Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
Editorial News

এমন বিপজ্জনক আয়োজন এ রকম অবাধে চলে কী করে?

গোটা রাজ্যকে চমকে দিয়েছে একটি খবর। শহর লাগোয়া এক পৌর এলাকার ভাগাড় থেকে মৃত পশুর দেহ তুলে এনে পাঠিয়ে দেওয়া হত মাংস হিসেবে। কলকাতার বিভিন্ন রেস্তরাঁয় ঢুকে পড়ত এই সব মাংস।

রেস্তরাঁয় চড়া দামে খাবারের নামে এমন ভয়ঙ্কর বিপদ পরিবেশিত হয় এমনটা ভেবে শিউরে উঠছেন অনেকে।  —ফাইল চিত্র।

রেস্তরাঁয় চড়া দামে খাবারের নামে এমন ভয়ঙ্কর বিপদ পরিবেশিত হয় এমনটা ভেবে শিউরে উঠছেন অনেকে। —ফাইল চিত্র।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৮ ০০:৪৩
Share: Save:

নিজেকে নিরাপদ বোধ করার অধিকার কি আদৌ রয়েছে নাগরিকের? একটা সরকার রয়েছে মাথার উপরে, নাগরিকের ভাল-মন্দের খেয়াল সর্বক্ষণ রাখার জন্য একটা অতন্দ্র প্রশাসন রয়েছে— এমনটা ভাবার অধিকার কি আমাদের রয়েছে? সুস্থ-সবল ভাবে এবং সসম্মানে বাঁচার সংজ্ঞা খুঁজি আমরা যে সব পরিসরে, সেই সব পরিসরের সঙ্গে যখন মিলে-মিশে একাকার হয়ে যায় কোনও অস্বাস্থ্যকর, পূতিগন্ধময় ভাগাড়, তখন এই প্রশ্নটা না করে আর কোনও উপায় থাকে না।

গোটা রাজ্যকে চমকে দিয়েছে একটি খবর। শহর লাগোয়া এক পৌর এলাকার ভাগাড় থেকে মৃত পশুর দেহ তুলে এনে পাঠিয়ে দেওয়া হত মাংস হিসেবে। কলকাতার বিভিন্ন রেস্তরাঁয় ঢুকে পড়ত এই সব মাংস। রেস্তরাঁর রসুই থেকে তা চলে আসত আমার-আপনার সামনে রাখা বহুমূল্য ধূমায়িত প্লেটে। এ খবরে বমনেচ্ছা জাগবে না, এমন মানুষ কমই আছেন। খবরটি পড়ামাত্র প্রায় প্রত্যেকে ভাবতে শুরু করেছেন, কবে শেষ বার রেস্তরাঁয় খেয়েছেন এবং কী খেয়েছেন। শহরের রেস্তরাঁয় চড়া দামে খাবারের নামে এমন ভয়ঙ্কর বিপদ পরিবেশিত হয়, অনেকেই এমনটা ভাবতে পারছেন না অথবা ভেবে শিউরে উঠছেন।

মৃত পশুর দেহ ভাগাড় থেকে তুলে এনে তাকে মাংস হিসেবে হোটেলে-রেস্তরাঁয় সরবরাহ করে দেওয়া কোনও স্বাভাবিক এবং পরিচিত ঘটনা নয়। অত্যন্ত অস্বাভাবিক ঘটনা। যত দিন না বিষয়টি ধরা পড়ল, তত দিন কল্পনাও করা কঠিন ছিল যে, অপরাধ এ রকম চেহারাও নিতে পারে। কিন্তু অপরাধ যতই অস্বাভাবিক হোক, প্রশাসনের তরফ থেকে অতন্দ্র নজরদারি থাকা উচিত নয় কি?

সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন

কিছু দিন আগে আমরা শুনলাম, ফর্মালিনে চোবানো মরা মুরগি সরবরাহ করা হচ্ছে হোটেলে-রেস্তরাঁয়। এ বার জানা গেল, ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া মৃত পশু উঠে আসছে খাবারের প্লেটে। এর পর আরও কী কী শুনতে হতে পারে, ভাবতেই ইচ্ছা করছে না আর। ভেজাল এবং বিপজ্জনক ‘খাবার’ সরবরাহ করাই যে এক শ্রেণির অসাধু কারবারির ব্যবসা, সে কথা তো প্রশাসনের অজানা নয়। তাই ভেজাল এবং নিম্নমানের খাবার সরবরাহ রুখতে প্রশাসনের কোনও একটি নজরদারি বন্দোবস্ত থাকবে এমনটা তো অবশ্যই প্রত্যাশিত। নজরদারির সেই বন্দোবস্তটুকু থাকলেই তো ফর্মালিনে চোবানো মুরগি বা ভাগাড়ে পড়ে থাকা পশুর দেহ খাবারের প্লেটে উঠে আসার পথ খুঁজে পায় না। কেন নেই সেই বন্দোবস্ত? প্রশ্নটা উঠবেই।

নাগরিককে সুস্থ, স্বাভাবিক, বিপন্মুক্ত জীবনযাপনের সুযোগ দেওয়া প্রশাসনের প্রাথমিক কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। উন্নত বিশ্বে চোখ রাখলে সেই ব্যবস্থাপনার আদর্শ প্রতিফলন দেখা যায়। ভারত এখনও উন্নত বিশ্বের অঙ্গ নয়, ভারত এখনও উন্নয়নশীল, সে কথা আমরা জানি। কিন্তু উন্নতির দিকে অগ্রসর হওয়াই যদি লক্ষ্য হয়, তা হলে শুধু অর্থনৈতিক অগ্রগতি নিয়ে ভাবলেই চলবে না, উন্নত বিশ্বের প্রশাসনিক সূচকগুলোর প্রতিফলনও নিজেদের মধ্যে খুঁজতে হবে। এ দেশে সে প্রচেষ্টা কতখানি শুরু হয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ বিস্তর।

আরও পড়ুন
প্রশাসনের নজরদারির করুণ দশা, মৃত পশুর মাংস কিনত কসাইখানাও

মরা মুরগি ফর্মালিনে চুবিয়ে রাখা হচ্ছে বা ভেজাল খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে বা ভাগাড় থেকে মৃত পশু তুলে এনে তার মাংস রেস্তরাঁয় পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে— এই ঘটনাগুলোর একটিও প্রশাসন কর্তৃক আবিষ্কৃত হয়নি। হয় সাধারণ নাগরিক একে চিহ্নিত করেছেন। অথবা মিডিয়ার মাধ্যমে এই বিপদের খবর সামনে এসেছে। পরিস্থিতিটা এই রকম হবে কেন? প্রশাসনের চোখ-কান বা পঞ্চেন্দ্রিয় এত অসাড় হবে কেন যে, চারপাশে এত রকমের বিপজ্জনক আয়োজন অবাধে ঘনিয়ে উঠতে পারবে? প্রশাসনিক ব্যর্থতা বা পঙ্গুত্বের কারণেই যে এই ধরনের বিপজ্জনক অসাধুতার এত বাড়বাড়ন্ত, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।

আইনের শাসনই যে শেষ কথা, অপরাধ করলে যে ধরা পড়তে হবে এবং কঠোর পদক্ষেপের মুখোমুখি হতে হবে, আমাদের দেশে অপরাধীদের মধ্যে বা অপরাধপ্রবণদের মধ্যে সেই উপলব্ধিটা প্রায় নেই বললেই চলে। প্রশাসনকে বিন্দুমাত্র ভয় পেলে দিনের পর দিন এমন বিপজ্জনক কারবার চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। কোথাও একটা শিথিলতা রয়েছে। সেই প্রশাসনিক শৈথিল্যের বিষয়টা দুষ্কৃতীদের মধ্যে সুবিদিতও রয়েছে। তাই কেউ ভেজাল খাবার সরবরাহ করেন, কেউ ভাগাড় থেকে মৃত পশু তুলে আনেন, কেউ বোমা-বন্দুক হাতে রাস্তায় দাপিয়ে বেড়ান, কেউ নির্বাচনে বিরোধী দলকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেন, কেউ খুন-জখমকে সাধারণ ঘটনা ভেবে নেন। দুষ্কৃতীদের মধ্যে এই বেপরোয়া হয়ে ওঠার প্রবণতা প্রশাসনিক ব্যর্থতার অত্যন্ত স্পষ্ট সূচক। প্রশাসন তথা আইন-কানুনের প্রতি ন্যূনতম সমীহ থাকলে এ ভাবে প্রতিটি পরিসরে দাপিয়ে বেড়াতে পারে না দুষ্কৃতীরা। আয়নার সামনে দাঁড়ানো উচিত আমাদের প্রশাসককুলের। নাগরিকের জন্য সুস্থ, স্বাভাবিক, বিপন্মুক্ত জীবন সুনিশ্চিত করার দায়িত্ব তারা কি আদৌ পালন করছেন? ভেবে দেখা উচিত।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE