অনধিকারী?: নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন যাঁরা, তাঁদের অধিকার তবে মানবাধিকার নয়? শ্রীনগর, জুন ২০১৭। ছবি: পিটিআই।
আপনাদের যত্ত চেঁচামেচি ওই যে কী বলেন আপনারা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস না কী যেন, তাই নিয়ে! গুন্ডা, বদমাশ, খুনিদের জন্য আপনাদের প্রাণ কাঁদে! এই যে জঙ্গিদের হাতে শয়ে শয়ে লোক মারা যাচ্ছে, এই যে এত জওয়ান এত পুলিশ কর্মী খুন হয়ে যাচ্ছেন, তার বেলা? কই একটা শব্দও তো আপনাদের মুখ দিয়ে বেরোয় না?
দীর্ঘদিন প্রশ্নগুলো মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মীদের দিকে ধেয়ে এসেছে, এসে চলেছে। একটা সহজ উত্তর এত দিন জানা ছিল। সম্প্রতি সহজতর একটি উত্তর দিল সিআরপিএফ। সুকমায় মাওবাদীদের হাতে ২৫ জন সিআরপি জওয়ানের মৃত্যুর ঘটনায় তথ্যের অধিকার আইনে বিবরণ চেয়েছিলেন মানবাধিকার কর্মী ভেঙ্কটেশ নায়ক। তাঁর জানা ছিল, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতি সংক্রান্ত প্রশ্ন ব্যতিরেকে সেনা ও আধাসেনা তথ্য-অধিকার আইনে উত্তর দিতে বাধ্য নয়। এই ঘটনাকে জওয়ানদের মানবাধিকারে আঘাত হিসেবেই দেখতে চেয়েছিলেন ভেঙ্কটেশ। সিআরপিএফ বলেছে, তারা কিছুই জানাবে না, কারণ জওয়ানদের হত্যাকে তারা মানবাধিকারের বিষয় বলে মনে করে না।
মিটে গেল। রাষ্ট্রের বাহিনী নিজেই স্বীকার করে নিল, সেনা-আধাসেনা-পুলিশের মৃত্যুতে মানবাধিকার কর্মীদের উতলা হওয়ার দরকার নেই। তা হলে মনে হচ্ছে, জওয়ানের মৃত্যুকে বাহিনী বোধ করি তাদের পেশাগত ঝুঁকি হিসেবেই দেখতে চায়।
মানবাধিকার কর্মীরা কি তবে এ বার দায়মুক্ত বোধ করবেন? আমজনতাকে জবাব দেওয়ার ক্ষেত্রে একটা চমৎকার হাতিয়ার পেয়ে উল্লসিত হবেন? হলে, লাভ নেই, ক্ষতি বিস্তর। কারণ, সিআরপিএফ-এর উত্তর কিছুই মিটিয়ে দেয়নি। বরং আরও বেশি করে ভাবতে বাধ্য করছে।
গোড়ায় যে প্রশ্নগুলো সামনে রেখেছিলাম, আর এক বার সে দিকে তাকানো যাক। সিআরপিএফ-এর উত্তরটি যদি এক পাশে সরিয়ে রাখি, তা হলে প্রশ্নগুলোর জন্য অন্য উত্তর ছিল এবং আছে। সংক্ষেপে এটুকু বলা যেতে পারে, মানবাধিকার রক্ষার প্রতিশ্রুতি ও দায় রাষ্ট্রই নিজের কাঁধে ন্যস্ত করেছে, তাই সেখানে বিচ্যুতি ঘটলে তার দিকেই আঙুল উঠবে। সেটাই স্বাভাবিক, সঙ্গত। নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে গ্রেফতার, হেপাজতে নির্যাতন, ভুয়ো সংঘর্ষ, আইনি রক্ষাকবচের ব্যবস্থা না থাকার মতো ঘটনা ঘটলে, রাষ্ট্রকেই কাঠগড়ায় তোলা হবে। কারণ, এমন ঘটনা না ঘটানোর অঙ্গীকার সে-ই করেছিল। অন্য দিকে যে সব সংগঠন হত্যাকেই তাদের রাজনৈতিক লাইন মনে করে, তারা কেউ মানবাধিকারের কসম খায়নি। কিন্তু রাষ্ট্রের দরবারে তাদেরও যখন বিচার হবে, মানবাধিকার মেনেই রাষ্ট্রকে চলতে হবে। সেটা রাষ্ট্রের দুর্বলতা নয়, তত্ত্বগত ভাবে অন্তত সেটাই সাংবিধানিক রাষ্ট্রের শক্তি। নিজেকে নৈতিকতার আধার হিসেবে টিকিয়ে রাখার শক্তি। ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন’, এ লব্জ রাষ্ট্রের মুখ থেকেই নির্গত হওয়ার কথা। সেটা না হলে রাষ্ট্র নিজেই নিজেকে ক্ষয় করে ফেলবে। তার ভূরি ভূরি নজির পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে আছে। ৯/১১-র তদন্ত করার নামে গুয়ান্তানামো বে ঘটালে আখেরে ভাল হয় না, সেটা এত দিনে পরিষ্কার।
কিন্তু মানবাধিকারের আলোচনাটা এইখানেই থমকে গেলে সত্যিই মুশকিল। অন্তত আরও দু’টি প্রেক্ষিত মাথায় রাখা জরুরি। একটি স্থানিক, অন্যটি একই সঙ্গে স্থানিক এবং আন্তর্জাতিক।
আমাদের দেশে মানবাধিকার আন্দোলনের পরিসরে একটি স্ববিরোধ মাঝে মাঝেই উঁকি দিয়েছে। সেটি রাষ্ট্র সম্পর্কে অবস্থান। এ কথা বলা হয়তো ভুল হবে না যে, এখানকার মানবাধিকার কর্মীদের একটা বড় অংশই নিজেরা বাম বা অতিবাম মতাদর্শের কাছেপিঠে থাকা মানুষ। সেই সূত্রে রাষ্ট্রব্যবস্থার কাঠামোটিকে নিয়েই তাঁদের মনে নানা রকম প্রশ্ন আছে। কাজে কাজেই সেই রাষ্ট্রের নিরাপত্তা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের প্রতি একটা বিরাগমূলক মনোভাব এই সমাজকর্মীদের মনে একটা স্তরে এমনিতেই গেঁথে আছে। তার সঙ্গে সেনা-পুলিশের তরফে নৃশংস দমনপীড়নের সুদীর্ঘ অতীত ও বর্তমান সেই বিরাগকে আরও পোক্ত করেছে। ইতিহাসগত ভাবেও, এ দেশের সেনা-পুলিশ-আইনব্যবস্থার ইমারত এখনও অবধি ঔপনিবেশিক কাঠামো অনুসরণ করে চলেছে। তার সঙ্গে দৈনন্দিন দুর্নীতির প্রকোপ মিলেমিশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সেনা-পুলিশের বহুলাংশেই একটা ঐতিহাসিক বৈরিতার সম্পর্ক বহতা থেকে গিয়েছে। সম্প্রতি মানব-ঢাল নিয়ে সেনাপ্রধানের মন্তব্য সংক্রান্ত একটি চর্চিত আলোচনায় সমাজবিজ্ঞানী পার্থ চট্টোপাধ্যায় এই কথাটাই মনে করিয়ে দিয়েছেন।
ঘটনা হল, যে মানবাধিকার কর্মী এক দিকে চলতি ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের স্বরূপকেই অনৈতিক বলে ধরে নিচ্ছেন, তিনিই আবার আন্দোলনের ময়দানে নীতিগত বিচ্যুতি নিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, রাষ্ট্রের কাছেই নালিশ ঠুকছেন। অর্থাৎ যা তাঁর মতে অসংশোধনীয়, তিনি তাকেই সংশোধন করতে চাইছেন। অন্য দিকে এ দেশের গরিষ্ঠ জনতার (অঞ্চলভেদে রকমফের আছে— কাশ্মীর বা মণিপুরে ছবিটা নিঃসন্দেহে আলাদা হবে) মানবাধিকার সংক্রান্ত সচেতনতা নগণ্য বললেই হয়। সেখানে মানবাধিকার আন্দোলনের উদ্দেশ্য-বিধেয় তাঁদের অনেকটাই ধাঁধার মতো লাগে। তাঁদের মনে ধারণা জন্মাতে থাকে, মানবাধিকার আন্দোলন হল ‘অপরাধী’দের হয়ে গলা ফাটানোর আন্দোলন। সেই ‘অপরাধী’দের হাতে সেনা-পুলিশ খুন হয়ে গেলে যখন মানবাধিকার কর্মীরা নীরব থাকেন, তাঁদের প্রাগুক্ত ধারণাই আরও বলবতী হয়। মানবাধিকারের যুক্তিতে এই নীরবতা যদি অপ্রত্যাশিত না-ও হয়, মানবতার যুক্তিতে অসঙ্গত। আম আদমির মনে সেটা বড় ভারী হয়ে বসে।
এই সূত্র ধরেই বিশ্বায়িত সন্ত্রাসবাদের প্রেক্ষিতটিও মনে রাখা দরকার। গত কয়েক দশকে সন্ত্রাসের যে অভূতপূর্ব উদ্গিরণ ঘরে-বাইরে দৈনন্দিন হয়ে উঠেছে, মানবাধিকারের ধ্রুপদী আঙ্গিকে তাকে বোঝা সম্ভব কি? যে জঙ্গিবাদ মানবাধিকার তো দূর, মানবতার কোনও চিহ্নই মানে না, মানবাধিকারের সন্দর্ভে তাকে কী ভাবে মোকাবিলা করা হবে, এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু সেটা না হলে বিচারপর্বে জঙ্গির মানবাধিকার রক্ষিত হল কি না বা জঙ্গি ধরার নামে নির্বিচার ধরপাকড় চলছে কি না, এই আলোচনাগুলো মুষ্টিমেয়র বাইরে আমজনতার কাছে অপ্রাসঙ্গিক হতে থাকবে।
আপাতদৃষ্টিতে মানবাধিকার কর্মী ভেঙ্কটেশ এক ব্যতিক্রমী প্রয়াস শুরু করেছিলেন। সিআরপিএফ তাকে অগ্রসর হতে দিল না। কেন? শুধুই গোপনীয়তার স্বার্থে? একটা সন্দেহ জাগছে। এমনটা কি হতে পারে, রাষ্ট্র নিজেই চায় না মানবাধিকার আন্দোলন তার গণ্ডিটা বাড়াক? আরও প্রাসঙ্গিক, আরও গণভিত্তিক হোক? সেটা হলে তো মানুষ সেনা-পুলিশ-প্রশাসনকে আর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বলে ভেবে নেওয়ার প্রাগাধুনিক অভ্যাসে আটকে থাকবে না। সেনা গুলি চালাবে, পুলিশ মারবে, এগুলোকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেবে না। জীবনের ধাপে ধাপে কড়া অভিভাবক, কড়া মাস্টার, কড়া শাস্তির গুণ গেয়ে পরাক্রমের কাছে মাথা নোয়াতে শিখবে না। সেনা-পুলিশ যদি মানবাধিকার নিয়ে আর পাঁচটা মানুষের সমগোত্রীয় হয়ে ওঠে, তা হলে শৌর্য-বীর্যের কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে চড়া দেশপ্রেমের বটিকা কোন কাজে আসবে? তার চেয়ে এনকাউন্টার-স্পেশালিস্টরা সিনেমার নায়ক হোন। তাঁরা পরদা জুড়ে আক্ষেপ করতে থাকুন— মানবাধিকারওয়ালাদের হইচই বড় বালাই! নইলে কবে সমাজের সব জঞ্জাল স্রেফ সাফ হয়ে যেত!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy