বইটার হলদে হয়ে আসা পাতায় কালির কলমের বিবর্ণ রেখায় লেখা ছিল— ‘সুদীপ ও পাপিয়ার নতুন জীবনের সূচনালগ্নে, একরাশ ভালবাসা নিয়ে— দিদি ও পঙ্কজদা’। তারিখ লেখা ছিল। পঁয়ত্রিশ বছর আগের কোনও একদিন। বিয়ের প্রীতি উপহারে বই দেওয়ার চল ছিল যখন, ঝরনা কলমের লেখাগুলি সেই সময়ের। এই লেখা থেকে অবশ্য ধারণা করা যায় না যে, সে দাম্পত্য স্থায়ী হয়েছিল কি না। বইটি প্রীতি উপহারের নিদর্শন হিসেবে বুকসেলফে ছিল বহুদিন, পরে সম্ভবত ‘অপ্রয়োজনীয়’ হয়ে পড়ায় পুরনো কাগজের সঙ্গে একদিন ওজনদরে বিক্রি হয়ে যায়।
এই ভাবেই আশাপূর্ণা দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ ঠাঁই নিয়েছিল পুরনো বইয়ের দোকানে। তার জীর্ণ পাতা ওল্টাতে গিয়ে চোখ আটকে যায় ক্রেতার। পুরনো বই কিনে পড়তে গিয়ে এইগুলো এক বাড়তি পাওনা। বইটা একটা ইতিহাস নিয়ে পুরনো বইয়ের স্তূপে ছানি পড়া বৃদ্ধের মতো তাকিয়ে থাকে! এই বৃদ্ধাশ্রম থেকে কেউ কবে তাকে ভালবেসে ঘরে নিয়ে যাবে, তার অপেক্ষায়।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত কিশোর গল্প সংকলনের পাতা ওল্টাতে গিয়ে নজরে আসে প্রথম পাতার উপরে ডান দিকের কোনায় লেখা ‘আমার নাম পেতে হলে ২৫ পাতা বার করো’। নির্দেশ মতো ২৫ নম্বর পাতায় গিয়ে দেখা গেল ‘আমার নাম পেতে হলে ৬২ পাতা বার করো’। না, ৬২ নম্বর পাতা হতাশ করেনি। সেখানে লেখা ছিল ‘সুকল্যাণ ঘোষ, অষ্টম শ্রেণি। কিশোরটি নিশ্চয়ই আজ আর কিশোর নেই। হয়তো পুরোদস্তুর লোক হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার কিশোরবেলার পাগলামোর সাক্ষ্য দিচ্ছে পুরনো বইয়ের পাতা।
পুরনো বইয়ের আলাদা আলাদা চরিত্র থাকে। হাতে নিয়েই বোঝা যায় কোন বই কেনার পর অবহেলিত থেকে গিয়েছিল বহুদিন। কোনও বইয়ে মগ্ন পাঠকের আন্ডারলাইন বলে দেয়, লাইনটি তাঁকে নাড়া দিয়েছিল। সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ‘সাধের ময়না’ বইটির পাতায় পাতায় আন্ডারলাইন পাওয়া গিয়েছিল। আবার মানস দাশগুপ্তের ‘বিশ্বায়ন ভারত ও উত্তরবঙ্গ’ বইটিতে পৃষ্ঠার কোনায় কোনায় পূর্ববর্তী পাঠক তাঁর মতামত লিখে রেখেছিলেন।
পুরনো বইয়ের মধ্যে ৫০০ টাকার নোট পাওয়া গিয়েছিল, যা মুহূর্তের জন্য আনন্দ দিতে গিয়েও নিরাশ করেছিল। কেননা, নোট বাতিলের পর ততদিনে তা পুরনো ৫০০ টাকার নোটে পরিণত হয়েছিল। আবার মুজফফর আহমদের ‘নির্বাচিত রচনা সংকলন’-এ পাওয়া গিয়েছিল এক সংগঠনের চাঁদার রসিদ।
আজকাল পাঠক লুপ্তপ্রায় প্রাণী হয়ে যাচ্ছে। বাড়তি সময় বরাদ্দ থাকে নেট সার্ফিংয়য়ের জন্য। সামাজিক মাধ্যমে ‘ভার্চুয়াল’ তর্ক-বিতর্ক করার জন্য, জ্ঞান বিতরণের জন্য। তবুও মানুষ বড় বিচিত্র জীব। পুরনো অভ্যাসের মতো কিছু পুরনো নেশা থেকে যায়। আর সেই ভরসা নিয়েই পুরনো বইয়ের দোকানি নির্দিষ্ট খদ্দেরের আশায় বই আগলে বসে থাকেন। যাঁরা সময়-সুযোগ পেলেই সেই সব পুরনো বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারেন, তাঁরা জানেন, দোকানি কী বলবেন! ‘কয়েকটা বই এসেছে বহুদিন। শুধু আপনার জন্যই লুকিয়ে রেখেছি!’ দেখতে চাওয়ামাত্র দড়ি দিয়ে বাঁধা কয়েকটি বই বার করে আনবেন। বাছতে বাছতে হয়তো আপনার চোখ আটকে গেল আলেক্সান্ডার পুশকিনের নির্বাচিত রচনাবলির দ্বিতীয় খণ্ডে। বইটার স্বাস্থ্যও বেশ ভাল। আপনি যদি নেওয়ার মনস্থ করেন, তা হলে প্রথমেই দোকানির সামনে উৎসাহ লুকিয়ে রাখতে হবে। না! তেংমন কিছু তো নেই!— বলে পা বাড়াতে গিয়ে বলতে হবে, ‘একমাত্র এটাই নেওয়া যায়! দা কত?’ অভিনয়টা ঠিকঠাক হলে একেবারে ফেলনা দামেও বইটি পেয়ে যেতে পারেন!
কিন্তু বই কেনার চল কমছে। বই পড়ার অভ্যাস কমছে। পুরনো বই আরও পুরনো হতে হতে পাঠকের আশা ছেড়ে ঝালমুড়ির দোকানে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তাই ফণীশ্বরনাথ বেনু কিংবা বশিরের গা থেকে খুলে নেওয়া হতে পারে অমূল্য পৃষ্ঠাগুলো। ঝকঝকে নতুন বইয়ের আলাদা মজা আছে। কিন্তু পুরনো বইয়ের দোকানে ঘুরে পাওয়া যায় হঠাৎ চমকে ওঠার মতো কত উপাদান। ছেলেবেলায় গ্রীষ্মের ছুটিতে ছোটমাসির বাড়িতে পড়ে ফেলা বই ‘পৃথিবীর শেষ স্টেশন’ অনাবিল আনন্দ দিয়েছিল কোনও পাঠককে। সেই পাঠকই বহু বছর পর পুরনো বইয়ের দোকানে সেটা খুঁজে পেয়ে আত্মহারা! কোনও এক রবিবারের দুপুরে নিরিবিলিতে বইটা খুলে নতুন করে পড়তে শুরু করে তিনি দেখলেন, তাঁর পুরনো আবেগ পুরনো বইয়ের মতোই পুরনো হয়ে গিয়েছে। ফলে, তাঁর পক্ষে আর সেই বইটি দ্বিতীয় বার পড়ে শেষ করা হয়ে ওঠে না!
একবার এক লেখক আমলা কিছুদিনের জন্য চাকরি সূত্রে এসেছিলেন উত্তরের এক মফস্সল শহরে। প্রভাবশালী মানুষ। স্বনামধন্য লেখক। শহরের বহু লেখক তাঁকে নিজের লেখা বই উপহার দিয়ে ধন্য হয়েছিলেন। তারপর একদিন তিনি কলকাতায় ফিরে গেলেন। ভালবাসা, শ্রদ্ধা ও সম্মানের উপহারস্বরূপ বইগুলোকে আবর্জনা মনে করে ওজনদরে বিক্রি করে ভারমুক্ত হলেন। পুরনো বইয়ের দোকানে এসে সেই শহরের জনৈক লেখক বই ঘাঁটতে গিয়ে নিজের বই দেখে হোঁচট খেলেন। তাঁরই হস্তাক্ষর সম্বলিত বইটির মহান প্রাপকের নাম তাঁকে নিশ্চিত ভাবে ব্যথিতই করবে!
এমনই হাসিকান্নার সাম্রাজ্য মফস্সলের পুরনো বইয়ের দোকানগুলো। বদলির চাকরির মানুষ ঝঞ্ঝাট কমাতে যাওয়ার সময় কত বই বিক্রি করে দিয়ে চলে যান। সে সব অল্প পয়সায় মহামূল্যবান সামগ্রী হয়ে ওঠে সন্ধানী পাঠকের কাছে। খুঁজতে খুঁজতে মিলে যায় কত অমূস্য রতন!
(লেখক বালুরঘাটের মহাদেববাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy