—ফাইল চিত্র।
মুই ইয়াতে তোকে তাল্লাক লিখ্যা দিছি, তাল্লাক-তাল্লাক- তাল্লাক।’ মুহূর্তে মাটিতে বসে পড়ে কপালে করাঘাত করতে করতে অভিমানে রহিমের বুকে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে ফুপিয়ে ফুলজান বলেছিল, ‘রাগ করি এমন কাম কল্লু।’ শেষ পর্যন্ত সমাজের মাতব্বর-শাস্ত্রের নিয়মে পড়ে দু’জন অপাপবিদ্ধ দম্পতির জীবনে নেমে এসেছিল চরম ট্র্যাজেডি। তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তার’ নাটকের সেই দৃশ্য আজও অমলিন।
‘তালাক’ শব্দের আভিধানিক অর্থ বন্ধন মুক্ত করা। আর ইসলামের পরিভাষায় স্ত্রীকে বিবাহ বন্ধন থেকে মুক্ত করা। এখানে ‘বন্ধন মুক্তি’র কথা থাকলেও তা আদতে বল্গাহীন মুক্তির স্বাদ এনে দেয় না, বরং নিত্য প্রেম, ভালবাসাময় জীবনে কখনও তা বিরহ বিচ্ছেদের হৃদয়স্পর্শী শোকগাথায় পরিণত হয়।
একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার (যারা শুধু নির্যাতিতা ও তালাকপ্রাপ্ত মহিলাদের নিয়ে কাজ করে) সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ‘তালাকপ্রাপ্ত’ মহিলাদের নিয়ে কিছু কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ‘তালাকে’র কতগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ করেছি। প্রথমত, ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ হয় নিম্নবিত্ত পরিবারে। সেই পরিবারের পুরুষেরা সে ভাবে ধর্মপালন করেন না, ধর্মের সাধারণ জ্ঞানটুকুও তাঁদের জানা নেই। ‘তিন তালাক’ কী, কখন কী ভাবে দিতে হয় সে সম্পর্কে কোনও ধারণাই তাঁদের নেই। পণের টাকা না পাওয়া, শ্বশুরবাড়ির সামান্য ভুল-ভ্রান্তি, স্ত্রীকে পছন্দ না হওয়া, সংসারে মন না থাকা— এ সব থেকেই ‘তালাক’। ওঁদের ‘তালাক’ দেওয়ার সময় ধর্ম থাকে না, ধর্ম এসে জড়ায় পরে।
দ্বিতীয়ত, ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’ হয় রাগের মাথায়। সংসারের অভাব, অনটন, একান্নবর্তী পরিবারের নিত্য কলহ, বৌ-মা-ভাই-বোনের সংসারে পারস্পরিক টানাপড়েন, ভুল বোঝাবুঝি, একরাশ হতাশার মিলিত ফল ঝোঁকের মাথায় ‘তালাক-তালাক-তালাক’। যেন তালাক দিলেই তাঁর মুক্তি। কিন্তু, যখন সব রাগ আর হতাশাকে পাশে রেখে সন্ধেয় স্বামী স্ত্রী, সন্তানদের বুকে নিয়ে সুখ-দুঃখের গল্প খোঁজেন, তখনই মাতব্বরেরা এসে বাধা দেন— ‘তোদের না
তালাক হইছে।’ সমাজে এমন বহু দম্পতির খবর পাওয়া যাবে যাঁদের সংসারে স্রেফ রাগের মাথায় স্বামী স্ত্রীকে ‘তিন তালাক’ দিয়েছেন। সমাজ বা মতব্বরের কানে কথাটা ওঠেনি বলে তাঁদের সংসারটা আর ভাঙেনি। স্বামী-স্ত্রী নিজেদের মধ্যে জমে থাকা হাজারও অভিমান আর অভাব, অভিযোগের কথা বলে চোখের জলে সব মুঝে দিয়ে নতুন করে সংসার শুরু করেছেন।
তৃতীয়ত, দশ থেকে পনেরো শতাংশ ‘তালাকে’র ক্ষেত্রে থাকে ‘পরকীয়া’। এটা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রেই ঘটে। চতুর্থত, ২০ থেকে ২৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ‘তালাকে’র সঙ্গে জড়িয়ে থাকে স্বামীর পরিবার, তাঁর বাবা, মা, বোন। বৌ পছন্দ না হওয়া, তাঁদের পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারা, পণের সম্পূর্ণ টাকা আদায় করতে না পারা, আভিজাত্যের অহঙ্কার, শিক্ষিত বৌমার ব্যক্তিস্বাধীনতা, চাকরি বা স্বনির্ভরতার দ্বন্দ্ব এবং এ সব কারণেও সেই ‘তালাক’।
ইসলামে ‘তালাকে’র একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি থাকলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তা মেনে তালাক দেওয়া হয় না। আমরা যে তালাক দেখি বা যে ‘তালাক’ নিয়ে আলোচনা করি তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ‘তাৎক্ষণিক তিন তালাক’। যার সঙ্গে ধর্মের খুব একটা সম্পর্ক নেই বলেই জানি। ইসলামে ‘তালাক’ একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া যা কিছু দিন ধরে একটি সুনির্দিষ্ট সময় ও নিয়মের মধ্য দিয়ে শেষ করতে হয়। এই সময়ের মধ্যে স্বামী ও স্ত্রী দু’জনেরই নিজেদের শুধরে নেওয়ার সময় ও সুযোগ থাকে। এটা এক ধরনের কৃচ্ছ্রসাধনা। এখানে স্বামী ও স্ত্রী দু’জনের সেই ক্ষমতা আছে। স্বামীদের ক্ষেত্রে তা ‘তালাক’, স্ত্রীদের ক্ষেত্রে তা ‘কুলা’। ‘তাৎক্ষণিক মৌখিক তালাক’-এ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় ‘তালাকপ্রাপ্ত’ মেয়েটি। এখনও পর্যন্ত আমাদের সমাজে মেয়েদের সে ভাবে নিজেদের ঘর তৈরি হয়নি। শৈশবে বাবার ঘর, যৌবনে স্বামীর ঘর আর বার্ধ্যকে ছেলের ঘর ছাড়া আমাদের সমাজে মহিলাদের নিজের কোনও ঘর নেই। ফলে এক জন তালাকপ্রাপ্ত মহিলাকে সন্তান কোলে শেষে ‘শৈশবের বাবার ঘরে’ই ফিরে যেতে হয়। বাবা-মায়ের অবর্তমানে বহু তালাকপ্রাপ্ত মহিলা নীরবে হারিয়ে যান।
মুসলিম মহিলাদের দাবি ও অধিকার রক্ষার লড়াইটি প্রথম থেকেই ছিল অরাজনৈতিক। কিন্তু, সরকার সবসময় একে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে। ১৯৮৬ সালে খোরপোষের দাবি জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলেন সাহবানু। ১৯৮৬ সালে সুপ্রিমকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায়ের মাধ্যমে মুসলিম মহিলাদের খোরপোষ পাওয়ার অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দেয়। সে দিন মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের তীব্র বিরোধিতার চাপে পড়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধী সে বছর মে মাসে পার্লামেন্টে আইন পাশ করে সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়কে নাকচ করে দেন। মুসলিম মহিলাদের আইনি সুরক্ষার দাবির ইতিহাসে সে দিনই প্রথম পেরেক পুঁতে দেওয়া হয়েছিল।
আজ আবার একটি মাহেন্দ্রক্ষণ। মুসলিম মহিলাদের যেটুকু দাবি আদায় হয়েছে তা তাঁদের দীর্ঘ দিনের অনমনীয় ও সাহসী আন্দোলনের ফল। কিন্তু, তাঁদের অন্য দাবির কিছুই পূরণ হয়নি। তাঁরা চেয়েছিলেন, ‘তালাক’ প্রথার বিলোপ। তা হয়নি। তাঁরা চেয়েছিলেন, ‘আইনি সুরক্ষা’। সেটাও দেওয়া হয়নি। তাঁরা চেয়েছিলেন, ‘তালাক’ হোক আদালতে। এই আইনে তারও কোনও কথা বলা নেই। বদলে ‘তালাক’দানকারী ব্যক্তির তিন বছরের জেলের নিদান দেওয়া হল। তাতে তালাকপ্রাপ্ত মেয়েটির খুব একটা সুবিধা হবে কি?
তিন বছর জেল খেটে এসে ছেলেটি আইনের দিক থেকে মুক্ত। মেয়েটির সামজিক সম্মান, তাঁর নিজের ও ছেলেমেয়েদের খোরপোষ দেবে কে? এই আইনে নির্দিষ্ট সেই সংস্থান কই? ‘তালাক’ সতত সংসার ছেদনকারী। আবার কখনও তা আত্মরক্ষার অস্ত্রও হয়ে ওঠে। ‘ছেঁড়া তার’ নাটকে জীবন রক্ষা করতে গিয়ে রহিম ‘তালাক’কে শ্রেণি সংগ্রামের হাতিয়ার করে তুলেছিল। কিন্তু, শেষরক্ষা হয়নি। তাই দেখতে হবে, সমাজ, বিধান, আর রাষ্ট্রের চাপে পড়ে সমাজের আরও ফুলজানদের জীবন যেন নষ্ট না হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy