Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪

‘বৃহদারণ্য বনস্পতির মৃত্যু দেখেছ কেউ?’

খবর এল, সব শেষ। রবি অস্তমিত। এক টুকরো কাগজ আর রং নিয়ে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁকে ফেললেন, জনসমুদ্রের মাথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষযাত্রা। লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৯ ০২:৩৫
Share: Save:

ক’দিন ধরেই মন ভাল নেই কারও। বাংলাদেশের অখ্যাত পল্লি থেকে বিখ্যাত নগর, সর্বত্র একটাই আলোচনা— তাঁর অসুস্থতা। আকাশবাণী থেকে তাঁর স্বাস্থ্যবার্তা প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু সেখানে আশার কথা কই! আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছে তামাম বাংলাদেশ।

অবশেষে এল শ্রাবণের সেই দিন। দুপুর হতে না হতেই সারা বাংলা নিমজ্জিত হল শোকের সাগরে। প্রতিভা বসু লিখেছেন, ‘‘প্রতিটা সাহিত্যিকের একইদিনে পিতৃবিয়োগ ঘটলো।’’ কিন্তু কী ভাবে সে দিনটা কাটালেন তাঁরা?

অন্য দিনের মতো সেদিনও ঠিক সময়েই ঘুম থেকে উঠেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। কিছু একটা আজ ঘটবে সেটা বোধহয় আঁচ করেছিলেন। তাই প্রায় সকাল থেকেই সে দিন জোড়াসাঁকোর পাঁচ নম্বর বাড়ির উত্তরের বারান্দায় বসে ছ’নম্বর বাড়ির দিকে তাকিয়েছিলেন তিনি। তাঁর প্রিয় রবিকা চলে যাওয়ার পথে। স্বভাবতই মনখারাপ। দু’বাড়ির মাঝখানে অগণিত মানুষ রুদ্ধনিশ্বাসে অপেক্ষমাণ। অবনীন্দ্রনাথ অপলকে চেয়েছিলেন সে দিকে।

এর মধ্যে এক জন এসে বলে গেল, ‘‘স্নান করে নিন, খেয়ে নিন।’’ কিন্তু কিছুতেই যেন গা নেই রবিকার প্রিয় ভাইপোটির। তবে এক সময় উঠতেই হল। স্নান করলেন, খেলেন। খেয়ে বেতের চেয়ারটায় বসে পান মুখে দিতে যাবেন, এমন সময় খবর এল, সব শেষ। রবি অস্তমিত। পান খাওয়া আর হল না। এক টুকরো কাগজ আর রং নিয়ে এঁকে ফেললেন, জনসমুদ্রের মাথায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষযাত্রা।

রবীন্দ্রনাথের অসুস্থতা ঘিরে ক’দিন ধরে বসু পরিবারেও ছিল মন-উচাটন ভাব। এই তো সে দিন, সবাই মিলে গ্রীষ্মের ছুটি কাটিয়ে এলেন শান্তিনিকেতনে। অসুস্থ শরীরেও কত কথা বললেন, বুদ্ধদেব ও প্রতিভা বসুর সঙ্গে। নিজের লেখা গানও শুনলেন এক কালের ডাকসাইটে গায়িকা রানু সোমের (প্রতিভা বসুর অন্য নাম, যে নামে গায়িকা হিসাবে তাঁকে এক কালে একডাকে চিনত বাংলাদেশ) কাছে।

যদিও ফেরার সময় ভাল দেখে আসেননি বলে ট্রেনে সারাটা রাস্তা সে দিন প্রায় নীরব ছিলেন প্রতিভা-বুদ্ধদেব দু’জনে। তবুও ক্ষীণ হলেও আশা একটা ছিল যে, আবার সেরে উঠবেন কবি। ঘটনার দিন বাড়িতে প্রতিভা বসুর কাছে খবর নিয়ে এল তাঁদের ছ’বছরের মেয়ে মীনাক্ষী। তাড়াতাড়ি স্কুল ছুটি হয়ে গিয়েছে। সে জেনেছে তাঁর কারণ। শান্তিনিকেতনের স্মৃতি এখনও তার টাটকা। স্কুল থেকে কাঁদতে কাঁদতে এল সে।

আর বুদ্ধদেব? তাঁর ভাষায়, ‘‘মেঘলা ছিলো সেই দিন, বৃষ্টিহীন। আমার মন সকাল থেকেই উন্মন। রিপন কলেজের জন্য বেরিয়েও অন্যটানে চলে এলাম চিৎপুর পাড়ায় বেলা তখন এগারোটা হবে হয়তো।’ তখনও তেমন ভিড় জমেনি জোড়াসাঁকোর ছ’নম্বর বাড়ির আঙিনায়। বুদ্ধদেব সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলেন তেতলায়। সেখানে বারান্দায় অনেক লোক ছড়ানো-ছিটোনো। বুদ্ধদেবের চেনা মুখও অনেক। কিন্তু কারও চোখেই কোনও ভাষা নেই, কারও মুখে কথা ফুটছে না। বুদ্ধদেব লিখছেন, ‘‘ধীরে কাটছে মিনিটের পর নিঃশব্দ মিনিট নিশ্চিতের অপেক্ষায়; হঠাৎ দেখলাম আমার সামনে অমিয় চক্রবর্তী; চোখের কোণ মুছে তিনি বললেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আর নেই, একটা shell পড়ে আছে।’ কিছুক্ষণ পরে বেলা দুপুর পেরিয়ে গেছে তখন ভেসে এলো কোনো নেপথ্য থেকে চাপা একটা আর্তনাদ। একটাই মাত্র। জানি না ভক্তসেবক নীলমণির কিনা। অনেকে তাঁদের হাতঘড়িতে চোখ ফেললেন। চারদিকে চাঞ্চল্য

ছড়িয়ে পড়ল।’

এক বছর ছিলেন শান্তিনিকেতনে পড়াবার কাজে। সেই স্মৃতি অশেষ যত্নে সারাজীবন বহন করেছিলেন লীলা মজুমদার। মহাপ্রস্থানের ক্ষণটিতে উপস্থিত হয়েছিলেন তিনিও। ‘কবিকে যদি দেখতে চান, এখনি আসুন’— টেলিফোন পেয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রথমে একটু দ্বিধাই ছিল। একে তো বাড়ির গাড়ি নিয়ে স্বামী গিয়েছিলেন বাটানগর হাসপাতালে। তার উপরে মনে হচ্ছিল, কবির অপরূপ রূপ মানসপটে আঁকা, কী ভাবে দেখবেন তাঁর রোগক্লিষ্ট চেহারা! দোলাচল কেটে গেল বাল্যবন্ধু পূর্ণিমা ঠাকুরের ফোন পেয়ে, ‘একবার এসে দেখে যা কি সুন্দর!’ পরিচিত একজনের গাড়িও পাওয়া গেল দৈবক্রমে। চলে এলেন জোড়াসাঁকো। লীলা মজুমদারের স্মৃতিচারণ, ‘‘আমি পায়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মুখের দিকে আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম। কি সুন্দর। কি শান্ত। হঠাৎ ডাক্তার অক্সিজেনের নল নামিয়ে রেখে নাড়ি থেকে হাত তুলে দুহাতে নিজের মুখ ঢাকলেন। চেয়ে দেখি বুকটা আর উঠছে-পড়ছে না। তিনি চলে গেছেন।’’

ঘটনার দিন কলকাতায় মেসেই ছিলেন বিভূতিভূষণ। সকালে উঠে বসেছিলেন লেখাপড়া নিয়ে। এমন সময় পরিচিত একজন এসে জানালেন, রবীন্দ্রনাথ আর নেই। লেখাপড়া ফেলে চলে গেলেন জোড়াসাঁকো। কিন্তু বেজায় ভিড়ে ঢুকতে পারলেন না। তবে শুনলেন, এখনও তিনি রয়েছেন। তবে অবস্থা সঙ্কটজনক। ফিরে এলেন। এসে গেলেন স্কুলে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখানে এসে পৌঁছল কবির প্রয়াণ-সংবাদ। স্কুল ছুটি হয়ে গেল। ছাত্র শিক্ষকদের সঙ্গে চললেন দল বেঁধে। কলেজ স্কোয়ার দিয়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালেন গিরীশ পার্কের কাছে।

বিভূতিভূষণ লিখছেন, ‘‘পরলোকগত মহামানবের মুখখানি একবার মাত্র দেখবার সুযোগ পেলুম সেনেটের সামনে। তারপর ট্রেনে চলে এলুম বনগাঁ। শ্রাবণের মেঘনির্ম্মুক্ত নীল আকাশ ও ঘন সবুজ দিগন্ত বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেতের শোভা দেখতে দেখতে কেবলই মনে হচ্ছিল-গগনে গগনে নব নব দেশে রবি/নব প্রাতে জাগে নবীন জনম লভি।’’

১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই শুক্রবার কবিকে অস্ত্রোপচারের জন্য আনা হয়েছিল কলকাতায়। আর ২৬ জুলাই দুপুরে সজনীকান্ত দাস সুধাকান্ত রায়চৌধুরীর কাছ থেকে টেলিফোনে ব্যাকুল আহ্বান পেলেন, ‘‘যদি কবিকে সজ্ঞানে দেখতে চান, এক্ষুনি আসুন।’’ সজনীকান্তের উপর কবির বিরূপতা অনেকদিন আগেই তিরোহিত হয়েছে। সজনীকান্ত এখন কবির কাছের লোক। টেলিফোন পেয়েই তিনি ছুটলেন। তার পরে কবির কাছে উপস্থিত হয়ে প্রণাম করতেই কবি তাঁকে বসতে বললেন। অবনীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ তুলে বললেন ৭ অগস্ট তাঁর জন্মদিনটা সবাই যেন ঘটা করে পালন করে। বিদায় নেওয়ার সময় সজনীকান্ত বললেন, ‘‘শিগগির ভালো হয়ে উঠুন।’’ কবির মুখে ম্লান হাসি, ‘‘সেটা কি আমার ইচ্ছের উপর নির্ভর করছে!’’ সজনীকান্ত শেষ চারদিন কবির আশেপাশেই ছিলেন। সব প্রত্যক্ষ করেছেন কাছ থেকে। সজনীকান্ত লিখেছেন, ‘‘শেষের তিনদিন তিনি সজ্ঞানে ছিলেন না। সব শেষ হইলে যখন বাড়ি ফিরিলাম আমারও প্রায় সংজ্ঞা ছিল না। একটা অসহ্য অব্যক্ত ব্যথায়

মুহ্যমান ছিলাম।’ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর অব্যবহিত পরে সজনীকান্ত তাঁর তিরোধানের বেদনা নিয়ে লিখলেন দীর্ঘ এক কবিতা—‘মর্ত্য হইতে বিদায়’। প্রথম লাইন ‘বৃহদারণ্য বনস্পতির মৃত্যু দেখেছ কেউ?’

শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল

ঋণ: ‘উৎকর্ণ’/ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। ‘দক্ষিণের বারান্দা’/মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। ‘পাকদন্ডী’/ লীলা মজুমদার। ‘আত্মস্মৃতি’/ সজনীকান্ত দাস। ‘জীবনের জলছবি’/ প্রতিভা বসু। ‘আমাদের কবিতাভবন’/ বুদ্ধদেব বসু

অন্য বিষয়গুলি:

Death Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy