Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
International Women's Day

মেয়েগুলোকে কী ভাবে বাঁচাব বলতে পারেন!

বাড়ির অবস্থা ফিরলে মেয়েদের অবস্থা ফেরে এমন নিশ্চয়তা নেই। ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হলে বাড়ির মেয়ের বাইরের কাজ বন্ধ হয়। কারণ, বাড়ির সম্মান রক্ষার দায় এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। মেয়েরা কাজে যোগ দিলে তা-ও পরিবারের সম্মানের সঙ্গে মানানসই হওয়া চাই। তাই মেয়েরা চাইলেই যে কোনও কাজে যোগ দিতে পারেন না। আজ পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে, স্বাস্থ্যকর্মীদের আলোচনায় উঠে আসে —আশাকর্মী হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রসব করানোর ব্যবস্থা করায় কোনও বধূ হয়েছেন পরিত্যক্ত।

পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে চাষের কাজেও হাত লাগিয়েছেন মহিলারা। নিজস্ব চিত্র

পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে চাষের কাজেও হাত লাগিয়েছেন মহিলারা। নিজস্ব চিত্র

গোপা সামন্ত
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২০ ০০:৪৪
Share: Save:

পঞ্চাশ বছর আগে গ্রামের বাড়ির মড়াইতলায় যখন জন্মেছিলাম, ধাই-মা আমাকে তুলতে চাননি। কারণ, আমি কন্যা সন্তান। দাদু ছিলেন তুলনামুলক উদার। ধাই-মাকে বলেছিলেন ‘নাতনিকে আমি মানুষ করব, তোমার কী? ওকে তোলো’। মায়ের কাছে শুনেছি সে কথা।

আজ পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে, স্বাস্থ্যকর্মীদের আলোচনায় উঠে আসে —আশাকর্মী হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে প্রসব করানোর ব্যবস্থা করায় কোনও বধূ হয়েছেন পরিত্যক্ত। কেউ আবার কন্যাসন্তানের জন্ম দেওয়ায় হাসপাতাল থেকে শ্বশুরবাড়িতে আর ফিরে আসতে পারেননি, তাঁকে বাকি জীবন কাটাতে হবে বাপের বাড়িতে। কন্যাভ্রূণ হত্যার খবর সকলেই জানি। কিন্তু গলা টিপে কন্যাসন্তানকে খুন করাটাও না কি অব্যাহত আছে কোথাও কোথাও। শুনতে শুনতে কেবলই মনে হয়, দেশ তো এগোচ্ছে কিন্তু এখনও মেয়েদের অবস্থা তেমন বদলাচ্ছে না কেন?

অবশ্য দেশের সঙ্গে মেয়েদের অবস্থা ভারতে কোনও দিনই তেমন বদলায়নি। তা যদি হত, তা হলে স্বাধীনতার পঁচিশ বছর পরে ‘towards equality’ রিপোর্ট তৈরির দরকার হত না। বাড়ির অবস্থা ফিরলে মেয়েদের অবস্থা ফেরে এমন নিশ্চয়তা নেই। ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হলে বাড়ির মেয়ের বাইরের কাজ বন্ধ হয়। কারণ, বাড়ির সম্মান রক্ষার দায় এসে পড়ে তাঁর ঘাড়ে। মেয়েরা কাজে যোগ দিলে তা-ও পরিবারের সম্মানের সঙ্গে মানানসই হওয়া চাই। তাই মেয়েরা চাইলেই যে কোনও কাজে যোগ দিতে পারেন না।

আরও পড়ুন:

ওরা তোমার লোক? অ মা, আমরা কার লোক তবে?

নারী-পুরুষ এবং বিভাজনের বোধ রোজ ভাঙছে-গড়ছে বলিউড

আসলে ভারতবর্ষ দেশটার মধ্যে অনেক ভারতবর্ষ আছে। যে ভারতবর্ষের খবর আমরা নাগরিক মধ্যবিত্ত তেমন রাখি না। আর সে অনালোকিত ভারতবর্ষের মেয়েদের অবস্থার কথা জানতে গেলে আমদের দরকার হয় ‘প্রতীচী’র আলোচনাচক্রের, যেখানে আসেন পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। তাঁদের কথা শুনতে শুনতে আমরা আঁচ পাই ভারতবর্ষের মেয়েদের চালচিত্রের। ঝাঁ চকচকে ভারতের স্বনির্ভর মেয়েদের আলোর পিছনের ছায়াতে পড়ে থাকা মেয়েদের কথা। এ বারের অনুষ্ঠান ছিল নবনীতা দেব সেন স্মরণে। তাই আরও বেশি করে চলে আসে মেয়েদের কথা। এখানে সবাই সেই সমস্যাগুলো তুলে আনেন যা তাঁরা নিত্যদিন দেখেন। মেয়েদের নিয়ে কথা বলার তেমন পরিসরই বা কোথায়—পরিবারে, সমাজে বা রাষ্ট্রের কাছে? নারীদিবস ছাড়া? অনেকে প্রশ্নই রাখেন বেশি। প্রতিটি প্রশ্নের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থাকে অনেক তথ্য।

মুর্শিদাবাদ জেলার জিনত দিদিমণির প্রশ্ন থামতেই চায় না। এত মেয়ে স্কুলে যায়, কিন্তু তারা যায় কোথায়? স্কুলে কম্পিউটার শেখানো হয়, মেয়েদের ‘মার্শাল আর্ট’ শেখানো হয় না কেন, তা হলে কয়েকটা মেয়ে হয়তো বা ধর্ষণ কিংবা মৃত্যুর হাত থেকে নিজেদের বাঁচাতে পারত? স্কুলে বই, ব্যাগ, জুতো বিনামূল্যে পাওয়া যায়, স্যানিটারি ন্যাপকিন বিনামূল্যে পাওয়া যায় না কেন? ঠিক কী করলে ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের টাকা আর ‘সবুজসাথী’র সাইকেল মেয়েরা দখল করতে পারবে? লেখাপড়া করেও মেয়েরা কি বিড়িই বাঁধবে? তা হলে লেখাপড়ার দরকার কি? মেয়েদের গয়না, এটিএম কার্ড সব শ্বশুরবাড়ির লোকে নিয়ে নিলে, মেয়েরা কোথায় নালিশ জানাবে? মেয়েগুলোকে কী ভাবে বাঁচাব বলতে পারেন?

এমন প্রশ্নের সামনাসামনি হওয়া বেশ অস্বস্তির। সাজানো ভারতবর্ষের চকচকে বেলুনে ফুটো করতে থাকে প্রতিটি প্রশ্ন। শুনতে শুনতে মনে হয়, দিদিমণি যত সহজে প্রশ্নগুলো তুলে আনতে পারেন, উত্তরগুলো কিন্তু অত সহজে পাওয়ার নয়। সেখানে জড়িয়ে আছে তিনটি প্রধান প্রতিষ্ঠান—পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। সকলে মিলেই যেন চেষ্টা করে মেয়েদের যাতে বেশি বাড় না বাড়ে।

আর এক দিদিমণি কাঁদতে কাঁদতে বর্ণনা দিতে থাকেন তাঁর এক প্রিয় বুদ্ধিমতী ছাত্রীর বাড় কী ভাবে কমিয়েছিল পাড়ার রোমিও। ছেলেটির প্রেমের প্রস্তাবে মেয়েটি সাড়া দিচ্ছিল না। কারণ, সে তখন স্বপ্নে বিভোর যে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে।

এক দিন ফাঁকা দেখে সুযোগ বুঝে রোমিও এল ঘরে। ধর্ষিত বা খুন— হয়নি মেয়েটি। তার প্রত্যাখ্যাত প্রেমিক বানিয়ে এনেছিল একটি চশমা। কাঠের ফ্রেম আর তাতে পেরেক পোঁতা। অভিযোগ, মেয়েটিকে জোর করে সেই চশমাটি পরিয়ে দেওয়া হয় চোখে পেরেক ঠুকে। জন্মের মতো অন্ধ হয়ে যায় মেয়েটি। পড়াশোনা করে বাড়তে চেয়েছিল, তার ‘শাস্তি’। যাঁরা ভাবি, মেয়েদের উপরে অত্যাচার মানে হল মারধর, ধর্ষণ, খুন, অ্যাসিডে পোড়ানো—তাঁদের এই মানুষগুলি বুঝিয়ে দেন, তোমরা ভারতবর্ষের মেয়েদের খবরই রাখ না।

সরকার চায়, রিপোর্ট-কার্ডে থাকবে সব ভাল-ভাল তথ্য। থাকবে না মেয়েদের কষ্টের বা অত্যাচারের কথা। ‘হিমোগ্লোবিন কিট’ না থাকার জন্য যদি ঠিক সময়ে রক্ত পরীক্ষা না হওয়ার ফলে প্রসূতির মৃত্যু হয় রাষ্ট্র দোষটি চাপিয়ে দিতেই পারে আশা বা এএনএম কর্মীর ঘাড়ে। পড়াশোনায় ভাল মেয়ে হঠাৎ নিখোঁজ হলে প্রধান শিক্ষক বা শিক্ষিকার হাজার চেষ্টাতেও থানা ডায়েরি নিতে চায় না, মেয়েটির ফোন পেয়ে তাকে উদ্ধারের জন্য আবেদন করলেও পুলিশ নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকে—এমন অভিযোগ আকছার ওঠে। সরকার কেন চাইবে রিপোর্ট-কার্ড খারাপ করতে, তা সে যে যেখানেই ক্ষমতায় থাকুন না কেন!

সব সরকারই তাদের মতো করে মেয়েদের জন্য নানা প্রকল্প করে। তবে সমাজ ও পরিবার নামের জগদ্দল পাথর বাঁচিয়ে। আর সেখানেই প্রশ্ন তোলেন আর এক দিদিমণি—‘‘রাষ্ট্র যদি সমাজ ও পরিবার নামের প্রতিষ্ঠানগুলিকে একটুও আঘাত না করে, বরং, তাদের মেয়েদের উপরে অত্যাচার চালিয়ে যেতে সাহায্য করে তা হলে মেয়েরাই বা যাবে কোথায়? তাদের বাঁচাব কী ভাবে?” জবাব জানা নেই। প্রশ্ন আছে। এই একবিংশ শতকে দাঁড়িয়েও আশাপূর্ণা দেবীর সত্যবতীর মতো কি বলতে থাকব— ‘‘মেয়েদের যদি কিছুতেই অধিকার না থাকে তাদের জন্মানোর দরকার কি ছিল?’’

বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

International Women's Day Girl Child
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy