দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার জনসংখ্যার বিরাট অংশ আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, দক্ষিণ দিনাজপুরের মোট জনসংখ্যা ১৬,৭৬,২৭৬। এর মধ্যে আদিবাসী জনসংখ্যা ২,৭৫,৩৬৬ জন।এখানে আদিবাসী বলতে মূলত সাঁওতাল। তা ছাড়া আছেন মুন্ডা, ওরাঁও এবং মাহালি। এই ওরাঁওরা ছাড়া বাকি তিনটি গোষ্ঠী অষ্ট্রিক গোষ্ঠীভুক্ত। ওরাঁওরা দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মানুষ।
এই আদিবাসী মানুষেরা জন্মগত ভাবে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি থাকতে অভ্যস্ত। বসন্তকালে যখন গাছে গাছে ফুলে-ফলে ভরা, পাখিদের মিলনঋতু যখন, তখন এঁরা বাহা বা ফুল উৎসবে মেতে ওঠেন। মুন্ডা বাড়িতে তুলসীমঞ্চ দেখা যায়। মাহালিরা সূর্যের উপাসক। টুসু, মামসিন, গরয়া, কারাম, গঙ্গাপূজার মধ্যে এঁরা আজও প্রকৃতির কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেন। আজও এঁদের গোত্র বিভিন্ন পশুপাখির নাম থেকেই নেওয়া। যেমন, হাঁসদার প্রতীক হাঁস, কিস্কুর শঙ্খচিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসী সমাজেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ইংরেজের হাত থেকে বাঁচতে বহু আদিবাসী অবিভক্ত দিনাজপুরে চলে এসেছিলেন। আজ তাঁদেরই বংশধরেরা দক্ষিণ দিনাজপুরের আদিবাসী সমাজ। এক সময় তাঁরা ছিলেন ভূমিহীন কৃষক। তাঁরা মনিবের বাড়িতে জনও খাটতেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অপারেশন বর্গার পর বহু ভূমিহীন আদিবাসী মানুষ চাষযোগ্য জমি পান। এ সময় থেকেই আদিবাসীরা মূলত পায়ের নীচে জমি এবং সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার পান। অন্যের জমিতে খাটতে খাটতে নিজের অধিকারের জমি পেয়ে বহু আদিবাসী পরিবারের হাল খানিকটা ফেরে। যদিও নিরক্ষর আদিবাসীদের জমি যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায় সেই লক্ষ্যে আদিবাসী জমি হস্তান্তর রুখতে কঠোর আইন হয়েছিল, তবু দারিদ্র এবং সারল্যের সুযোগ নিয়ে উন্নত সম্প্রদায়ের মানুষ মৌখিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রচুর আদিবাসীদের জমি দখল করেছেন। আজও এই জেলায় বহু পেট্রোল পাম্পের মালিকানা, বহু গ্যাসডিলার খাতায়কলমে আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ, কিন্তু বকলমে সে সব চালান অবস্থাপন্ন বাঙালি বা মারওয়াড়ি সম্প্রদায়ের মানুষ।
সে সময় যাঁরা আদিবাসী উন্নয়নের সুফল ধরে রাখতে পেরেছিলেন, তাঁরা অবশ্য আজ সামাজিক ভাবে অনেকটাই সুরক্ষিত। নিজের জমির নিজের পরিশ্রমের ফসল বেচে, কষ্ট করে আজ যে সমস্ত আদিবাসী শিক্ষার আলো পেয়েছেন, তাঁরা আজ কম-বেশি সামাজিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত। জমির সূত্র ধরে শিক্ষা। এবং শিক্ষার সূত্র ধরে চাকরি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠা।
কিন্তু ঘটনা হল, এই প্রতিষ্ঠিত আদিবাসী সমাজ নিজেদের সংস্কৃতিকে, ভাষাকে অস্তিত্বসঙ্কটের সামনে ফেলে দিচ্ছে! সব বদ খারাপ নয়। আগের পাঁড়হাট-পাঞ্চি হতদরিদ্র গ্রাম্য সাঁওতালদের মধ্যে দেখা গেলেও শিক্ষিত সাঁওতালেরা রীতিমতো আধুনিক পোশাক পরছেন। উল্কি বা রূপোর গহনার প্রচলনও শিক্ষিত আদিবাসীদের মধ্যে আর নেই। কিন্তু আগে ভাত থেকে তৈরি মদ হাঁড়িয়া সাঁওতাল ওরাঁও সমাজে উৎসব-অনুষ্ঠানের মতো শুভকাজে দেবতার উদ্দেশে উপচার হিসেবে উৎসর্গ করা হত। আজ তা ব্যবসায়িক স্তরে হাটেবাজারে বিক্রি হচ্ছে। সাঁওতাল সমাজে কখনওই বিয়েতে যৌতুক প্রথার চল ছিল না, উল্টে মাত্র ২৭ টাকা কন্যাপণ দিয়ে সাঁওতাল পুরুষকে বিয়ে করতে হত। ফলে কন্যাসন্তানের অবস্থান সাঁওতাল সমাজে সুস্থ অবস্থানে ছিল। আজ শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কুশিক্ষারও প্রবেশ ঘটেছে এই আদিবাসী সমাজে। লব্ধপ্রতিষ্ঠিত পাত্রকেও বরপণ নিতে দেখা যাচ্ছে এখন।
পণ্ডিত রঘুনাথ মু্র্মু অলচিকি লিপি তৈরি করেছিলেন। এরপর ১৯৭৯ সালে তা সরকারি মর্যাদা পায়। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাঁওতালি ভাষায় শিক্ষাদানও করা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষিত সাঁওতালরা অলচিকি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে বাংলা এবং ইংরেজি অভিমুখী হয়ে পড়ছেন। তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েই গ্রামীণ সংস্কৃতিকে ভুলে শহুরে হয়ে উঠছেন। এসএসসি দিয়ে যাঁরা আজ বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই প্রাইভেট টিউশন করছেন, কিন্তু কেউই অলচিকি লিপিতে পড়ান না, সবাই বাংলা বর্ণমালায় পড়াচ্ছেন। সরকারি সুযোগসুবিধা পেতে, আর্থিক সঙ্গতি বাড়াতে তাঁরাও আজ আপোষকামী হয়ে পড়ছেন।
আজ আদিবাসী সমাজ স্পষ্টতই দু’ভাগে বিভক্ত— শিক্ষার সুফল নিয়ে এক শ্রেণি ‘এলিট ক্লাস’ হয়ে উঠছে তো আরেকটি আবহমান কালের দরিদ্র ও অশিক্ষিত শ্রেণি হিসেবেই থেকে যাচ্ছে। এই হতদরিদ্র শ্রেণিকে উন্নত আদিবাসীরা এড়িয়ে চলেন। সংরক্ষণের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগাতে না পারায় এঁরা একই তিমিরে রয়ে গিয়েছেন।
বাঙালি যেমন বাংলা ভাষা, বাংলা বর্ণমালা, বাঙালি সংস্কৃতি ভুলতে বসেছে, দক্ষিণ দিনাজপুরের আদিবাসী সমাজেও তেমনই বাঙালি সমাজের মতো ক্ষয়রোগ দেখা দিচ্ছে। বাঙালি যেমন অবাঙালি হওয়ার সাধনায় মজেছে, তেমনই আদিবাসী সম্প্রদায়ও আপন সংস্কৃতি ভুলে বাঙালি হওয়ার সাধনায় মেতে উঠেছে। আর এ ভাবেই জনজাতি গোষ্ঠীগুলো স্বকীয়তা হারিয়ে নামপরিচয়হীন হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে।
(লেখক দক্ষিণ দিনাজপুরের মহাদেববাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy