পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস নিয়ে কিছু বলার সময় এসেছে। কেউ কেউ রসিকতার সুরে বলে থাকেন, মৃতদেহের বুকে ছুরি মেরে খুনের দায় নেওয়া কি বুদ্ধির কাজ! অগ্রজ এক বিশিষ্ট সাংবাদিক তো প্রায়ই বলতেন, ‘‘বুঝলে, কংগ্রেস আছে বলে জীবনে এখনও কিছু আমোদের খোরাক পাওয়া যায়! এই দলে যত মত, তত পথ, আর তত বেশি মজা!’’
ও সব অবশ্য নেহাতই রসিকতা। আসলে দেশের সবচেয়ে পুরনো, ঐতিহ্যসম্পন্ন এই জাতীয় দলটির মধ্যে এখনও এক অনিঃশেষ জীবনীশক্তি ধরা আছে। ভোট তলানিতে ঠেকলেও সেই প্রাণরস শুকোয় না। নটেগাছ মুড়োলেও গল্প চলতে থাকে!
তবে এখনকার আলোচনা এই রাজ্যের কংগ্রেসকে নিয়ে। প্রদেশ সভাপতি সোমেন মিত্রের মৃত্যুর পর থেকে গত প্রায় দেড় মাস যাবৎ দলটি কার্যত কোমায় পড়ে ছিল। শুনতে নির্মম হলেও, প্রদেশ কংগ্রেস ছিল যেন একটি মুণ্ডহীন ধড়— যার না আছে কিছু করার, না ভাবার, না বলার। একুশের নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে অন্য দলগুলি যখন নিজেদের মতো করে গুছিয়ে নেওয়ার কাজে নেমে পড়েছে, তখনও প্রদেশ কংগ্রেসের এমন স্কন্ধকাটা অবয়ব অবাক করেছে।
শেষ পর্যন্ত বুধবার অনেক রাতে অধীর চৌধুরীর নাম ঘোষণা করে পরিস্থিতি সামাল দিল কংগ্রেস হাইকম্যান্ড। ক্ষয়ে যাওয়া কংগ্রেসের ঝুলিতে এখনও পাঁচ-ছয় শতাংশ ভোট খুঁজে পাওয়া যায়। আগামী বিধানসভা ভোটেও কংগ্রেস ও বামেদের জোট হবে বলে রাজ্যস্তরে কথা এগিয়ে আছে।
কিন্তু সবার আগে ভেবে দেখা দরকার, বাংলার কংগ্রেস সম্পর্কে তাদের হাইকম্যান্ডের মনোভাব ঠিক কী। আজ হয়তো তার কিছুটা ইঙ্গিত মিলল।
জীবনের শেষ দুটি বছর তৃতীয় দফায় প্রদেশ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন সোমেনবাবু। অধীর চৌধুরীকে কোনও অজানা কারণে সরিয়ে পঁচাত্তর বছরের সোমেন মিত্রকে তাঁর হাঁটুর বয়সি রাহুল কিছুটা আকস্মিকভাবেই প্রদেশ কংগ্রেসের ভার দিয়েছিলেন। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি কেন বৃদ্ধতন্ত্রের পোষকতা করছেন, সেই প্রশ্ন সেদিন সামনে এসেছিল। তবে এই পর্বে সোমেনবাবু ঝগড়া-বিবাদ যথাসম্ভব এড়িয়ে তাঁর যেটুকু করার ছিল, করে গিয়েছেন।
বস্তুত প্রণব মুখোপাধ্যায় রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ার পর থেকে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ রাজ্য কংগ্রেসে তাঁর শিবির বলতে তেমন কিছু আর ছিল না। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির মৃত্যুর পরে সেই গোষ্ঠীও দুর্বল হয়ে পড়েছে। একক সোমেনবাবুর এবারের পথ তাই ছিল তুলনায় মসৃণ।
তা বলে পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেসকে নিয়ে হাইকম্যান্ডের খুব মাথাব্যথা হয় বা যথেষ্ট বিচার করে কর্মপন্থা ঠিক করা হয়, সেটা বলব না। আজ যেমন দেড় মাস ধরে সভাপতির পদ পূরণে কোনও তৎপরতা নজরে পড়েনি, তেমন অতীতেও এখানে হাইকম্যান্ডের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু ফাঁক বোঝা গিয়েছে। নানা ভাবে যার দায় ভুগেছে রাজ্যের দল। এরা যেন ‘অধম’ সন্তান!
খুব বেশি দূরে না গিয়ে ২০০০ সাল থেকেই দেখা যাক। প্রণববাবু প্রদেশ সভাপতি হলেন। তৃণমূলের সঙ্গে কংগ্রেসের কোনও ক্রমে একটি গা-আলগা জোট হল ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচনে। পরিণতি বোঝাই গিয়েছিল! ভোটের কিছু দিন পরে মমতা বিজেপি-র ঘনিষ্ঠ হলেন। জাতীয় রাজনীতিতে প্রণববাবুর ব্যস্ততা তখন আরও বাড়ছে।
২০০৪-এ কংগ্রেসের নেতৃত্বে প্রথম ইউপিএ সরকারে সিপিএম প্রত্যক্ষ অংশীদার হল। আর মনমোহন সিংহের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ সদস্য প্রণববাবু হয়ে উঠলেন জোট-সরকারের পক্ষে কংগ্রেসের মূল রাজনৈতিক ম্যানেজারও। তৃণমূল তখন বিরোধী পক্ষ। সাংসদ একা মমতা।
পশ্চিমবঙ্গের প্রদেশ সভাপতি প্রণববাবু তখন কলকাতায় আসতে পারতেন কমই। তাঁর সঙ্গে কাজের কথা বলতে বরং রাজ্য নেতাদের দিল্লি ছুটতে হত। আব্দুল মান্নান একবার কটাক্ষ করে স্বয়ং সনিয়াকে বলেছিলেন, ‘‘প্রদেশ সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে হলে প্রতিবার আমাদের তিরিশ হাজার টাকা নজরানা দিতে হয়!’’ সনিয়া জিজ্ঞাসু। মান্নানের ব্যাখ্যা ছিল, ‘‘প্রণবদার কাছে আসতে বিমান ভাড়া, দিল্লির হোটেল খরচ সব মিলিয়ে এটুকু তো কম বললাম!’’ শুনে হেসে ফেলেছিলেন সনিয়াও। তবে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি-ভাগ্য তাতে বদলায়নি।
২০০৬-এর বিধানসভা নির্বাচন এবং সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বেও প্রণববাবুই ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেসের মাথায়। অর্থাৎ দিল্লিতে থাকা ব্যস্ততম শীর্ষনেতাকে দিয়ে বাংলায় দল পরিচালনার ধারা বহমান! অবশেষে ২০০৮-এ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক আগে আসেন প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি। কিন্তু ভোটের পরেই অসুস্থ হয়ে সরতে হয় তাঁকে। আবার অল্প মেয়াদে ফেরেন প্রণববাবু। তার পরে ২০১১-এর বিধানসভা ভোটের সময় মানস ভূঁইয়া, তাঁর পরে প্রদীপ ভট্টাচার্য, অধীর চৌধুরী হয়ে সোমেন মিত্র। তার পর, দীর্ঘ প্রতীক্ষার শেষে অধীর চৌধুরীর প্রত্যাবর্তন।
এই লম্বা তালিকা পেশ করা অকারণ নয়। এতে দেখা যাচ্ছে, ২০০০ থেকে এক দশক, অর্থাৎ রাজ্য রাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, প্রণববাবুর মাপের জাতীয় স্তরের নেতাকেই প্রদেশ কংগ্রেসের দায়িত্বে রাখা হয়েছিল। তিনি সময় দিতে পারবেন কি না, সেটা বিচার্য হয়নি। কেন, সেই প্রশ্নটি জরুরি।
বস্তুত সেটা ছিল এমন এক সময় যখন দেশে কংগ্রেসের নেতৃত্বে সরকারে সিপিএম প্রথম সমর্থন দিয়েছে, রাজ্যে মমতার নেতৃত্বে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের আন্দোলন হয়েছে, প্রায় চিরস্থায়ী হয়ে ওঠা বামফ্রন্ট সরকারের পতনের ধ্বনিও শোনা গিয়েছে। এই অবস্থায় রাজ্য সংগঠনের মাথা দিল্লিতে ব্যস্ত থাকলে তার পূর্ণ সুফল পাওয়া যে সম্ভব নয়, কংগ্রেস হাইকম্যান্ডের তা-ও না-বোঝার কথা ছিল না।
তবু এটা করা হয়েছিল জাতীয় রাজনীতির বৃহত্তর দায়বদ্ধতার দিকে তাকিয়ে। ২০০৪-এ কেন্দ্রে কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউপিএ সরকারের কাছে সিপিএম তথা বামেদের সমর্থন যেমন প্রয়োজনীয় ছিল, তেমনই দরকার ছিল রাজ্যে কংগ্রেসের সিপিএম-বিরোধিতায় লাগাম পরানো। তার জন্য প্রণববাবুর ‘অভিভাবকত্ব’ কাজে লেগেছে।
মনে পড়ে, নন্দীগ্রামে গুলিচালনার পরে মমতা যেদিন বাংলা বন্ধ ডাকলেন, প্রদেশ কংগ্রেস নেতাদের দিশাহারা অবস্থা। সমর্থন করবেন কি না, কোনও নির্দেশ নেই। শেষে এক বিরল নজির গড়ে বিধানসভার পরিষদীয় দল থেকে বন্ধ সমর্থনের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হল। তার পরেই পরিষদীয় দলের অফিসে প্রণববাবুর ফোন, ‘‘বাড়াবাড়ি করতে কে বলেছে? সিপিএম দিল্লিতে আমাদের সরকারের সমর্থক, রাজ্যে এই হঠকারী সিদ্ধান্ত চলবে না।’’
ভিন্ন পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনীতির স্বার্থেই আজ সনিয়া চাইছেন মমতার হাত ধরতে। মমতাও হাত বাড়াতে প্রস্তুত। তা হলে এবার কী করবে রাজ্যের কংগ্রেস? ২০১৯-এ একই রকম প্রশ্নে রাজ্যের কংগ্রেস তৃণমূল-বিরোধিতার পথ থেকে সরেনি। অনুমোদন ছিল তৎকালীন সভাপতি রাহুল গাঁধীরও। কিন্তু গত দু’বছরে বিজেপি-শাসিত ভারতের রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতি আরও পরিবর্তিত। বিরোধীদের ঐক্য-প্রচেষ্টায় সনিয়ার উদ্যোগ এবং মমতার উপর তাঁর ভরসার ইঙ্গিত তাই স্পষ্ট হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষয়িষ্ণু কংগ্রেসকে সেখানে কোন পথে, কত দূর যেতে বলবে হাইকম্যান্ড?
তবে, সর্বশেষ ছবিটির দিকে তাকালে বলা চলে, আপাতত দিল্লির দোস্তির সঙ্গে রাজ্যে ‘কুস্তি’র কোনও আপস হওয়ার ইঙ্গিত নেই। মমতা-বিরোধী অধীরকে নতুন প্রদেশ সভাপতি বেছে নেওয়ার মধ্যেই হয়তো রইল সেই বার্তা। বাকিটা সময় বলবে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy