পাচ্ছে।
মানুষের গল্প শোনা, সমাজের নানা স্তরের গল্প বলা শুরু হয়ে গিয়েছে বেশ অনেক দিন ধরেই। বলিউড দেখে নিয়েছে, হিরো এখন একমাত্রিক হয় না। বরং নানা স্তর থেকে উঠে আসে। আর সেই লিঙ্গভিত্তিক পরিচয় দিয়ে নায়ক তৈরি করা যায় না। এক শ্রেণির মানুষের গল্প বলতে তাই একটু অন্য ধরনের চরিত্রের প্রয়োজন বার বার হচ্ছে। সেই হাওয়াতেই আয়ুষ্মানের মতো কিছু কাজ নিচ্ছেন তাপসি, আয়ুষ্মান হয়তো নিচ্ছেন বিদ্যার মতো কাজ। সকলে মিলে একটু একটু করে সমাজের এক-একটা পরত, নতুন করে তুলে আনছেন! নারী-পুরুষ এবং বিভাজনের বোধ রোজ ভাঙছে, আবার গড়ছে বলিউড!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy