গত কয়েক দিন ধরে প্রগতিশীল বাঙালিরা তড়িঘড়ি নিজেদের নির্জাত নিঃশ্রেণি ভেবে একখানা ‘অপর’ তৈরি করে পাপক্ষালনের খেলায় মেতেছেন। নতুন নয়। এমনটা তাঁরা ইতিহাসগত ভাবে করে এসেছেন। পরেও করবেন। কেন তাঁরা এটা করেন, তার ইতিহাসের রাজনীতিটা জেনে রাখা জরুরি। সেটা রাখলে রাতারাতি গৌরবান্বিত বা লজ্জিত, কোনওটাই হওয়ার দরকার হয় না। ঘটা করে নাটকীয় ভাবে লোকের সামনে লজ্জিত হলে সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অপরাধ লঘু বা অদৃশ্য হয় না। সেগুলো গড়নগত সমস্যা। গড়নগত কথাটা লক্ষণীয়। এর ইংরেজি অনুবাদ স্ট্রাকচারাল। যে অনুবাদ আন্দ্রে বেতেই করেছিলেন, বিয়াল্লিশ বছর আগে। গড়ন মানে অক্ষয়বট নয়। গড়নও ভাঙে। আবার পুরোপুরি অদৃশ্যও হয় না। কখন কী ভাবে মাথাচাড়া দেয়, সেটা বোঝা জরুরি। তা হলে অতিনাটকীয়তা, অস্বীকার, লজ্জা বিতরণ— এই সবের বাইরে গিয়ে একটা সমসাময়িক বোঝাপড়া হয়। সেটা জরুরি। সাদাকালোর বাইরে বার না হলে বিষয়টা বোঝারই অসুবিধে।
কী হল গত কয়েক দিনে? ৩ তারিখে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মেরুনা মুর্মু সমাজমাধ্যমে একটি ব্যক্তিগত মত প্রকাশ করেন। এই বছর পরীক্ষা হওয়া উচিত কি না, সেই বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল। মেরুনা লেখেন যে, না হলেই ভাল। আগে সুস্থ জীবন, তার পর পরীক্ষা। বোধ হয় আশঙ্কা করছিলেন যে, অনেক লোকের একসঙ্গে পরীক্ষা নিলে সেটা বিপজ্জনক হতে পারে।
সমাজমাধ্যম সমসামাজিক জগতের আয়নাও বটে, আবার তাকে অতিনাটকীয় করেও দেখায়। সমস্ত গণমাধ্যমই সেটা করে। সমীক্ষা হয়ে দাঁড়ায় বাস্তব। সঙ্কেত হয় স্পষ্ট দাবি। সমস্ত কথারই একটা অতিরিক্ততা থাকে। গণপরিসরে বেরিয়ে ব্যক্তিগত মত একটা অবস্থান হয়ে যায়। তার সঙ্গে বক্তার ব্যক্তিগত জীবনের বৃহত্তর বাস্তবতার একটা কাল্পনিক ছবি বয়ে নিয়ে সেই মত পাঠকের কাছে যায়। পাঠক এই ক্ষেত্রে অনির্দিষ্ট। সমাজমাধ্যমে গড়নগত ভাবে ব্যক্তিগত বলে কিছু হয় না। সামান্য কথাও গণপরিসরে এসে মতবাদী সংলাপে পরিণত হয়। এটা কথার অপলাপ বটে, কিন্তু সমাজমাধ্যমে সেটা হবেই।
পারমিতা ঘোষ নামে বেথুন কলেজের বাংলা বিভাগের এক ছাত্রীর মনে হয় মেরুনা ঠিক বলছেন না। তিনি অধ্যাপকের ফেসবুক ওয়ালে গিয়ে বিস্তর অশোভন এবং অসমীচীন মতামত দিয়ে আসেন। তাঁর মনে হয় অধ্যাপক মুর্মু অযোগ্য ভাবে চাকরি পেয়েছেন, এবং এই লকডাউনের বাজারে বসে মাইনে পাচ্ছেন। শুধু তা-ই না, নিজের ওয়ালে সদর্পে ঘোষণা করেন যে, ‘একটি’ মুর্মুকে দু’কথা শুনিয়ে এসেছেন। তাঁকে যোগ্য শিক্ষা দিয়েছেন। এই অন্যায় আচরণের আইনানুগ বিচার আবশ্যক। তিনি প্রাপ্তবয়স্কা। নিজের কথার বা মতের দায় তাঁকে নিতেই হবে। শেষ পাওয়া খবরে প্রকাশ, তাঁর পরিবার দাবি করেছে তিনি মানসিক ভাবে সুস্থ নন। এমন দাবিও উঠেছে যে কলেজ থেকে কোনও যোগাযোগই করা হয়নি। এই সব অভিযোগ ও দাবির ঠিক-ভুল বিচার করার খুব প্রয়োজন আছে কি? মনে হয় না।
যে কাজটা করা প্রয়োজন, সেটা অবশ্যই বেশ কঠিন। ব্যক্তিগত বাদ-বিসংবাদ একটু পেরিয়ে গিয়ে সামাজিক জীবনের দিক থেকে কতগুলো প্রশ্ন করতে হবে। অধ্যাপক মুর্মুর সমর্থনে বাংলায় এবং ভারতে বহু মানুষ লিখেছেন। ওঁর লেখাপড়া এবং পড়ানোর দক্ষতার উল্লেখ করেছেন তাঁরা। প্রয়োজন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে শিক্ষকের আসনে নিয়োগ করেছে, এটাই যথেষ্ট। এর পরে জনে জনে যোগ্যতার পরীক্ষা দেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। অধ্যাপক মুর্মুর সমর্থনে অনেকে বৃহত্তর গড়নগত ক্ষেত্রে বাংলায় জাতভেদ নিয়ে বলছেন। বলছেন, উচ্চবর্ণের হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি নাকি চির কাল বলে এসেছে বাংলায় জাতভেদ নেই। জাতভেদ মানে এ ক্ষেত্রে গণপরিসরে অস্পৃশ্যতা। যেটা উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতে আজও পুরোপুরি যায়নি। বাংলাতেও না। তবে এটা জানা জরুরি যে, ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সমস্ত প্রদেশে জাতভেদ গণপরিসরে অস্পৃশ্যতা অর্থাৎ একটা লঙ্ঘিত মানবাধিকার হিসেবে দেখা দেয় না। দিলে সহজ হত।
প্রসঙ্গত, অধ্যাপক মুর্মু সম্প্রতি নিজের জীবনের কিছু কথা বিস্তারে লিখেছেন। ওঁর বাবা ভারতের প্রথম সাঁওতাল আইপিএস অফিসার ছিলেন। বিস্তর বঞ্চনা সয়েছেন কাজের জীবনেও। মেরুনা বাংলার প্রথম সাঁওতাল, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। গত কয়েক বছর ধরে ওঁর এই ব্যতিক্রমী জীবনগতি বিষয়ে অনেক জায়গায় বলেছেন, লিখেছেন। সমস্যাটা এইখানেই। অধ্যাপক মুর্মু একটু বেশিই যোগ্য। এ দিকে অধিকাংশ হিন্দু বাঙালি সরকারি চাকরিকে দেখে নিশ্চিত জীবনের একটা গ্যারান্টি হিসেবে। গত সত্তর বছরে বাংলায় এই একটি জিনিসের অবক্ষয় হয়নি— সরকারি চাকরির বাজার। গত কুড়ি বছরে সর্বভারতীয় রাজনীতির চাপে উচ্চশিক্ষাক্ষেত্রে সংরক্ষণ মেনে অনগ্রসর শ্রেণির প্রতিনিধিদের সরকারি চাকরি দিতে সরকার বাধ্য হয়েছে। সংরক্ষণ তো নতুন কথা নয়, আগেও ছিল। তবে রাজনীতির ঠেলাটা ছিল না। ইতিহাস বলছে, সংরক্ষণের কল্যাণে এত দিনে একটা ছোট দলিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হচ্ছে। তারা সংরক্ষণের সুবিধে ভোগ করবে না তো কারা করবে? উচ্চবর্ণের ক্ষেত্রেও চির কাল অপেক্ষাকৃত সুবিধাভোগীরা বেশি সুবিধে পায়। এতে গাত্রদাহের কোনও সুযুক্তি নেই।
অন্য দিক থেকে, গাত্রদাহটাকে আসলে একটা ইতিবাচক ব্যাপার হিসেবে দেখা যেতে পারে। প্রতিযোগিতা অনুভূত হচ্ছে বলেই না গাত্রদাহ। আগেও এমন দেখা গিয়েছে। সামাজিক ক্ষমতা হাত থেকে বেরিয়ে যেতে থাকলে পূর্বতন ক্ষমতাধারীরা ঠিক এমনই বোধ করে। এই কারণেই মেয়েরা বাড়ির বাইরে বার হলে একশো বছর আগে তাদের ‘বাজে মেয়ে’ বলা হত। সেই নিয়ে বাংলায় মানবীবিদ্যা চর্চায় বিস্তর গবেষণা হয়েছে। এই কারণেই ব্রিটিশ শাসনে বাংলায় মুসলমানদের চাকরি সংরক্ষণের প্রস্তাবের অমন ভয়ানক বিরোধিতা হয়েছে। ১৯৩২ সালে যখন দলিতদের আলাদা ভোটাধিকার হল, ভারতীয় তথা বাঙালিরা রাগে অভিমানে মূর্ছা গেলেন। সে কী ভয়ানক প্রতিক্রিয়া! এক দিকে গাঁধীর অনশন। অন্য দিকে বাংলায় আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র থেকে গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ অবধি তাকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিভেদকারী দাবাখেলা বললেন। দেখা গেল, দলিতরা সেই আখ্যানে কেবল খেলার পুতুল। ১৯৪৬ সালে অম্বেডকরকে যখন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল বাংলা থেকে গণপরিষদে পাঠাবেন, তখন একটি কাগজ সম্পাদকীয় লিখল যে, জিন্না আর অম্বেডকর ব্রিটিশ রাজের পোঁতা দু’টি বিষবৃক্ষ। যেন গাছের জীবন নেই। যে পুঁতবে, গাছ তারই মালিকানা এবং দায় এবং দায়িত্ব।
বিতর্কটা আসলে এই মালিকানা নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সামাজিক মালিকানা কার? অধ্যাপনার বাস্তবতার সঙ্গে এই সামাজিক মালিকানার সরল সমীকরণটা আধিপত্যবাদী সংখ্যাগরিষ্ঠতা-ভিত্তিক। অধ্যাপক মুর্মুর মতো মানুষ নিছক পুতুল হিসেবে স্বাগত। কিন্তু অধ্যাপক মুর্মু পুতুল হবেন না ঠিক করেছেন। তাই ওঁকে নিয়ে এত বড় সমস্যা।
তবে যে বিষয়টা নিয়ে এই বিবাদের শুরু, সেটা ভুলে গেলে ভুল হবে। পারমিতারা চাকরি-বাকরি না পেলে অধ্যাপক মুর্মুর মতো বিরল মানুষের বিড়ম্বনা বাড়বে বই কমবে না। দায়টা অধ্যাপক মুর্মুর নয়। কিন্তু পারমিতাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবার পরেও সমস্যাটা কমার কথা নয়।
অধুনা উদারপন্থী সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে আস্থাবান মধ্যবিত্তের গণমাধ্যমের রাজনীতিতে একটা লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। এক দিকে একা কুম্ভ এক পেশাদার মধ্যবিত্ত, আর অন্য দিকে অসহিষ্ণু রাষ্ট্র তথা সমাজ। কখনও জনৈক উকিল সুপ্রিম কোর্টকে চিন্তায় ফেলেন। কখনও আইনের ছাত্রী একাই টুইট করে রেল দফতরকে শিক্ষা দিলেন। উদাহরণ বাড়ানো যায়। গণমাধ্যমে এই একক নায়কনায়িকাদের জয়জয়কার। সম্প্রতি অধ্যাপক মুর্মুকে নিয়েও বোধ হয় এমন একটা ব্যাপার হচ্ছে।
এই উদারবাদী ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের গণমাধ্যমের মধ্যবিত্ত পেশাদারি রাজনীতি আসলে এক রকম পরাজয়। যত বারই এই ব্যক্তিরা জিতুন না কেন, মূলের যে গড়নগত সমস্যা, সেগুলি আড়ালেই থেকে যাবে। ‘আদিবাসী’ অধ্যাপকের এই মধ্যবিত্তকরণের দোটানা রাজনীতির খুঁটিনাটির তাই একটা বিশ্লেষণ বা বোঝাপড়া দরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy