বিক্ষোভ: ঋণ-দুর্নীতির বিরুদ্ধে এনসিপি কর্মীদের প্রতিবাদ। মুম্বই, ফেব্রুয়ারি ২০১৮। পিটিআই
আবার একটা ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় গোটা দেশ। আবার বহু হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারি। আর, তার পরেই ফের অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপানোর খেলা আরম্ভ হয়ে গিয়েছে। বিরোধী দল সরকারকে দোষ দিচ্ছে, সরকার রিজার্ভ ব্যাংককে, রিজার্ভ ব্যাংক দায় চাপাচ্ছে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকের আর অডিটরদের ঘাড়ে। এ রকম একটা চুরিও যে হতে পারে, তা যেন কেউ জানতেনই না! আসুন, এক বার হর্ষদ মেটা, কেতন পারেখদের কথা স্মরণ করি। ২০০৮ সালের বিশ্বজোড়া আর্থিক সংকটের পিছনেও এক ধরনের দুর্নীতিরই দায় ছিল। ব্যাংকে লক্ষ-কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণের এক একটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে এমন আরও অনেক গল্প বেরিয়ে আসবে। যাঁরা যখন সরকার চালিয়েছেন, ব্যাংক-ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন, নিয়মের গাফিলতি সহ্য করেছেন, অন্যায় ভাবে কাউকে যোগ্যতার অতিরিক্ত ঋণ পাইয়ে দিয়েছেন, ব্যাংকের কাছে বন্ধক হিসাবে গচ্ছিত সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়া সত্ত্বেও কিছু বলেননি, তাঁরা সবাই এই দুর্নীতির জন্য দায়ী। ঝে়ড়ে ফেলতে চাইলেই কি আর এই দায় ঝেড়ে ফেলা যায়?
শুধু নীরব মোদীর দুর্নীতির ক্ষেত্রেই নয়, দেশ-বিদেশের বহু ব্যাংক সংক্রান্ত দুর্নীতির পিছনেই রয়েছে সময়ে সাবধান না হয়ে গা ভাসিয়ে দেওয়ার আখ্যান। কেউ ঋণ নেওয়ার পর যতক্ষণ সময়ে কিস্তি শোধ করেন, ব্যাংক তাঁর দিকে বিন্দুমাত্র নজর দেয় না। আমি ভাঙা বাড়িকে রাজপ্রাসাদ বলে চালিয়ে দিচ্ছি, কিন্তু সময়ে কিস্তি মিটিয়ে চলেছি— ব্যাংক খোঁজও নেবে না, আমি যেটাকে রাজপ্রাসাদ বলছি, আসলে তার অবস্থা কেমন।
এর পাশাপাশিই রয়েছে আর এক বিষাক্ত ট্র্যাডিশন। ওপরমহল থেকে কেউ ব্যাংক কর্তাকে একটি ফোন করে বলবেন, কোনও এক নির্দিষ্ট ব্যবসায়ীকে তাঁর চাহিদা অনুযায়ী ঋণ দিয়ে দিতে। ব্যাংকের অফিসার রাজি না হলে তাঁর জন্য বরাদ্দ শাস্তি। আর সেই ভয়ে ঋণ দেওয়ার পর দেনাদার যদি গায়েব হয়ে যান, তবে ফোনের ওপারে থাকা কর্তাটি ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন আর্থিক দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন, এমন এক জন লোকের কথা জানি, যাঁর বাড়িতে এক কালে সর্বধর্মসমন্বয়ের মতো সব দলের নেতারা পাত পেড়ে নেমন্তন্ন খেতেন।
তবে, শুধু ওপরমহলকে দোষ দিলেই হবে না। ব্যাংকের দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে। নোটবাতিলের সময় বিভিন্ন ব্যাংক যে ভাবে বিপুল পরিমাণ কালো টাকার রূপান্তর ঘটিয়েছিল, সেই কথা ভাবুন। আসল প্রয়োজন ব্যাংকিং ব্যবস্থার কাঠামোগত পরিবর্তন। যেমন, যে সম্পদ বন্ধক রেখে ব্যাংক ঋণ দিচ্ছে, মাঝে মাঝেই তার যথার্থ মূল্যায়নের জন্য অডিট হওয়া প্রয়োজন। কোনও একটি অডিট রিপোর্টের ওপর ভরসা করলে চলবে না— সর্ষের মধ্যে ভূত তো সামান্য ব্যাপার, এখন ভারতে ভূতের চোটে সর্ষেই খুঁজে পাওয়া দায়। খুব ভাল ঋণ পরিশোধ করছে, এমন ব্যবসার ক্ষেত্রেও এই নজরদারি প্রয়োজন। একটি মালিকানার দুটি সংস্থার মধ্যে একটি প্রচুর লাভ করছে, আর অন্যটি ক্ষতিতে ডুবে আছে— এমন ক্ষেত্রে লাভজনক সংস্থাটিকে অন্য সংস্থাটির দায়ের অন্তত একটি অংশের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা উচিত।
স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতে ব্যাংককে ফাঁকি দেওয়ার বেশ কিছু বড় ঘটনা ঘটেছে। সেগুলোর কথা আমরা জানি। কিন্তু, ঠিক কী কারণে বারবার এই গোত্রের তছরুপ সম্ভব হচ্ছে, তা নথিবদ্ধ করার কোনও উদ্যোগ আজ অবধি চোখে প়ড়ল না। এই বিপদ থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ কী, সেই প্রসঙ্গেও লোকসভা-রাজ্যসভায় আলোচনা হয় না। একটা বড় সমস্যা হল, যে কোনও নতুন ব্যবস্থার প্রতিই ভারতের শাসনতন্ত্রের অনীহা সুতীব্র। একটা উদাহরণ দিই। গোটা দুনিয়াতেই এখন অক্শন বা নিলাম ব্যবস্থার জয়জয়াকার। তার তত্ত্ব বিশ্লেষণ করে নোবেল পুরস্কার পেলেন পণ্ডিতরা। বিভিন্ন দেশের সরকার নিলামের মাধ্যমে প্রচুর রাজস্ব সংগ্রহ করছে। অথচ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক সমাজ বা আমলাতন্ত্র সেই নিলাম ব্যবস্থার দিকে ফিরেও তাকাল না। শেষ অবধি, হরেক দুর্নীতির ধাক্কায় নিলাম ব্যবস্থাকে প্রয়োগ করার আদেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট।
ধরুন, একশো টাকা অনাদায়ী ঋণ রয়েছে। সে ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নটাই হওয়া উচিত, যে সম্পদ বন্ধক হিসাবে ব্যাংকের কাছে গচ্ছিত রয়েছে, অনাদায়ী ঋণের কত অংশ সেই বন্ধকের প্রকৃত মূল্যায়ন না হওয়ার ফল। ধরা যাক, মূল্যায়নের ফলে দেখা গেল, বন্ধক থাকা সম্পদের মূল্য ৫০ টাকা। সেই টাকাটা তো ব্যাংকের পক্ষে আদায় করে নেওয়া সম্ভব। তা হলে অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে অবশিষ্ট ৫০ টাকায়। অর্থাৎ, মূল প্রশ্ন হল, ঋণ মঞ্জুর করার আগে বন্ধকি সম্পদের যথাযথ মূল্যায়ন করা, এবং প্রয়োজন পড়লে কত দ্রুত সেই সম্পদ বেচে ব্যাংক ঋণের টাকা পুনরুদ্ধার করতে পারে, তার বিশ্লেষণ। এটাই নীতি হওয়া উচিত। কোনও ঋণ অনাদায়ী হয়ে গেলে প্রশ্ন করা উচিত, সম্পদের মূল্যায়ন কতখানি ঠিক ভাবে হয়েছিল। কেন তা উদ্ধার করা গেল না, তা বিশ্লেষণ করে দোষ কার, নির্ধারণ করা উচিত। এবং, এই প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ হওয়া বিধেয়। কিন্তু, এটা একটা নতুন গোত্রের নীতি। আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সেই নীতিকে গ্রহণ করার মতো নমনীয় হতে পারবে, সেই ভরসা কম।
অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের আমলে দেশে যখন আর্থিক সংস্কারের কাজ আরম্ভ হল, তখন স্থির হয়েছিল, রফতানিকারকদের অহেতুক হেনস্তাজনিত ক্ষতি ঠেকাতে হবে। তার জন্য সিদ্ধান্ত হল, অহেতুক হেনস্তা করছেন, এমন আমলা বা কর্মচারীর নাম ও পদের তথ্য সরকারি ভাবে একটি কাগজে নথিভুক্ত করা হবে। ব্যাংকের ঋণের ক্ষেত্রেও তেমন একটি নীতি চালু হলে মন্দ হয় না। কেউ কাউকে ঋণ দেওয়ার জন্য সুপারিশ করলে ঋণের ফর্মেই যাতে তাঁর নাম নথিভুক্ত করা যায়, সেই ব্যবস্থা করা হোক। সেই ফর্মের প্রতিলিপি সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাঠাতে হবে। প্রশ্ন করতেই পারেন, সুপারিশ না করলেও তো ফর্মে নাম তুলে দেওয়া যায়। সে বেলা কী হবে? সহজ সমাধান— তাঁর কাছেও তো ফর্মের প্রতিলিপি যাবে, তিনি পত্রপাঠ আপত্তি করলেই হল। কিন্তু, ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি করব, অথচ কোনও দায় নেব না, এটা চলতে দেওয়া যায় না। এই প্রবণতা ঠেকানোর সৎ সাহস না দেখানোর অর্থই হল দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়া।
পুনশ্চ: আমি ব্যাংকে টাকা রাখি। ব্যাংক সেই টাকা ধার দেয়। কাজেই, আমি ব্যাংকের মহাজন। কিন্তু, ব্যাংকের, এবং আনুষঙ্গিক মহাদুর্নীতির কারণে ঋণ হিসাবে সেই টাকার ঝুঁকি অনেক বেড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ, আমার লগ্নির ঝুঁকি প্রচুর। কাজেই, ব্যাংকের থেকে আমার অনেক বেশি সুদও পাওয়া উচিত। কিন্তু, সেই সুদ আমি পাই না, কারণ ব্যাংক বিপাকে প়ড়লে সরকার তাকে উদ্ধার করবে, সেই ভরসা আছে। অন্তত, ছিল। এফআরডিআই বিলটির খস়ড়ায় আমার টাকা চোট যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ার ব্যবস্থা পাকা। তার সঙ্গে আছে নীরব-দুর্নীতির মতো কাণ্ড। এই অবস্থায় ব্যাংকে সুদের হার কমানোর নীতি অত্যন্ত অন্যায্য।
সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy