ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
বিশ্বের মোট ৩০ কোটি মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। ভারতীয় উপমহাদেশের বাইরে আফ্রিকার সিয়েরা লিওনে বাংলা ভাষাকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। ২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার সংসদও বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে বিশ্ব জুড়ে দিনে দিনে বাংলা ভাষা লাভ করেছে এক অনন্য মর্যাদা।
এই মর্যাদার প্রশ্নটি প্রথম খুব জোরালো ভাবে দেখা দিয়েছিল ১৯৪৮ সালে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দিল। যদিও তখন সংখ্যাগরিষ্ঠ (৫৬ শতাংশ) হিসেবে বাংলা ভাষাভাষী মানুষই বেশি বাস করতেন সেই ভৌগোলিক অঞ্চলে। পাকিস্তান সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ চূড়ান্ত রূপ নিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। আন্দোলনকারীরা ১৪৪ ধারার অবমাননা করে এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করলেন। এই বিবাদ চরমে উঠলে প্রতিবাদী ছাত্রদের উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হন কয়েকজন ছাত্র। ভাষা-শহিদের রক্তে রঞ্জিত হয়ে উঠল সেখানকার রাজপথ।
এই ভাষা আন্দোলন ছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত একটি অত্যন্ত জোরালো সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ছাত্রহত্যার প্রতিবাদে দেশ জুড়ে বিদ্রোহের আগুন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। আন্দোলন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। অবশেষে আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার নতি স্বীকার করল। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দিল সরকার।
এর অনেক বছর পরে, এই সেদিন, ১৯৯৯ সালে ইউনেসকো বাংলা ভাষা আন্দোলন এবং ভাষার জন্য এই আত্মত্যাগকে সম্মান জানিয়ে ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। যদিও এই দিনটি সারা বিশ্বেরই সমস্ত মাতৃভাষাকে সম্মান জানানোর দিন।
সম্মান জানাতে আমরা বাধ্যও। কেননা, বাংলা ভাষার স্থান ভারতে দ্বিতীয়। এটা ফেলনা নয়। এ দেশে সব চেয়ে বেশি মানুষ কথা বলেন হিন্দিতে। তার পরেই স্থান বাংলার। বাঙালি হিসেবে সকলের কাছেই এই পরিসংখ্যান সত্যিই গর্বের। ২০১১ সালের জনগণনার উপর ভিত্তি করে এই সমীক্ষা করা হয়েছিল। সেখানে দেখা গিয়েছে, প্রথম দু’টি স্থানে রয়েছে হিন্দি ও বাংলা। ২০০১ সালের তুলনায় ২০১১ সালে হিন্দিভাষী লোকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে বাংলাভাষীর সংখ্যাও। ইংরেজি আমাদের দেশের সংবিধানের অষ্টম তফসিলের অন্তর্ভুক্ত ভাষা নয়। তবু ভারতের ২ লক্ষ ৬০ হাজার মানুষ এই ভাষাকে তাঁদের মাতৃভাষা বলে মনে করেন। যাঁদের মধ্যে ১ লক্ষ ৬ হাজার জনই বাস করেন মহারাষ্ট্রে। এর পরে রয়েছে তামিলনাড়ু ও কর্ণাটক। মহারাষ্ট্রের পরে এই দু’রাজ্যেই সব চেয়ে বেশি মানুষ ইংরেজিতে কথা বলেন। ইংরেজি ছাড়া সংবিধানের তফসিলের আওতাভুক্ত নয় এমন ভাষা হল রাজস্থানে ভিল্লি বা ভিলোডি।
মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা দ্বিতীয় স্থানে থাকাটা বাঙালিদের কাছে গর্বের। বাংলা ভাষা শুধু বাংলার মাতৃভাষা নয়, এই ভাষা দেশের দ্বিতীয় তথা বিশ্বের চতুর্থ সর্বাধিক প্রচলিত ভাষাও। এই বাংলা ভাষা যেমন বাংলাদেশের প্রধান ভাষা, জাতীয় ভাষা এবং সরকারি ভাষা, তেমনই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরার প্রধান সরকারি ভাষাও। ভারতের সাংবিধানিক ২২টি ভাষার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে রয়েছে বাংলা ভাষা। এমনকী সাগর পেরিয়ে আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের প্রধান ভাষার স্থানও দখল করে রয়েছে বাংলা। ঝাড়খণ্ডের দ্বিতীয় সরকারি ভাষাও বাংলা। পাকিস্তানের করাচি শহরেও বাংলা ভাষা দ্বিতীয় সরকারি ভাষা বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। লন্ডনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা হল বাংলা। আরও গর্বের বিষয় হল, এই ভাষাতেই ভারত ও বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত রচিত হয়েছে। এবং শ্রীলঙ্কার জাতীয় সঙ্গীতও এই ভাষা থেকেই অনুপ্রাণিত।
বাংলা ভাষা দেশ ছাড়িয়ে পাড়ি দিয়েছে দেশান্তরে। এই মুহূর্তে বহির্বিশ্বে ৩০টি দেশের ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু রয়েছে বাংলা বিভাগ। সেখানে প্রতি বছর অসংখ্য অবাঙালি পড়ুয়া বাংলাভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষা ও গবেষণার কাজ করছেন। এ ছাড়া চিনা ভাষায় রবীন্দ্র রচনাবলির ৩৩ খণ্ডের অনুবাদ এবং লালনের গান ও দর্শন ইংরেজি ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস ও সংস্কৃতি নিয়ে বহির্বিশ্বে ভারত ও বাংলাদেশের পরে ব্রিটেন ও আমেরিকায় সব চেয়ে বেশি চর্চা হয়ে থাকে। এর বাইরে চিন, জাপান, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জার্মানি, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া-সহ বিভিন্ন দেশে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে। আমেরিকায় কমপক্ষে ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও এশীয় গবেষণা কেন্দ্রে বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে। এর মধ্যে নিউইর্য়ক, শিকাগো, ফ্লোরিডা, ক্যালিফোর্নিয়া, ভার্জিনিয়া উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বের ছ’টি দেশের রাষ্ট্রীয় বেতারে বাংলা ভাষার আলাদা চ্যানেল রয়েছে। আরও ১০টি দেশের রেডিয়োতে বাংলা ভাষার আলাদা অনুষ্ঠান সম্প্রচার করা হয়। ব্রিটেনে ছ’টি ও আমেরিকায় ১০টি বাংলা ভাষার টেলিভিশন চ্যানেল রয়েছে। ব্রিটেনে ১২টি বাংলা সাপ্তাহিক প্রত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। ‘বেতার বাংলা’ নামে সেখানে একটি বাংলা রেডিয়ো স্টেশনও রয়েছে। ইতালিতে বর্তমানে পাঁচটি বাংলা দৈনিক পত্রিকা এবং রোম ও ভেনিস শহর থেকে তিনটি রেডিয়ো স্টেশন পরিচালিত হচ্ছে। ইতালি থেকে ছ’টি অনলাইন টেলিভিশন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে শতাধিক ফেসবুক টেলিভিশন চালু রয়েছে। এ ছাড়া ডেনমার্ক, সুইডেন-সহ ইউরোপের আটটি দেশ এবং মধ্যপ্রাচ্যের ছ’টি দেশ থেকে বাংলা ভাষার মুদ্রিত ও অনলাইন পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
বাঙালি হিসেবে বাংলা ভাষার এই বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারণ নিঃসন্দেহে মনে খুশির জোয়ার আনে। মোদের গরব মোদের আশা, আ-মরি বাংলা ভাষা! বাংলা ভাষাতেই পাওয়া যায় মনের তৃপ্তি। তবে বাঙালিদের কাছে এই বাংলা ভাষার কদর দিন দিন কমে যাচ্ছে কিনা, তা একবার ভেবে দেখতে হবে। যে ভাবে বাঙালিরা জীবন জীবিকা, যোগাযোগের মাধ্যম বা বিনোদন জগতের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বাংলার সঙ্গে হিন্দি বা ইংরেজির সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন, তাতে বাংলা ভাষার প্রাণ ওষ্ঠাগত। এ সবের ফলে বাংলা ভাষার জাতিসত্তা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি দিনের পর দিন তলানিতে এসে ঠেকছে কিনা সেটা দ্বিতীয়বার ভাবা উচিত। তাই আগামী দিনে বহির্বিশ্বে বাংলা ভাষার সম্প্রসারণ বৃদ্ধি পেলেও বাঙালি হিসেবে আমরা নিজেদের কতটা সমৃদ্ধ করতে পারছি, সেটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy