উৎপাদন ও ভোগ ঘিরে অর্থনীতির যে প্রগতির ধারণা, গাঁধীজি তাকেই প্রশ্ন করেছেন— বলছেন, অনৈতিক।
অর্থনীতি বিষয়ে গাঁধীজির বক্তব্যগুলি ছিল মূলধারার থেকে কয়েক যোজন দূরে। এ বিষয়ে যাঁরা ওয়াকিবহাল, তখন বা পরবর্তী কালে, সঙ্গত কারণেই তাঁরা সেগুলিকে তেমন গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি। তবে সবাই নন— গাঁধীর সমসাময়িক, তাঁর বিশেষ অনুগামী, আমেরিকার কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাপ্রাপ্ত জে সি কুমারাপ্পা কিংবা কিছু কাল পরের জার্মান-ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ ই এফ শ্যুম্যাখেরের মতো গুটিকয়েক ব্যক্তিকে বাদ দিলে বাকিরা সবাই। এই পাত্তা না পাওয়ার ব্যাপারটি গাঁধীজি নিজে বিলক্ষণ জানতেন, আর তা নিয়ে রসিকতা করতেও ছাড়েননি। ১৯১৬ সালে এলাহাবাদের ম্যুয়র সেন্ট্রাল কলেজ ইকনমিক সোসাইটিতে প্রদত্ত ভাষণে বলেন— “এই তো সে দিন এক বন্ধুস্থানীয় ভদ্রলোক সান্ধ্যভোজনে বসে আমার খ্যাপামি নিয়ে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিলেন। তাঁর জেরা যতই এগোচ্ছে— আর আমি যেহেতু স্বেচ্ছায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছি— আমার অজ্ঞতা প্রমাণ করতে তাঁকে এতটুকু বেগ পেতে হচ্ছিল না। আমি যেন তাঁর কাছে এমনই এক আত্মবিশ্বাসী নির্বোধ যে জানেই না যে সে কিচ্ছু জানে না। যারপরনাই শঙ্কা এমনকি ক্ষোভের সঙ্গে তিনি আবিষ্কার করলেন, আমি মিল, মার্শাল, অ্যাডাম স্মিথ আদি কোনও মহাত্মার বইই পড়িনি। হতাশায় ডুবে তিনি শেষমেশ উপদেশ দিলেন, আর্থনীতিক ব্যাপারে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে গিয়ে জনগণের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলার আগে আমি যেন এঁদের বইগুলো পড়ে নিই। তিনি জানতেন না আমি এমনই পাপী যে উদ্ধারেরও আর আশা নেই।”
নিজের ‘অজ্ঞতা’ নিয়ে এ ভাবে তিনিই মজা করতে পারেন, যিনি নিশ্চিত ভাবে জানেন— এই তথাকথিত অজ্ঞতা প্রমাণিত হলেও তাঁর কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি নেই, কারণ যে জ্ঞানের অভাবকে এখানে নির্দেশ করা হচ্ছে, তাকে যে তিনি আদৌ আহরণের উপযুক্ত মনে করছেন না, তা তাঁর এই সূক্ষ্ম শ্লেষাত্মক ভাষণেই স্পষ্ট। পশ্চিমি মূলধারার অর্থনীতি সম্পর্কে গাঁধীজির মনোভাবটি এমনই। হয়তো সে কারণেই গাঁধীজির আর্থনীতিক চিন্তা তাঁর সামাজিক রাজনৈতিক দর্শন থেকে কম আলোচিত। সামাজিক দর্শন বিষয়ে তাঁকে পশ্চিমি সভ্যতার ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীতে স্থাপন করার সুযোগ থাকায় পশ্চিমি সভ্যতা নিয়ে যাঁরা বীতশ্রদ্ধ, তাঁরা গাঁধীকে নিজেদের অবস্থানের সমর্থনে ব্যবহার করে থাকেন।
‘হিন্দ স্বরাজ’ তাঁর সর্বাধিক আলোচিত রচনা। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘পলেমিক’, এ তা-ই। রচনাটি আগাগোড়া ‘সম্পাদক’ এবং এক কল্পিত ‘পাঠক’-এর মধ্যে কথোপকথন। পাঠক এক একটি প্রশ্ন উত্থাপন করেন, আর সম্পাদক তার জবাব দেন। দেখা যাচ্ছে, প্রযুক্তির উন্নতি, বস্তুভোগ-নির্ভর আরাম, কিংবা যুদ্ধজয়ের সাজ-সরঞ্জাম— এ সবের মধ্য দিয়ে যে সভ্যতা এগোয়, সেই তথাকথিত পশ্চিমি ধারণাকেই গাঁধীজি পুরোপুরি বর্জন করছেন। এমনকি রেলপথ, আধুনিক হাসপাতাল কিংবা সংবাদপত্রের প্রসারেরও বিরোধিতা করেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: সঙ্কীর্ণতা মুছতে চাইতেন, তাঁকে অনুসরণ বিপজ্জনক হবে না?
আরও পড়ুন: পিতা-পুত্র নন, তাঁদের সম্পর্কের সুর বাঁধা ছিল অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্বে
এমন ‘বৈপ্লবিক’ দৃষ্টিভঙ্গির জন্যে এক দিকে যেমন তিনি অভূতপূর্ব মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন, আবার আর্থনীতিক বিষয়ে এই দৃষ্টিভঙ্গিই সম্ভবত তাঁকে গুরুত্বহীন করেছে। ধরেই নেওয়া হয়েছে আধুনিক অর্থনীতিকে বুঝতে এবং তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে গাঁধীর দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ অচল। পরবর্তী কালে অবশ্য তিনি বড় শিল্প, রেল, আধুনিক হাসপাতাল নিয়ে খানিক নরম হয়েছেন, এদেরকে মানবসভ্যতার ‘আবশ্যক বালাই’ হিসেবে দেখেছেন। এ সব কারণে গাঁধীজি রানাডে বা দাদাভাই নওরোজির মতো জাতীয়তাবাদী ব্যক্তিত্ব, যাঁরা অর্থনীতি নিয়ে লিখেছেন, তাঁদের থেকেও কয়েক যোজন দূরে অবস্থান করেন। আর, নেহরু ভারী শিল্পমুখী উন্নয়নের যে মডেলটির পক্ষ নিলেন, তা তো গাঁধীর ভাবনাচিন্তার সম্পূর্ণ বিপরীত।
শিল্পায়নের বিরোধিতায় তিনি একাধিক যুক্তি দিচ্ছেন। কখনও শিল্প বিপ্লব পরবর্তী ব্রিটেন তথা ইউরোপে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার করুণ চিত্রের দিকে আঙুল তুলে বলছেন, যন্ত্র মানেই অশুভ, অহিতকর। আবার অন্যত্র বলছেন, ভারতের মতো দেশে, যেখানে এমনিতেই শ্রম উদ্বৃত্ত, সেখানে যন্ত্র ব্যবহারের পরিণতি হবে এমন যে, অনেক মানুষের কাজ থাকবে না, কারণ একটি যন্ত্র অনেক মানুষের কাজ করে দিতে পারে। তাঁর প্রথম যুক্তিটি একটু নড়বড়ে। শ্রমিকদের করুণ অবস্থা আসলে বিশেষ ধরনের উৎপাদন ব্যবস্থার কারণে, যেখানে উৎপাদন উপকরণের মালিক শ্রমিককে ন্যূনতম মজুরিতে খাটিয়ে মুনাফা বাড়ায়। তাই যন্ত্রকে দোষারোপ করার যুক্তি নেই, নজরটা দেওয়া উচিত উৎপাদন সংগঠনের প্রকৃতির উপর। উপকরণের মালিকানা কার হাতে, যাঁরা শ্রমিক নন তাঁদের মধ্যে উদ্বৃত্ত মূল্য কী ভাবে বণ্টিত হচ্ছে, তার ওপর।
গাঁধীজির দ্বিতীয় যুক্তি, যন্ত্রের প্রবেশের ফলে শ্রমিকরা বেকার হয়ে পড়েন। এ আশঙ্কা বিভিন্ন সময়ে ঘুরেফিরে এসেছে। কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতিতে কিছু কাল আগে পর্যন্তও এর সমর্থন পাওয়া যায়নি। যন্ত্র এলে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন, কিন্তু যেহেতু যন্ত্র উৎপাদনশীলতা ও মুনাফা বাড়ায়, সেই মুনাফার অংশ আবার বিনিয়োগ হয়, বিনিয়োগের ফলে কর্মসংস্থান হয়, সামগ্রিক ভাবে বেকারত্ব তেমন বাড়েনি। তবে সাম্প্রতিক কালে এসে এ আশঙ্কা দ্রুত ব্যাপ্তি পাচ্ছে আবার, কারণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্সের প্রসার কর্মসঙ্কোচনের ভয় ধরিয়ে দিচ্ছে।
তাই গাঁধীর যন্ত্রবিরোধী অবস্থানের মধ্যে কিছু সারসত্যের সন্ধান করা যেতে পারে। যেমন, তাঁর দ্বিতীয় যুক্তিটি কিন্তু একেবারেই ফেলনা নয়। সম্পূর্ণ যন্ত্র বিরোধিতা হিসেবে না দেখে যুক্তিটিকে এ ভাবেও দেখা যায়— ভারতের মতো জনবহুল দেশে যেখানে পুঁজির নিদারুণ অভাব এবং শ্রম উদ্বৃত্ত, সেখানে শ্রম নিবিড় প্রযুক্তির পক্ষে যুক্তির পাল্লাটা ভারী। এ বিষয়ে গত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বিস্তর বিতর্কও হয়েছে। অমর্ত্য সেন তাঁর চয়েস অব টেকনিকস পুস্তিকায় দেখালেন, বর্তমানে শ্রমনিবিড় প্রযুক্তিতে সকলের কর্মসংস্থানের চেষ্টা করলে ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উন্নয়নে বিনিয়োগের জন্যে প্রয়োজনীয় উদ্বৃত্তের অভাব হবে, ফলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির আশা পূরণ হবে না। অতএব শেষ বিচারে প্রযুক্তি চয়নের প্রশ্নটি আসলে সামাজিক সিদ্ধান্ত। এই ভাবে ভাবলে, ‘প্রযুক্তিই প্রধান নির্ধারক’ এই ভাবনার মধ্যে যে অসহায় নিষ্ক্রিয়তার প্রবণতা আছে, তাকে এড়ানো যায়।
তাই প্রথাগত আর্থনীতিক প্রগতির দিক থেকে গাঁধীকে আপাতদৃষ্টিতে যতটা দূরের মনে হোক না কেন, তাঁর মতের খানিকটা গ্রহণ করে বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা যেতেই পারে। করেছেনও কেউ কেউ। এঁদের মধ্যে সব থেকে বেশি পরিচিত জার্মান অর্থনীতিবিদ ই এফ শ্যুম্যাখের। শ্যুম্যাখের জার্মানি ত্যাগ করে ব্রিটেনে চলে আসেন ১৯৩০-এর দশকে। তার পর ব্রিটিশ সরকারের আর্থনীতিক উপদেষ্টার কাজ করেন ১৯৪০ ও ৫০-এর দশকে। ১৯৫৫ সালে বর্মা ঘুরে এসে উপলব্ধি করেন, উন্নয়নশীল দেশগুলির উন্নয়ননীতির মধ্যে গুরুতর গোলযোগ আছে। তারা যে পুঁজি-নিবিড় প্রযুক্তির দিকে ঝুঁকছে, তা তাদের পক্ষে ভাল নয়। তিনি ‘মধ্যবর্তী প্রযুক্তি’র কথা বলেন যা শ্রম-নিবিড়, আকৃতিতে ছোট, যাতে বিনিয়োগও লাগে কম। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তাঁর স্মল ইজ় বিউটিফুল বইটি বেস্টসেলারের তালিকায় ওঠে। শ্যুম্যাখের তাঁর বইয়ে গাঁধীর প্রভাবের কথা বলেন, বিশেষত জে সি কুমারাপ্পার। গাঁধীর অর্থনীতি চিন্তাকে আরও স্পষ্ট রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন এবং নেহরুবাদী উন্নয়ন মডেলকে আগাগোড়া প্রশ্ন করে গিয়েছেন গাঁধী অনুগামী কুমারাপ্পা।
উৎপাদন ও ভোগ ঘিরে অর্থনীতির যে প্রগতির ধারণা, গাঁধীজি তাকেই প্রশ্ন করেছেন— বলছেন, অনৈতিক। আর্থনীতিক প্রগতি আর ‘প্রকৃত’ প্রগতির মধ্যে পার্থক্যও টানছেন। আর্থনীতিক প্রগতি তাঁর মতে শুধুই বস্তুগত প্রগতি— আরও আরও জিনিস। আর প্রকৃত প্রগতি হল ন্যায়নিষ্ঠ জীবনযাপনের দিকে অগ্রসর হওয়া। এই নৈতিক জীবন হবে গ্রামীণ সরল জীবনের মতো, পণ্যের পিছনে যে দৌড়বে না।
উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আধুনিকতায় ‘উত্তরণ’-এর ধারণাটি এখন উত্তর-আধুনিক চিন্তকদের প্রশ্নের মুখে। এক ধরনের উন্নয়নের ফলে পরিবেশের যে ক্ষতিসাধন হয়ে চলেছে, তার সমালোচনা করতে গিয়ে লাগামহীন ভোগবাদী উন্নয়নকে প্রশ্ন করতেই হয়। এই সব নিয়ে যাঁরা সক্রিয় আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত বিশ্ব জুড়ে, তাঁরা অনেকেই গাঁধীর প্রসঙ্গ আনেন। গাঁধীর আর্থনীতিক বক্তব্যকে নীতিপ্রণেতারা অবাস্তব আদর্শবাদ বলে দূরে ঠেলে রেখেছিলেন উত্তর-ঔপনিবেশিক উন্নয়নশীল বিশ্বে। এখন মূলধারার উন্নয়নের মডেলের ফাঁকফোকর যত সামনে আসছে, বিরোধী ভাবনাগুলো জনপরিসরে জায়গা পাচ্ছে, গাঁধীর নামও শোনা যাচ্ছে ততই।
ইনস্টিটিউট অব ডেভলপমেন্ট স্টাডিজ়, কলকাতা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy