কোনও গুরু নেই তাঁর, দীক্ষাও নেই। কপালে রসকলি আছে, গলায় কণ্ঠির মালা আছে। মুখে হাসি আর মিষ্টি শব্দ। মৃদুভাষী-মিষ্টভাষী বলা যায় তাঁকে। ঝালমুড়ি, ফুচকা বিক্রি করেন। ফাঁকা সময়ে বাঁধানো খাতায় ভাঙা ডটপেন দিয়ে কবিতা লেখেন। বহুদিন আগে যখন গায়ে জোর ছিল, তখন নৌকা চালাতেন। দিনের বেশির ভাগ সময়টা নৌকা নিয়ে নদীতে থাকতেন বলে হয়তো নাম হয়ে যায় নদিয়া।
জলপাইগুড়ির তিস্তা বাঁধে জুবলি পার্কের আশেপাশে যাঁদের যাতায়াত, তাঁদের নদিয়াদার পরিচয়ের প্রয়োজন নেই। আরোপিত নামের বহু নীচে মা-বাবার দেওয়া নামটা চাপা পড়ে গিয়েছে। এখন গায়ের জোর কমে এসেছে, নদিয়াদা তাই নৌকা চালান না, দৃষ্টিও কমেছে। নদিয়াদা অবশ্য গায়ের জোর বলেন না, বলেন ‘খ্যামতা’। গা নয়, বলেন ‘শরিল’। ‘শরিলে খ্যামতা নাই, চোহেও দেহি না!’ তাঁর মুখ থেকে মিষ্টি স্বরে বেরোনো এই ধরনের শব্দেই এই সেদিনও অনেকে কথা বলতেন। ছোটবেলায় কারও মুখে অমন শব্দ শুনলেই আমরা বলতাম— নদিয়াদার ভাষায় কথা বলছে! এখন আর তেমন শব্দ শুনি না। নদিয়াদার ছেলে বাইকে কাউন্টার রেখে ফুচকা বিক্রি করেন, নৌকাও চালান। কিন্তু তাঁর ‘শরিল’ নয়, শরীর। ‘খ্যামতা’ নয়, জোর। তা হলে কি হারিয়ে যাচ্ছে নদিয়াদার ‘ভাষা’?
সরকারি তথ্য বলছে, জলপাইগুড়ি জেলায় ১৯৬১ সালে ১৫১টি ভাষা ছিল। চা-বাগানের জেলা জলপাইগুড়ি। দূরদূরান্ত, এমনকি বিদেশ থেকেও লোকে চা-বাগানে কাজ করতে এসেছেন, থিতু হয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে থিতু হয়েছে তাঁদের ভাষাও। এক ভাষা গা ঘষাঘষি করেছে আরেক ভাষার সঙ্গে। এক ভাষা বিরোধ করেছে অপর ভাষার সঙ্গে। তাতে শক্তিক্ষয় যেমন হয়েছে, আবার সমৃদ্ধিও এসেছে। সমধর্মী ভাষার জগাখিচুড়িও হয়েছে। ‘এত হাসতেছিস কেন?’ এখানে পূর্ববঙ্গীয় রীতি অনুযায়ী ‘কেন’ না হয়ে হওয়া উচিত ছিল ‘ক্যান’। কিন্তু উত্তরবঙ্গে জগাখিচুড়ি ভাষায় ‘হাসতেছিস’-এর পরে সাবলীল ভাবেই ‘ক্যান’ না বসে ‘কেন’ বসেছে। এও তো ভাষাই বটে। তবে, এখন তেমন আর বেশি শোনা যায় না।
ছোটবেলায় শেখানো হয়, বাড়ি থেকে বার হওয়ার আগে জানিয়ে বার হতে হবে। ঠাকুমাকে যদি বলতাম, ‘আমি যাচ্ছি।’ রে-রে করে উঠতেন! উত্তেজিত হয়ে বলতেন, ‘কত্তবার কইসি, যাওন নাই, আওন!’ এর অর্থ— যাই বলতে নেই, বলতে হবে আসছি। যাওন মানে যাই, আওন মানে আসি। বরাবর মনে হয়েছে, ‘যাই’ শব্দটির চেয়ে ‘যাওন’ অনেক বেশি শ্রুতিমধুর! শব্দ যেন সুরে বেজে ওঠে। বেশ মনে পড়ে, এই ‘যাওন নাই আওন’ শোনার জন্যই ঠাকুমাকে শুনিয়ে বারবার ‘যাচ্ছি’ বলতাম! ঠাকুমা ছেড়ে চলে গিয়েছেন আজ থেকে ২০ বছর আগে। এখন আর তেমন ভাষায় কথা বলতে খুব একটা শোনা যায় না। ঠাকুমা যে ভাষায় কথা বলতেন, সেই ভাষাও মৃতপ্রায়। তবে এখনও মাঝে মাছে মধুর সুরে বাজতে থাকে— ‘যাওন নাই আওন’! ঠাকুমা নেই। পূর্ববঙ্গে জন্ম হওয়া আমার বড়জেঠুও নেই। বড়জেঠু আমায় ডাকতেন ‘ছেমড়া’ বলে। ছেমড়া মানে ছোকরা বা ছেলে। এখন কেউ কাউকে ছেমড়া বলে ডাকে না তেমন আর। আর ডাকলেও হয়তো, যাকে ডাকা হবে, সে গালাগালি ভেবে মারতে যাবে। কিন্তু সত্যিই মনে হয়, ‘ছেমড়া’ শব্দটায় অপত্য স্নেহ আর প্রশ্রয় মাখামাখি হয়ে আছে! এটাও তো একটি ভাষা। সে ভাষাও এখন ‘যাওন-যাওন’ করছে!
জলপাইগুড়িতেই আছে দেশের ক্ষুদ্র জনজাতি টোটোদের ভাষা। তিব্বত থেকে কয়েকশো বছর আগে এসে উত্তরবঙ্গে বাসস্থান খুঁজে নিয়েছিলেন টোটোরা। কথিত আছে, তিব্বতে পাহাড়ের যতগুলো চূড়ো রয়েছে, ভাষাও ততগুলি রয়েছে। টোটো ভাষাও তার মধ্যে অন্যতম এক চূড়ো। এ ভাষার নিজস্ব লিপি নেই। ছিল হয়তো কোনও সময়। তা স্বজাতিরাই বিস্মৃত হয়েছেন। টোটোরা বাংলা অক্ষর চেনেন। সেই আখরেই নিজেদের ভাষা লেখেন। গান লেখেন, কবিতা লেখেন। টোটোদের নিয়ে গবেষণা করেছেন ভাষাবিদ বিমলেন্দু মজুমদার। টোটো ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করিয়েছেন তিনি। টোটোদের মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার শুরুও তাঁর হাত ধরে। টোটো-সন্তানদের কেউ কেউ এখন বিশ্বের নামকরা তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত। কেউ সাহিত্যিক। জলপাইগুড়ির শিল্পসমিতি পাড়ার বাড়িতে বসে বিমলেন্দুবাবু বললেন, “ধনীরাম টোটো ভাল উপন্যাস লিখছে। সত্যজিৎ টোটো কবিতা শোনাতে দিল্লির ভাষা অ্যাকাডেমিতে যাচ্ছে। তবে টোটো ভাষার ভবিষ্যৎ ভাল নয়! অন্যান্য ভাষা গ্রাস করে নিচ্ছে! টোটো ভাষাও হারিয়ে যাবে!”
সঙ্কট শুধু ছোট ভাষার নয়, বহুজনের বলা ভাষাও সঙ্কটের মুখে। এখন ঝালমুড়ির চেয়ে মশালামুড়ি উচ্চারণের কদর বেশি। দোল তো কবেই হোলি হয়েছে। ‘হোলি’র সঙ্গে ‘শুভ’ মানায় না, তাই ‘হ্যাপি হোলি’ হয়েছে। গত বছর ‘হ্যাপি রবীন্দ্রজয়ন্তী’ও শুনেছিলাম। সোশাল মিডিয়ায় বাংলা বর্ণেই আকছার ‘হ্যাপি বার্থ ডে’। তা নিয়ে খুব একটা কেউ চিন্তিত বলে মনে হয় না! এই ‘হ্যাপি’ আমার মাতৃভাষার জন্য কতটা সুখকর, তা পণ্ডিতেরা বিচার করবেন। তবে, যাঁকে স্মরণ না করে বাংলা ভাষা নিয়ে কোনও লেখাই শেষ হতে পারে না বলে বিশ্বাস, সেই রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “জানার কথাকে জানানো আর হৃদয়ের কথাকে বোধে জাগানো, এ ছাড়া ভাষার আর একটা খুব বড় কাজ আছে। সে হচ্ছে কল্পনাকে রূপ দেওয়া।”
যে ভাষা আমাদের মনে থাকবে, সেই ভাষাই বেঁচে থাকবে। যে ভাষাকে যত্নে লালন পালন করব, সেই ভাষাই টিকে থাকবে। একুশে ফেব্রুয়ারি সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলা ভাষা রক্ষা নিয়ে দেদার অঙ্গীকার শোনা গেল। দেখা গেল, মানুষ কেমন আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে গর্বিত হচ্ছেন, অন্যকেও মুছে যেতে বসা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলতে উৎসাহিত করছেন। এই অতি-আধুনিক সমাজে আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে চর্চা শুরু হওয়া অবশ্যই একটা প্রাপ্তি। এ ভাবেও ফিরে আসা যায়! ঠিক যেমন ঠাকুমা কথা বলতেন, সেই কবেকার ভাষায়— ‘যাওন নাই, আওন!’
(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy