Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
Ruth Bader Ginsburg

‘আমি ভিন্নমত পোষণ করি’

নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনের ইহুদি পরিবারে ১৯৩৩ সালের ১৫ মার্চ জন রুথ বেডারের জন্ম।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:৪৬
Share: Save:

নতুন প্রেসিডেন্ট বহাল হওয়ার আগে আমার জায়গা যেন অন্য কাউকে দেওয়া না হয়, এই আমার আন্তরিক ইচ্ছা।”— জীবনের অন্তিম পর্বে নাতনির কাছে এই বাসনা ব্যক্ত করেছিলেন সাতাশি বছরের ঠাকুমা। আগের নির্বাচনেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয় তাঁর অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। মৃত্যুকে খানিক দাঁড় করিয়ে রাখতে চেয়েছিলেন এই নারী। কারণ, জীবনভর পুরুষতন্ত্র এবং সঙ্কীর্ণতার পাহাড় ভেঙে বিচারের বদ্ধ প্রাসাদে খোলা হাওয়া ঢোকার যে পথ তিনি গড়েছিলেন, আশঙ্কা ছিল নির্বাচন ত্রুটিমুক্ত না হলে তাঁর উত্তরাধিকারী সে পথে শিরদাঁড়া সোজা রেখে হাঁটতে পারবেন না। কারণ, দেশের বর্তমান প্রেসিডেন্টের নাম ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে এ-ও সত্যি যে, নতুন প্রেসিডেন্ট আসুন বা না আসুন, সেই প্রবীণার পরিবর্ত পাওয়া প্রায় অসম্ভব কাজ। কারণ ১৮ সেপ্টেম্বর যিনি মারা গেলেন, তিনি বিচারপতি রুথ বেডার গিন্সবার্গ (ছবিতে)।

নিউ ইয়র্ক সিটির ব্রুকলিনের ইহুদি পরিবারে ১৯৩৩ সালের ১৫ মার্চ জন রুথ বেডারের জন্ম। তুখড় ছাত্রীটি স্কুলের কাজকর্মের সঙ্গে ইহুদি রীতিনীতি পালনেও দক্ষ ছিলেন। তাঁর মেধাবিনী মা সিলিয়া, রুথকে সেই ‘নারী’ হতে বলতেন, যে ‘নিজের মতো’ হবে, ‘স্বনির্ভর’ হবে। দুর্ভাগ্য, রুথের গ্র্যাজুয়েশন সিলিয়া দেখে যেতে পারেননি। কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে গিয়ে আলাপ হয় মার্টিন গিন্সবার্গের সঙ্গে। তাঁর সঙ্গেই বিবাহ (১৯৫৪)। রুথের ভাষায় ‘মার্টি’ ছিলেন সেই যুবক, যিনি বুঝেছিলেন, “আমার বুদ্ধি আছে।” মহিলাদের ক্ষেত্রে তো আজও সৌন্দর্যই শেষ কথা; বুদ্ধি নয়।

রুথ হার্ভার্ড ল’ স্কুল-এ পড়তে যান স্বামী এবং শিশুসন্তান নিয়ে। কলম্বিয়া ল’ স্কুল থেকে যুগ্ম ভাবে প্রথম হয়ে আইনের পাঠ শেষ করেন। ৫০০ জন ছাত্রের সঙ্গে ৯ জন ছাত্রীর সেই শিক্ষা অভিযানের শুরু অনেকটা প্রথম বাঙালি মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের মতোই। হার্ভার্ডের ডিন ছাত্রীদের ডিনারে ডেকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ছেলেদের জায়গা দখল করে হার্ভার্ডে পড়তে এসেছ কেন?” ‘মহিলা’ আইনজীবী রুথের পক্ষে কাজ পাওয়া সে যুগে প্রায় অসম্ভব ছিল। তায় আবার ইহুদি, বিবাহিতা এবং মা। এক অধ্যাপকের চেষ্টায় পুরুষ সহকর্মীর চেয়ে কম মাইনেতে বিচারপতি পালমিয়েরি-র কাছে কাজ জুটল। স্বাধীনচেতা দৃঢ়চেতা রুথের সাফল্যের দৌড় সেখান থেকেই শুরু।

১৯৭২-এ রুথ ‘আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ় ইউনিয়ন’-এর ‘নারী অধিকার প্রকল্প’-এর জেনারেল কাউন্সেল হলেন। ৩০০-র বেশি মামলার মধ্যে শীর্ষ আদালতে গিয়ে লড়া ছ’টি মামলার কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সমানাধিকারের সংগ্রামের ময়দান হিসেবে রুথ বেছে নিয়েছিলেন আদালত কক্ষকেই। কারণ, শুধু নারীর নয়, সকল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার দাবি করতেন তিনি। যে আইন ‘আপাত ভাবে মহিলাদের জন্য হলেও আসলে পুরুষের উপর নির্ভরতা বাড়ায়’, তাকে বদলাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন তিনি। তাই শুশ্রূষাকারী পুরুষ অথবা বিপত্নীক ব্যক্তির অধিকার নিয়েও সওয়াল করেছেন। প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার রুথকে কলম্বিয়ার ‘কোর্ট অব অ্যাপিলস’-এর বিচারপতি নিযুক্ত করেন ১৯৮০ সালে।

১৯৯৩ সালে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন তাঁর নাম প্রস্তাব করেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসেবে। রুথ গিন্সবার্গ ছিলেন আমেরিকার শীর্ষ আদালতের দ্বিতীয় মহিলা বিচারপতি।

বিচারপতি রুথ গিন্সবার্গ বহু শিখর ছুঁয়েছেন। মহিলাকর্মীর সম-পারিশ্রমিকের অধিকার, মেয়েদের স্বাস্থ্য, গর্ভপাতের অধিকার ইত্যাদি নিয়ে তাঁর সিদ্ধান্ত আইনের ইতিহাসের মাইলফলক। আন্তর্জাতিক আইন, জনজাতি সংক্রান্ত আইনেও স্বচ্ছন্দ ছিলেন। ‘সেক্স’ শব্দকে সরিয়ে আদালতে উচ্চারণ করেছেন ‘জেন্ডার’। দেশের প্রথম সমলিঙ্গ বিবাহের হোতা ছিলেন। তাঁর লেখা প্রথম বইটাই বেস্টসেলার— মাই ওন ওয়ার্ডস। ‘মি টু’ আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছেন। ‘হল অব ফেম’-এ স্থান করে নিয়েছেন, একাধিক ‘সাম্মানিক ডক্টরেট’ পেয়েছেন।

সঙ্গীতপ্রেমী রুথকে আইনের ছাত্ররা আদর করে ডাকত ‘ডাকসাইটে আরবিজি’। বুশ বনাম গোর-এর মামলায় সংখ্যাগুরুর উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে ‘রেসপেক্টফুলি’ উড়িয়ে দিয়ে বুক ঠুকে বলেছিলেন, “আই ডিসেন্ট!” ভিন্নমত পোষণের সাহসই গিন্সবার্গকে সব দেশের সংবিধান ও স্বাতন্ত্র্যপ্রেমী নাগরিকের সামনে দৃষ্টান্তের মতো দাঁড় করিয়েছে। নিজের কারুকাজ করা গলাবন্ধের নাম দিয়েছিলেন ‘বিরোধী কলার’। শরীরে দু’বার ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। প্রিয় মার্টি-র প্রয়াণের দিনেও আদালতে গিয়েছেন। এই জীবনীশক্তিই তো আমরা খুঁজেছি ভারতের ইন্দিরা জয়সিংহ, লীলা শেঠ, দীপিকা সিংহ রাজায়ত অথবা পাকিস্তানের আসমা জাহাঙ্গিরের মধ্যে? প্রয়াত যোদ্ধার এই লড়াইকেই স্যালুট দিতে হাজারো মানুষ মোমবাতি আর প্ল্যাকার্ড নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন শীর্ষ আদালত প্রাঙ্গণে, রুথ-স্মরণে। হ্যাঁ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেও দাঁড়াতে হয়েছিল।

(ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।)

অন্য বিষয়গুলি:

Ruth Bader Ginsburg Justice
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy