Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

তিনি যাহা বলেন

কমিউনিস্ট চিন সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত ছিল— দুই আর দুই যোগ করিলে কত হয়, সেই প্রশ্নের উত্তরে দেশের পরিসংখ্যান বিভাগের কর্তা নাকি বলিয়াছিলেন, আজ্ঞে, চেয়ারম্যান মাও যত হইতে বলিবেন।

ছবি পিটিআই।

ছবি পিটিআই।

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৯ ০০:০১
Share: Save:

xঅ্যাঙ্গাস ডিটন বা টমাস পিকেটির ভারতীয় রাজনীতির ময়দানে কোনও বিশেষ পক্ষপাত আছে, এমন দাবি করা হাস্যকর। প্রথম জন নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ; দ্বিতীয় জন ক্রমবর্ধমান আর্থিক অসাম্য বিষয়ে বিশ্ববন্দিত বইয়ের লেখক। তাঁহারাও যখন ভারতে পরিসংখ্যান লইয়া ছেলেখেলার বিষয়ে নিজেদের গভীর উদ্বেগ ব্যক্ত করিয়াছেন, তখন স্বীকার করা ভাল যে উদ্বেগের কারণ যথেষ্ট। সরকার ২০১৭-১৮ সালের ভোগব্যয় সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করিতে নারাজ— কেননা, তাহার সহিত জোগান সংক্রান্ত পরিসংখ্যান মিলিতেছে না। দুনিয়ার প্রথম সারির ২০০ জনের বেশি অর্থনীতিবিদ— ডিটন এবং পিকেটি ছাড়াও সেই তালিকায় আছেন অক্সফোর্ডের অধ্যাপক বারবারা হ্যারিস-হোয়াইট, যোজনা কমিশনের প্রাক্তন সদস্য অভিজিৎ সেন প্রমুখ— প্রশ্ন করিয়াছেন, পরিসংখ্যানে খামতি থাকিলে তাহা ঠিক করিয়া লইবার বিবিধ উপায় যখন আছে, তখন তাহা বাতিল করিবার কারণ কী? তদুপরি, জোগানের পরিসংখ্যানেই যে জল নাই, তাহার নিশ্চয়তাই বা কোথায়? এই প্রশ্নগুলির উত্তর নরেন্দ্র মোদীরা যে দিবেন না, তাহা অনুমান করা চলে। পরিসংখ্যান গায়েব করিবার পিছনে ভোগব্যয়ের পরিমাণ হ্রাসের উদ্বেগজনক তথ্যটির অবদান কতখানি, তাহাও বোঝা সম্ভব।

প্রকৃত সমস্যার সূত্রপাত এখানেই। পরিসংখ্যান গায়েব হইলে এই মুহূর্তে প্রমাণ করা অসম্ভব হইবে যে ভারতবাসী খারাপ অবস্থায় আছেন। কিন্তু, বাস্তব সেই প্রমাণের তোয়াক্কা করে না। বেহাল অর্থনীতি দারিদ্রের উপর তাহার চিহ্ন রাখিবেই। কিন্তু, পরিসংখ্যান না থাকিলে দারিদ্র সংক্রান্ত নীতি রচিত হইবে কিসের ভিত্তিতে? খুব সম্ভবত কিছু দিন পর এক দফা ‘সরকারি’ পরিসংখ্যান প্রকাশ্যে আসিবে। তাহার সর্বাঙ্গে পাউডার-স্নো-পমেটমের বাহুল্যে দারিদ্রের সত্য চেহারাটি ঢাকাও পড়িবে। কথায় বলে, যথেষ্ট অত্যাচার করিতে পারিলে পরিসংখ্যানকে দিয়া যাহা ইচ্ছা বলাইয়া লওয়া সম্ভব। কিন্তু, সেই সরকারি মঞ্জুভাষ গবেষণার কোন কাজে লাগিবে? আজ হইতে দশ বৎসর পরে দারিদ্র সংক্রান্ত গবেষণা হইলে তৎকালীন পরিসংখ্যানের তুলনা হইবে কিসের সঙ্গে? অতএব, শুধু বর্তমান গবেষণারই নহে, ভবিষ্যৎ গবেষণারও মোক্ষম ক্ষতি করিবে পরিসংখ্যান লইয়া এই ছেলেখেলা। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ঘটনাগুলি যে দেশে ঘটিতেছে, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ একদা সেই দেশেই গড়িয়া তুলিয়াছিলেন এক বিশ্বমানের পরিসংখ্যানব্যবস্থা। সদ্য-স্বাধীন, দরিদ্র একটি দেশের পক্ষে সেই কৃতিত্ব বিস্ময়কর ছিল। দুনিয়ার সেরা রাশিবিজ্ঞানী আর অর্থশাস্ত্রীরা ভারতে আসিতেন এই পরিসংখ্যানের আকর্ষণে। যে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত আগ্রহে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি হয়, আর যে প্রধানমন্ত্রীর তাড়নায় সেই ব্যবস্থার কোমর ভাঙে— ভারত উভয়কেই দেখিল। চিনিল কি?

কমিউনিস্ট চিন সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত ছিল— দুই আর দুই যোগ করিলে কত হয়, সেই প্রশ্নের উত্তরে দেশের পরিসংখ্যান বিভাগের কর্তা নাকি বলিয়াছিলেন, আজ্ঞে, চেয়ারম্যান মাও যত হইতে বলিবেন। অতিরঞ্জন, কিন্তু তাহার মধ্যে একটি গভীর সত্য আছে। পরিসংখ্যান বস্তুটির স্বাধীনতা এক বার খর্ব হইলে, তাহা রাজনৈতিক প্রভুর আজ্ঞাধীন হইলে প্রকৃত পরিসংখ্যান মরিয়া যাইতে থাকে। তাহার বদলে শুধু সেই ‘তথ্য’ মিলে, প্রভু যাহা শুনিতে চাহেন। চিনের দুর্ভিক্ষের পিছনে এই ‘মেকি তথ্য’-এর অবদানের কথা এখন গবেষণা-স্বীকৃত। নরেন্দ্র মোদীরা সেই বিপজ্জনক ঢাল বাহিয়া দৌড়াইতেছেন। তাঁহাদের সঙ্কীর্ণ রাজনীতির জাঁতাকলে ভারতকে পিষিয়া মারিবার ব্যবস্থা পাকা। ভারতীয় অর্থনীতির ঘাতক হিসাবে নিজেদের নামটি ইতিহাসের পাতায় বসাইবার ব্যবস্থাও পাকা।

অন্য বিষয়গুলি:

Economy India Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy