স্বল্পসঞ্চয়ে সুদের হার যে কমিতে চলিয়াছে, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের ঘোষণার পর তাহা এক প্রকার নিশ্চিত ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার কালাতিপাত করে নাই। হঠাৎ সুদের পরিমাণ এতখানি কমাইতে হইল কেন, সেই প্রশ্ন করিলে নির্মলা সীতারামন নিশ্চয় ঘোর বিরক্ত হইবেন। অননুকরণীয় ভঙ্গিতে জানিতে চাহিবেন, কোভিড-১৯’এর ধাক্কায় অর্থনীতি ভূপতিত— এখন সুদের হার না কমাইয়া উপায় কী? ঘটনা হইল, ইহা কারণ নহে, অজুহাত। করোনাভাইরাস হানা না দিলেও ভারতীয় অর্থনীতি বিপাকেই পড়িত। তাহারও অধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, সুদের হার কমাইয়াই বা কী সুরাহা হইবে? নির্মলা উত্তর দিবেন বলিয়া আশা হয় না। সুদের বোঝা খানিক লাঘব হইলে বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ কমিবে, সন্দেহ নাই। কিন্তু, এই মুহূর্তে সরকারের নিকট ইহা তুলনায় গুরুত্বহীন বিবেচনা হওয়ার কথা। নিরাপদ সঞ্চয়ে সুদের হার কমিলে মানুষ শেয়ার বাজারে লগ্নি করিয়া থাকেন। হয়তো অর্থমন্ত্রী, তাঁহার পরামর্শদাতাগণ, অথবা প্রধানমন্ত্রীর আশা, এই পথেই শেয়ার বাজারে কিছু টাকা আসিবে, ফলে বিনিয়োগ বাড়িবে। সেই আশা লইয়া কথা বাড়ানো অর্থহীন, কিন্তু এই বিপন্ন সময়ে মানুষকে শেয়ার বাজারের দিকে ঠেলিবার মধ্যে এক আশ্চর্য দায়িত্বজ্ঞানহীনতা আছে। মানুষকে শেয়ার বাজারের দিকে ঠেলিবার কাজটি তাঁহারা ২০১৯ সালে ক্ষমতায় ফেরা ইস্তক সচেতন ভাবেই করিতেছেন। কখন কী করিতে নাই, তাহা বুঝিবার ক্ষমতার নামই কাণ্ডজ্ঞান।
কোভিড-১৯’এর ফলে যখন একই সঙ্গে জোগান ও চাহিদার সঙ্কট সমুৎপন্ন, তখন অর্থশাস্ত্রীদের জপমন্ত্র হইবার কথা একটি নাম— জন মেনার্ড কেন্স। প্রয়োজনে গর্ত খুঁড়িতে অর্থব্যয় করা, এবং তাহা বুজাইতে ফের অর্থব্যয় করা, যাহাতে অর্থব্যবস্থায় ক্রয়ক্ষমতা জন্মে। ১৯৩০-এ মহামন্দার যে পটভূমিকায় কেন্স তাঁহার তত্ত্ব রচনা করিয়াছিলেন, ২০২০ সালের দুনিয়া ঠিক সেই সঙ্কটের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে। এই অবস্থায় ভারতে সাধারণ মানুষকে আরও বিপন্ন করিবার রাস্তা পাকা হইল। যাঁহারা মূলত সুদের উপরই নির্ভরশীল, বর্তমান সিদ্ধান্ত তাঁদের পক্ষে মারাত্মক। জোগানের সমস্যার ফলে মূল্যস্ফীতি কার্যত অনিবার্য— তাহার উপর সুদবাবদ আয় কমিয়া যাওয়া মানে দ্বিগুণ বিপদ। যাঁহারা উপার্জনক্ষম, এই সিদ্ধান্তে তাঁহারাও বিপাকে পড়িবেন— আয়ের সম্ভাবনা যখন সীমিত, তখন মানুষের বড় ভরসা নিরাপদ সঞ্চয় হইতে অর্জিত সুদ। বিপদে পড়িবে অর্থনীতিও। এই বিপর্যস্ত সময়ে সুদের হার কমিলে মানুষ ব্যয়ের পরিমাণ আরও বেশি হারে কমাইবে। তাহাতে অর্থনীতিতে সার্বিক চাহিদার সমস্যা গভীরতর হইবে। কেন্দ্রীয় সরকার এই কথাগুলি যথেষ্ট ভাবিয়াছে বলিয়া বিশ্বাস হয় না। অবশ্য, ভাবিবার অভ্যাস তাহাদের তেমন নাই।
গোড়ার প্রশ্নটি আরও এক বার করা যাউক— তড়িঘড়ি স্বল্প সঞ্চয়ের উপর সুদের হার কমাইতে হইল কেন? কোভিড-১৯’এর সহিত তাহার সম্পর্ক আছে, কিন্তু গুরুত্বে তাহা প্রাথমিক নহে, দ্বিতীয় সারির। এই মহামারি অর্থনীতির কঙ্কালটিকে তুলনায় দ্রুত প্রকাশ করিয়া দিয়াছে, এইমাত্র। নোটবাতিল আর জিএসটির ফলে এক দিকে অর্থনীতির বৃদ্ধির হার কমিয়াছে, অন্য দিকে তাহার ফলে রাজস্ব আদায়ের পরিমাণও কমিয়াছে। স্বল্প সঞ্চয়ে সুদের হার কমাইলে তাঁহাদের বাজেটের উপর চাপ কমিবে। কোভিড-১৯’এর অজুহাতে তাঁহারা কাজটি সারিয়া রাখিলেন। বুদ্ধির পরিচয়, তাহাতে সন্দেহ নাই— এই বাজারে যে কোনও অপ্রিয় আর্থিক সিদ্ধান্তকেই পরিস্থিতির কারণে অপরিহার্য বলিয়া চালাইয়া দেওয়া যায়। ইহাকে অবশ্য ধূর্ততা বলাই শ্রেয়। ভারতীয় অর্থব্যবস্থার যে সর্বনাশ গত ছয় বৎসরে হইয়াছে, তাহাকে ধামাচাপা দিতে এমন আরও অনেক ধূর্ততার প্রয়োজন হইবে বলিয়াই আশঙ্কা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy