রান্নায় ব্যস্ত রাজেশ শাহ (বাঁ দিকে)।
মনুষ্যজাতির স্বার্থপরতার সীমা মেলা সত্যই ভার। সে আপনার ব্যতীত কাহারও ভাল চাহে না। যে প্রকৃতিতে তাহার সৃষ্টি, সে আজ কেবল সেই প্রকৃতির ক্ষতিসাধন করিতেছে। করোনাভাইরাসের সঙ্কটকালেও দেখা গেল, বহু মানুষই কেবল আপনারটুকু বুঝিয়া লইয়াছেন। তাঁহারা আকালের আতঙ্কে দোকান শূন্য করিয়া চাল, ডাল, আনাজের ন্যায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করিয়া ফেলিলেন। প্রতিবেশী পাইল কি না, সেই ভাবনা ভাবিলেন না। এমনকি, গুদামের ন্যায় এই বিপুল সঞ্চয়ের ফলে শেষাবধি অপচয়ের ভয় আছে কি না, তাহাও চিন্তা করিলেন না। তবে, গড্ডলিকা প্রবাহেও বিপরীতধর্মী মানুষ থাকেন, তাঁহারা এই সঙ্কটে প্রতিবেশীর পাশে দাঁড়াইয়াছেন। কাঁকুড়গাছির এক হোটেলকর্মী রাজেশ শাহ যেমন। হোটেল বন্ধ থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রতি দিন প্রায় ছয়শত জনের রান্না করিতেছেন। না হইলে লকডাউনের ভিতরে কর্তব্যরত হাসপাতাল কর্মী, পুলিশকর্মী, সিভিক ভলান্টিয়াররা যথাসময় প্রয়োজনীয় খাবার পাইবেন কী করিয়া? ইহাতে সমগ্র জাতির স্বার্থপরের তকমা ঘুচিবে কি না জানা নাই, তবে কেহ কেহ যে এখনও মনুষ্যত্ব বাঁচাইয়া রাখিবার জন্য লড়িতেছেন, ইহা ভরসার কথা।
যাঁহারা আপনার পূর্বে সমাজের কথা ভাবেন, তাঁহাদের যুক্তিটি সহজ: আমি কষ্টে থাকিলেও বহু মানুষের দুর্দশা ততোধিক। কাহারও নিকট মাত্র একখানি হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার থাকিলে, কাহারও গৃহে সেইটুকুও নাই। কেহ খাদ্যদ্রব্য মাপিয়া খরচ করিতেছেন, কাহারও আবার মাপিবার ন্যায় সামগ্রীই নাই। সমগ্র জাতির এই দুঃসময়ে সহায়সম্বলহীনদের বিপদ অধিক। এ-মত পরিস্থিতি এক গোষ্ঠীর সাহায্যার্থে অপর গোষ্ঠীর আগাইয়া আসা সামাজিক কর্তব্য। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে প্রাক্তনীরা ‘কমিউনিটি কিচেন’ খুলিয়া অঞ্চলের দরিদ্র ও ভবঘুরেদের অন্নসংস্থান করিতেছেন, তাঁহারাও জানাইয়াছেন যে অতিমারির ধাক্কা সামলাইতে হইলে একে অপরের হাত ধরিতেই হইবে। নচেৎ শেষাবধি কেহই বাঁচিবে না। ডুমুরজলা স্টেডিয়ামের কোয়রান্টিন কেন্দ্রের চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রাণপণ সাহায্য করিতেছেন তাঁহাদের প্রতিবেশীরা। করোনা-যুদ্ধের প্রকৃত সৈনিকদের দৈনিক লড়াইয়ে যদি এইটুকু ভরসা দেওয়া না যাইত, তাহা হইলে বোধ হয় ‘মানুষ সমাজবদ্ধ জীব’ শব্দবন্ধটিই বিসর্জন দিতে হইত।
বস্তুত, এই অভূতপূর্ব সঙ্কটের কালে ব্যক্তিবিশেষ বা সমষ্টির প্রতিক্রিয়াই তাহার চরিত্র চিনাইয়া দিবে। ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করিবেও বটে। এখনও যদি আত্মকেন্দ্রিকতার খোলস ছাড়িয়া বাহির না হওয়া যায়, তবে মনুষ্যত্ব শব্দটি অর্থহীন হইবে। অতএব, বিপদের কালে সরকার কী করিতেছে বা রাষ্ট্র কতখানি দায়িত্ব লইতেছে ইহা লইয়া আলোচনা নিশ্চয় করিতে হইবে— সব ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র খানিক কাজ করিবে, খানিক করিতে পারিবে না— কিন্তু শেষাবধি এই সমাজ কত দূর বাঁধিয়া থাকিতে পারিবে তাহা প্রতিটি ব্যক্তির আচরণের উপরেই নির্ভর করিবে। বস্তুত, নাগরিকের সামাজিক স্তরে সচেতনতা রাষ্ট্রকেও আরও তৎপর হইতে বাধ্য করিতে পারে। রাষ্ট্রকে নিজের কর্তব্যের কথা স্মরণ করাইয়া দিতে পারে। সর্বোপরি, প্রদীপের শিখার ন্যায় সচেতনতার বোধটিও যদি এক নাগরিক হইতে অন্য নাগরিকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়, এই দুঃসময় হয়তো এক সভ্যতর সমাজের জন্মলগ্ন প্রত্যক্ষ করিবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy