Advertisement
২৩ নভেম্বর ২০২৪
Anirban Mukhopadhyay

‘ট্যাগালাম’, ‘পোস্টাচ্ছি’— আ মরি বাংলা ভাষা...

মনে পড়ছে, কবি সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘পরানের গহীন ভিতর’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “ভাষার একটি রূপ কি স্মৃতি, অনুষঙ্গ, কল্পনা এবং অভিজ্ঞতার বিশেষ একটি সীমা নির্দেশ করে দেয় উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে?

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০ ০১:০০
Share: Save:

বদলে যায় বদলে যায় বদলে যেতে যেতে... এহেন কবিতা-পঙক্তি ঠিক কোনখানটিতে মোক্ষম সত্যি, তা মালুম পাওয়া যায় ভাষা নিয়ে ভাবতে বসলে। কোনও ফর্ম ভরার সময়ে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ নোন’-এর খোপটিতে বেমালুম বসিয়ে দিই বেঙ্গলি, ইংলিশ, হিন্দি। কিন্তু, কোন বাংলা? কোন ইংরেজি? কোন হিন্দি? এলুম-খেলুমের বাংলা? আইলাম-খাইলামের বাংলা? আর্থার কোনান ডয়েলের ইংরেজি? নাকি স্টিফেন কিং-এর? পিতাশ্রী-মাতাশ্রীর টেলি-সিরিয়ালি হিন্দি? নাকি আরে ইয়ার, চাক দে ফট্টে-র হিন্দি? কোনওটাই স্থাণু নয়, স্থির নয়, স্থবির নয়। উনিশ শতকে হুতোম যখন তাঁর নকশা লেখেন, তখন মান্যতাপ্রাপ্ত সমকালীন ‘ভদ্রজনোচিত’ ভাষাকে পরিহার করে স্ল্যাং ঘেঁষা এক ভাষাকে আপন করে নিয়েছিলেন। না হলে নকশা জমত না। কিন্তু সেই হুতোমি বাংলার মর্মার্থ আজকের বাঙালিকে বোঝাতে অরুণ নাগ মশাইকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে টীকা নির্মাণ করে দিতে হয়েছিল। নচেৎ অরুণবাবুর ভাষাতেই ‘হুতোমি গোল’-এর চক্করে পড়ে আমাদের বুঝভুম্বুলের অলাতচক্রে পাক খেয়ে মরতে হত।

সেই হুতোমকেই যদি আজকের ফেসবুকের চ্যাট পড়তে বসিয়ে দেওয়া যেত, তবে তিনি নির্ঘাত ফেসবুক-বাংলার টীকাকরণের জন্য অন্য কোনও অরুণবাবুকে খুঁজতেন। স্ল্যাং হোক বা না-হোক, কথ্যভাষার কিসিমটাই ওই প্রকার। বদলে যায় বদলে যায় বদলে যেতে যেতে…

কথ্য বাদ দিন। বাঙালির লেখার ভাষাও কি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে? এমনকি, সাধু গদ্যও? বিদ্যাসাগর সাধুভাষায় লিখেছেন, শরদিন্দুও। কিন্তু পর পর দু’জনের লেখা পড়লে মালুম পড়বেই ফারাকটা প্রায় প্রশান্ত মহাসাগর-সুলভ। ভাষা আর তার এক্সপ্রেশনের ক্ষমতা কালে কালে বদলাবে, এটাই স্বাভাবিক। আবার পরিসরের ফারাকটাও মনে রাখা দরকার। যে ভাষায় স্বামী বিবেকানন্দ ‘পরিব্রাজক’ লিখেছিলেন, সেই ভাষায় কি তিনি ‘কর্মযোগ’ লিখেছিলেন? এই সব গুরুপাক আলোচনার মাঝখানেই ফাঁকা মাঠে শেষ চৈত্রের ঘুর্নি হাওয়ার মতো পাক খায় আঞ্চলিক কথ্য বাংলার প্রসঙ্গ।

মনে পড়ছে, কবি সৈয়দ শামসুল হক তাঁর ‘পরানের গহীন ভিতর’ কাব্যগ্রন্থের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লিখেছিলেন, “ভাষার একটি রূপ কি স্মৃতি, অনুষঙ্গ, কল্পনা এবং অভিজ্ঞতার বিশেষ একটি সীমা নির্দেশ করে দেয় উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে? ‘এলোমেলো চুল’ আর ‘আউলাঝাউলা কেশ’ কি মর্মের ভেতরে এক ও অভিন্ন?” ভাবার কথা। ‘এলোমেলো’ আর ‘আউলাঝাউলা’ মোটেই এক এক্সপ্রেশন নয়। প্রথমটির মধ্যে যেন পারিপাট্য না গিয়েও থমকিয়ে আছে, আদর আছে। কিন্তু ‘আউলাঝাউলা’-র মধ্যে রয়েছে এক বন্য ভাব। কোনওটিই কোনওটির সম্পূরক বা পরিপূরক নয়। আর ‘চুল’ এবং ‘কেশ’ তো অসেতুসম্ভব দূরত্বের। ভাবা যায় ‘কেশ তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা’? কাজেই শামসুল হক সাহেবের সূত্র ধরেই বলা যায় স্মৃতি, অনুষঙ্গ, কল্পনা আর অভিজ্ঞতা— এ সব কিছুই নির্ধারণ করে ভাষার সীমানা। ফলে আজকে যেটাকে মান্য বাংলা হিসেবে এপার-ওপার— উভয়েই স্বীকার করে (উনিশ-বিশ ভেদে), তার চাইতে বহু দূরে ‘পরানের গহীন ভিতর’-এর কবিতাগুলি। তথাকথিত পূর্ববঙ্গীয় কথ্যে লিখিত সনেটগুলি লিখতে লিখতে শামসুল হকের মনে হয়েছিল, “একজন মার্কিন নিগ্রো কবি, একজন স্কটিশ কবি, একজন আফ্রিকান কবি যদি লৌকিক বাকভঙ্গি, শব্দ এবং উচ্চারণ ব্যবহার করে সার্থক ও স্মরণীয় কবিতা লিখতে পারেন, আমরাই বা বাংলায় সে সম্ভাবনা পরীক্ষা করে দেখব না?” এই পরীক্ষারই ফসল ছিল এই বইয়ের তেত্রিশটি সনেট, যা স্মৃতি, অনুষঙ্গ, কল্পনা আর অভিজ্ঞতা অতিক্রম করে অখণ্ড বাংলার প্রাণের সম্পদ। কারণ সেই সীমানাকে সেখানে ভেঙে দিয়েছিল কবিত্ব, শিল্প ও সুন্দরের বোধ, ‘ভালবাসা’ নামের এক ভয়ঙ্কর অন্তর্ঘাত।

কিন্তু যেখানে এই স্মৃতি, অনুষঙ্গ, কল্পনা আর অভিজ্ঞতা-র সীমানা পূর্বতোসিদ্ধ ভাবেই নেই? সেখানে কে নির্ধারণ করবে কোন ভাষা মান্য, আর কোনটা নয়? এপার বাংলা বা ওপার বাংলার বাহাস নয়, সোশ্যাল মিডিয়ার ‘অপার বাংলা’-র কথা কি এক বার ভাবা যায় এই ২১ ফেব্রুয়ারি? ফেসবুক আর ইনস্টাগ্রামের তরঙ্গে বাংলা ভাষার আজকের চেহারাটা ঠিক কেমন? সন্দেহ নেই, ‘মান্য’ আর ‘অ-মান্য’ বাংলার মাঝখানের সীমানাটা লুপ্ত করে দিয়েছে সাইবার স্পেস। যা লেখার তা গত এক দশকে লেখা হয়েছে, হয়ে চলেছে, যা লেখার নয়, তা-ও লিখিত আকারে চোখের সামনে। সাইবার বাংলার সীমানাহীন পরিসরে বাক্যগঠন ও বানানের চৌদ্দ পুরুষান্ত ঘটে, এই ক্লিশে অভিযোগ থেকে বেরিয়ে এসে যদি দেখা যায়, তো একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়ে দাঁড়ায় যে গত পাঁচ বছরে বাংলা ভাষার একটা অন্তঃসলিলা কিন্তু বেশ লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে সাইবার বাংলা। সাইবার পরিসরে লেখক একটা দায় থেকে মুক্ত থাকেন। সেটা শ্লীলতা-অশ্লীলতার দায়। কোন কথাটি লেখা যায় আর কোনটি যায় না, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার তোয়াক্কা খুব বেশি লোক করেন না। আর এই বেপরোয়া ভাবটা জেন্ডার নিরপেক্ষ। তিন দশক আগেও যে শব্দগুলি, লব্জগুলি পুং-সমাজের একচেটিয়া অধিকারভুক্ত হিল, এই মুহূর্তে নারীপৃথিবী সেগুলিকে নিজস্ব গোলা-বারুদ করে ফেলেছে। বাংলা অপভাষার বিশেষ সমৃদ্ধি ও প্রসারণ গত এক দশকে বিপুল পরিমাণে ঘটেছে সন্দেহ নেই। কিন্তু লক্ষণীয় এটাও যে এই ‘অপভাষা’-টি একান্ত ভাবে পুরুষ-নির্ধারিত। মেয়েদের একান্ত জগৎ থেকে তা উৎসৃত নয়। তা হলে সোশ্যাল মিডিয়াতেও ভাষা-শাসনের রাশটা থেকে গেল সেই পুরুষের হাতেই?

সে তর্ক তোলা থাক। অন্য এক প্রসঙ্গে আসি। ‘ট্যাগালাম’, ‘আমাকে ট্যাগাবেন না’, ‘পোস্টাচ্ছি’— এই সব শব্দ একান্ত ভাবেই সোশ্যাল মিডিয়া-সঞ্জাত। বাংলা অভিধানে এখনও এদের দেখা পাবেন না। তবে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে বলে মনে হয় না, শিগগির এই সব শব্দ আভিধানিক মর্যাদা পেল বলে। অচিরেই বাংলা ভাষায় ‘লাইকিয়েছিস’ মান্যতা পাবে। সোশ্যাল মিডিয়ার সীমানা ছাড়িয়ে এই সব লব্জ হয়তো দৈনন্দিনের কথোপকথনে উঠে আসবে। পাত্রী দেখে ফেরার পরে পাত্রের বাবা হয়তো ছেলেকে বলবেন, “আমি তো লাইকালাম, তুই?”

শুধু কথ্য আর স্ল্যাং নয়, সোশ্যাল মিডিয়া ভিন্ন এক ‘শিষ্ট’ বাংলাকেও বাজারে ছেড়েছে। কোনও বইয়ের প্রসঙ্গে কেউ কোনও পোস্ট দিলেই ঝাঁকে ঝাঁকে পাবলিক বলতে শুরু করেন, ‘সংগ্রহে আছে’ বা ‘সংগ্রহ করতে হবে’। এই ‘সংগ্রহ’ ব্যাপারটা ঠিক কী? কেনা? তা হলে তো ‘কিনতে হবে’ বা ‘কিনেছি’ বললেই ল্যাঠা চুকে যায়। খামোখা ‘সংগ্রহ’ কেন? যেন মুফতে বা ফোকটে ওই বই গুটি গুটি আলমারিতে এসে ঢুকে পড়বে। আবার সোশ্যাল মিডিয়া খুব সহজেই সুপারলেটিভের উপাসনা করে থাকে। কোনও রসের পোস্টের তলায় ‘সেরা’ শব্দের প্রাচুর্য লক্ষ করলেই সেটা বোঝা যায়। এই ‘সেরা’ মানে কিন্তু ‘শ্রেষ্ঠ’ নয়। এর দ্যোতনা ফেসবুকের বাইরে অবস্থানরতরা বুঝবেন না। ইনস্টাগ্রামে যেমন ‘স্যাভেজ’ শব্দটা ব্যবহৃত হয় কোনও কিছু অ্যাপ্রিসিয়েট করার সময়ে। তবে ওটা একেবারেই নব্য প্রজন্মের জারগন। ফেসবুককে ‘স্যাভেজ’-বাজরা এড়িয়ে যান। ওটা তাঁদের মতে ব্যাকডেটেড মিডিয়া। প্রশ্ন করলে তাঁরা বলেন, এত কথা বলার আছেটাই বা কী? ছবি আর দু’একটি মোক্ষম শব্দেই যদি মনের ভাব ফুলেফেঁপে ওঠে, তা হলে অতিরিক্ত বাখোয়াজির প্রয়োজনটাই বা কোথায়?

হক কথা। ফেসবুক যেখানে ভাষার চচ্চড়ি পাকাতে ব্যস্ত, ইনস্টা সেখানে মিতবাক। টুইটার তো আরও। তা হলে কি কিছু ছবি আর ‘স্যাভেজ! স্যাভেজ’, ‘ইয়ো’-জাতীয় এক্সপ্রেশন এসে দখল করে নেবে ভাষার জায়গাটা? মানে অর্থযুক্ত, সামাজিক অর্থযুক্ত শব্দ আর অভিব্যক্তিকে টপকে যাবে ইঙ্গিত আর ধ্বনি? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “কথা ইশারা বটে।” বিস্তর কাঠ এবং খড় পুড়িয়ে লুডভিগ হ্বিটগেনস্টাইন, জাক দেরিদা প্রমুখ পশ্চিমী তালেবরকুল সেই ইশারার রহস্য উন্মোচনে আজীবন ব্যয় করে গিয়েছেন। ভাষার জটিল রহস্য কি এ বার সত্যি সত্যি ‘ইশারা’-য় গিয়ে ঠেকবে? তা হলে কী হবে শামসুল হক বর্ণিত স্মৃতি, অনুষঙ্গ, কল্পনা আর অভিজ্ঞতা-র? নাকি, সোশ্যাল মিডিয়ার ওই ইঙ্গিতই বহন করবে নতুন স্মৃতি, অনুষঙ্গ, কল্পনা, অভিজ্ঞতা? বলা শক্ত। মেকানিক্যাল রিপ্রোডাকশনের যুগে ভাষা ও ভাব প্রকাশের ধাঁচা বদলে গিয়েছিল আমূল। এই ভার্চুয়াল রিপ্রোডাকশনের যুগে তা কী দাঁড়াবে, তা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, “কিছুটা সময় দিলে দুধে সর ভেসে ওঠে।” সময় যাক। ভাবের উথলে ওঠা প্রশমিত হলে সর ভেসে ওঠা পর্যন্ত সময় অপেক্ষায় কাটুক।

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

অন্য বিষয়গুলি:

Anirban Mukhopadhyay International Mother Language Day
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy