কালিম্পঙে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চেতনা আচ্ছন্ন, কথা বন্ধ। বাড়িতে পুত্রবধূ প্রতিমাদেবী আর বন্ধুকন্যা মৈত্রেয়ীদেবী। দার্জিলিং থেকে এক সাহেব সার্জন এসেই হাঁকাহাঁকি জুড়ল, গরম জল করো, পাত্র স্টেরিলাইজ করো। অপারেশন করতে হবে। সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায় না? ‘হি মে নট লাস্ট টুয়েলভ আওয়ার্স।’
এমন সংকটের মুখে মনস্থির করলেন প্রতিমাদেবী। ‘মৈত্রেয়ী, আমি শান্ত মনে ভেবে দেখলাম, এই মুহূর্তে যদি বাবামশায়ের জ্ঞান থাকত, তিনি অপারেশনে মত দিতেন না। কোনদিন তাঁর শরীরে অস্ত্রাঘাত করার মত নেই। নিজেরা যখন ভালমন্দ বিচার করতে পারছি না, এবং ফলও যখন অনিশ্চিত, তখন তাঁর মতেই চলব।’ অপারেশন হয়নি, কলকাতায় ফিরে সে যাত্রা সুস্থ হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
প্রতিমাদেবী অন্তরের নির্দেশে যে নীতি অনুসরণ করেছিলেন, আইনে তাকে বলে ‘সাবস্টিটিউটেড জাজমেন্ট টেস্ট’: রোগীর হয়ে যিনি সিদ্ধান্ত নেবেন, তিনি কর্তব্য স্থির করবেন রোগীর মত অনুসারে। ডাক্তারের নির্দেশের চেয়েও গুরুত্ব পাবে রোগীর মত। মার্কিনরা এ মত গ্রহণ করেছে। ব্রিটিশ আইন বলছে অন্য কথা। রোগীর স্বার্থের সুরক্ষাই প্রধান। চাইলে রোগীর পছন্দ-অপছন্দের খোঁজ করা যেতে পারে। কিন্তু শেষ কথা হল রোগীর ‘বেস্ট ইন্টারেস্ট।’
এই দুটিরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে নিষ্কৃতি-মৃত্যু নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। বিচারপতিরা ‘সাবস্টিটিউটেড জাজমেন্ট’ নীতি মেনেও সতর্ক করছেন, রোগীর প্রতিনিধি যেন নিজের ধারণা বা উদ্দেশ্যের দ্বারা প্রভাবিত না হন। ‘রোগী যদি সক্ষম থাকতেন তা হলে তিনি কী চাইতেন, অথবা রোগীর স্বার্থের সর্বাধিক সুরক্ষা কিসে হয়, রোগীর প্রতিনিধির কাছে (সেই বক্তব্যই) প্রত্যাশিত।’ পরবর্তী অংশে বলা হচ্ছে, আরোগ্যের আশা যখন নেই, কেবল তখনই নিষ্কৃতি-মৃত্যু ‘বেস্ট ইন্টারেস্ট’ বলে গণ্য হবে। যাতে লঘু ভাবে নেওয়া না হয়।
মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে কর্তব্য স্থির করা চিরকালই কঠিন। ধর্মের বাণী, দর্শনের তত্ত্ব চিরকাল তার পথ দেখিয়েছে। এখন দেখাচ্ছে শীর্ষ আদালতও। ২০১১ সালে অরুণা শনবাগ মামলার রায়ে রোগীর স্বাধিকার এবং নিকটজনের মতের মান্যতা স্বীকার করেছিল সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চ। কিন্তু তা পরে খারিজ হয়ে যায়। এখন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ যে রায় দিল, তাতে দ্বন্দ্বের অবকাশ রইল না।
আক্ষেপ, ঐতিহাসিক রায়টি ভেন্টিলেটর খোলা না খোলার গাইডলাইনে পর্যবসিত হয়েছে। শোরগোল উঠছে, এতে খরচ বাড়বে না কমবে? হাসপাতালের বিরুদ্ধে মামলার চান্স কমল না বাড়ল? যেন প্রতিপক্ষ খাড়া না করলে আলোচনাই অসম্ভব। অতএব অসহায় পিতা-মাতা বনাম সম্পত্তি-লোলুপ সন্তান, সর্বস্বান্ত সন্তান বনাম অর্থলোলুপ ডাক্তার, অসহায় ডাক্তার বনাম মামলাবাজ পরিবার, এমন সব ফ্রেম চলে এল। মনে হতে লাগল, কই কিছুই তো হল না। বরং আগে ‘ডু নট রিসাসিটেট’ (ভেন্টিলেটরে দেবেন না) বলে সই করলেই চুকে যেত। এখন বোর্ড বসিয়ে, কোর্টে গিয়ে, ‘কুলিং পিরিয়ড’ পার করে ভেন্টিলেটর খুলতে হবে। হ্যাপা বাড়বে বই কমবে না।
বেদনাময়, আসন্ন-মৃত্যু জীবন যাঁরা বাঁচছেন, তাঁদের যেন আর কোনও চিন্তা নেই।
নব্বই-উত্তীর্ণ এক ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সম্প্রতি। কয়েক বছর ধরে মাসে মাসে ডায়ালিসিস করাচ্ছেন। প্রতি বারই মৃতপ্রায় দশা হয়। এ-ভাবে বাঁচতে চান না। স্বগৃহে, স্বজন-পরিবৃত হয়ে চলে যেতে চান। সন্তানরা রাজি নন। এ তো আত্মহত্যা। পিতাকে মেরে ফেলা।
এমন দ্বন্দ্বে লক্ষ-লক্ষ মানুষ দীর্ণ হচ্ছেন। প্রিয়জনের কষ্ট অসহ্য, নিষ্কৃতির প্রার্থনায় সায় অসম্ভব। সংঘাত এখানে স্বার্থের নয়, বিবেকের সঙ্গে। কর্তব্যের সঙ্গে। অসুখ সারার নয়, জেনেও গায়ে হাত বুলিয়ে ওষুধ খাওয়াচ্ছেন। বেড সোরের সঙ্গে যুদ্ধ চালাচ্ছেন। যাঁরা ক্যানসারের শেষ ধাপে, যাঁদের লিভার কী কিডনি অচল, যাঁরা পার্কিনসন্সে জড়বৎ, যাঁরা অতিবৃদ্ধ, তাঁদের লড়াই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নয়। ফের হাসপাতালে যাবেন কি না, বোঝাপড়া সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে।
সুপ্রিম কোর্টের রায় থেকে কর্তব্যের দুটো সূত্র মিলছে। এক, মৃত্যু যেখানে অবধারিত এবং আসন্ন, সেখানে চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করাকে আত্মহত্যা বলা চলে না। এই দুটোরই পরিণাম মৃত্যু বটে। কিন্তু চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান রোগকে তার স্বাভাবিক পথ নিতে দেয় শুধু। যদি মৃত্যু ঘটে, তা রোগের ক্রিয়ার জন্য। রোগীর ক্রিয়ার জন্য নয়। দুই, ব্যক্তি কেমন করে বাঁচবে, তার অধিকার সম্পূর্ণই তার। সেখানে অন্যের নাক গলানোরই বরং অধিকার নেই। এমনকী সেই সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক মনে হলেও অন্যেরা তাঁকে জোর করতে পারে না।
তার মানে, আমরা যখন বৃদ্ধকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভর্তি রাখি হাসপাতালে, জীবন প্রলম্বকারী চিকিৎসা চালাতে থাকি, এমনকী তাঁকে জানতেও দিতে চাই না যে, মৃত্যু আসন্ন, তখন তাঁর অধিকার ভাঙছি। রোগীর ‘বেস্ট ইন্টারেস্ট’ তাঁর সিদ্ধান্তকে সম্মান করায়, তাঁকে আতঙ্কগ্রস্ত, যন্ত্রণাবিদ্ধ অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখাতে নয়।
তা বলে বৃদ্ধ মানুষটি মৃত্যু চাইলেই মেনে নিতে হবে? তিনি যে ভয়ে, অবসাদে, সন্তানের খরচ বাড়ানোর সংকোচে মরতে চাইছেন না, বুঝব কী করে? বোঝা সহজ নয়। তাঁর মত কী, বুঝতে সময় দিতে হবে। আত্মীয়-বন্ধু, চিকিৎসক, প্রয়োজনে সাইকোলজিস্ট, এমন নানা জনকে রাখা যায় আলোচনায়। হয়তো তাতে অবশিষ্ট জীবনের থেকে তাঁর প্রত্যাশাও স্পষ্ট হবে।
অধিকারের অন্য পিঠ দায়িত্ব। ‘লিভিং উইল’ বা আগাম ইচ্ছাপত্রকে আইন যখন মান্যতা দিচ্ছে, তখন সেই দায় সন্তানের ঘাড়ে চাপানো কেন? মৃত্যুর প্রসঙ্গ তোলা মানে মৃত্যুকামনা, দুর্ভাগ্য ডেকে আনা, এ-সব কুসংস্কারের আর জায়গা নেই। মৃত্যুর অধিকার আসলে জীবনের অধিকারের অন্তর্গত, বলেছে শীর্ষ আদালত। তা হলে মৃত্যু বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে রাখা জীবনে পালনীয় দায়িত্ব নয় কি?
ভাবতে হবে চিকিৎসা নিয়েও। স্বাভাবিক জীবনে ফেরার আশা যাঁর নেই, ক্রিটিক্যাল কেয়ার তাঁর কেন প্রয়োজন? শেষ দিনগুলো সহনীয় করার চিকিৎসা চাই। দুঃখের বিষয়, এ-দেশে ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’ বা কষ্ট উপশমের চিকিৎসা তেমন চর্চিত হয় না। বৃদ্ধদের সংখ্যা বাড়ছে, আইসিইউতে শয্যা অকুলান, খরচ দুঃসাধ্য। অথচ দিল্লির এইমস, চণ্ডীগড়ের পিজিআই হাসপাতাল, দক্ষিণ ভারতের দু’একটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া উপশমক চিকিৎসার আলাদা বিভাগ নেই। কেন? কেন নার্স, প্যারামেডিকও ট্রেনিং পাবেন না? উপযুক্ত পরিষেবা যদি না মেলে, তবে চিকিৎসা নির্বাচনে রোগীর স্বাধিকার শূন্য প্রতিশ্রুতি মাত্র।
এই রায় বদলে দিক চিকিৎসাকে। শেষ নিঃশ্বাস শান্তির হোক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy