হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। ছবি সৌজন্য: দ্বারকানাথ দাস
হেতমপুরের রাজা মহিমানিরঞ্জন রাজকার্য পরিচালনার পাশাপাশি করতেন সাহিত্যচর্চাও। গল্প কবিতা লেখার চেয়ে বীরভূমের ইতিহাস অনুসন্ধানেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। এ বিষয়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখালেখিও করতেন। এ ভাবেই কলকাতার ‘গৃহস্থ’ নামে একটি পত্রিকায় লিখলেন বীরভূমের ইতিহাস সমৃদ্ধ গ্রাম সুপুরের কথা। কিন্তু, কিছু তথ্যগত ভুল থেকে যায় লেখাটিতে। বীরভূমের গ্রাম, লিখছেন রাজকৌলিন্যে আলোকিত বীরভূমের একজন লেখক।
লেখাটি পড়ে ক্ষুব্ধ হলেন বীরভূমেরই বছর চব্বিশের এক যুবক। তিনি প্রতিবাদপত্র পাঠালেন পত্রিকা দফতরে। রাজার ভুল ধরে চিঠি? খবর গেল রাজার কাছে। সঙ্গে সঙ্গে তলব করা হল যুবকটিকে। লোক পাঠিয়ে হেতমপুরে আনা হল তাঁকে। যুবকটির সাহস এবং প্রজ্ঞা দেখে অবাক হলেন রাজা। তথ্য-সমৃদ্ধ প্রতিবাদপত্র পড়ে খুশি হয়েছিলেন আগেই। এখন আরও খুশি হলেন প্রায় ঘরের কাছে এমন একজন গুণী মানুষের সন্ধান পেয়ে। সেদিন থেকেই রাজা মহিমানিরঞ্জন তাঁর সাহিত্যকর্মের সঙ্গে যুক্ত করে নিলেন যুবকটিকে। সেদিনের সেই প্রতিবাদী যুবকই পরবর্তী সময়ের বৈষ্ণব সাহিত্যের বিখ্যাত পণ্ডিত সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়। এই ঘটনার কথা হরেকৃষ্ণ নিজেই জানিয়েছেন ‘আমার জীবন কথা’ শীর্ষক তাঁরই একটি রচনায়।
১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে বীরভূম জেলার কুড়মিঠা গ্রামে জন্ম হয় হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের। কুড়মিঠা তাঁর মামার বাড়ি। পৈতৃক বাড়ি কাছাকাছি মঙ্গলডিহি গ্রামে। বয়স যখন তার মাত্র তিন, বাবা মারা যান। এর ঠিক চার বছর পরে মারা যান মা-ও। হরেকৃষ্ণ এবং তাঁর দাদা পঞ্চানন দু’জনেই শিশু তখন। এই বয়সেই বিপর্যয় নেমে আসে জীবনে। কোথায় কী ভাবে যে তাঁদের দিন কাটবে, চিন্তিত হয়ে পড়েন পাড়াপড়শিরা। অবশেষে আশ্রয় পান কুড়মিঠা গ্রামে তাঁদেরই এক বিধবা মাসির কাছে। মাসি সারদাসুন্দরী অভাব অনটনের মধ্যেও কোনও রকমে বড় করে তোলেন শিশু দু’টিকে। আক্ষরিক অর্থেই এই বড় করে তোলা। বিস্তর লেখাপড়া শিখিয়ে ‘মানুষ’ করার কথা ভাবতেই পারেননি তিনি। কারণ ঘড়ি ধরা ছাত্রজীবনের নিয়মকানুন মেনে চলার মতো সময় এবং সংগতি সংসারে ছিল না তখন। তাই প্রাথমিক স্তরের বিদ্যা নিয়েই প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ইতি টানতে হয় হরেকৃষ্ণকে।
তবে ছেলেবেলা থেকেই তাঁর অসম্ভব বই পড়ার নেশা। ছিল অজানাকে জানার আগ্রহ। এই আগ্রহই তাঁকে একসময় টেনে নিয়ে আসে কুড়ি কিলোমিটার দূরের সিউড়ি শহরে। সিউড়িতে পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক শিবরতন মিত্র তৈরি করেছিলেন দুর্লভ একটি গ্রন্থাগার। নাম ‘রতন লাইব্রেরী’। বহু প্রাচীন পুথি এবং অমূল্য গ্রন্থের ভাণ্ডার। হরেকৃষ্ণ তাঁর গ্রাম থেকে এই গ্রন্থাগারের দুর্লভ গ্রন্থগুলির টানে সিউড়িতে চলে আসতেন প্রায়শই। আসতেন হেঁটেই। সঙ্গে আনতেন কষ্টেসৃষ্টে জোগাড় করা সামান্য কিছু টাকা। সেই টাকা শেষ না হওয়া পর্যন্ত বাড়ি ফিরতেন না। তাঁর এই সিউড়ির কষ্টকর দিনযাপনের কথা তিনি লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন স্পষ্ট ভাবেই। লিখেছেন— ‘ষোল মাইল দূর সিউড়ী। সিউড়ীতে শিবরতন মিত্রের রতন লাইব্রেরীতে বই পড়িবার জন্য যাইতাম। সিউড়ীর তুলসীর হোটেলের খুব নাম ছিল। চারি আনা পয়সা দিলে মেঝেতে পিঁড়ি পাতিয়া থালায় ভাত ও বাটীতে ডাল ও মাছের ঝোল দিত। তরকারীও গুটী দুই থাকিত। সবদিন চারি আনা জুটিত না। তিন আনা দিয়া বাহিরে পরচালায় খাইতাম। বহু কষ্টেই এই পয়সা সংগ্রহ করিতাম। রাত্রে কুঞ্জ ময়রার দোকানে দুই আনার আধসের রসগোল্লা খাইতাম। চা খাওয়ার অভ্যাস ছিল না। তিন আনা পয়সা খরচ হইত একবাক্স সিজার সিগারেটে। পয়সা ফুরাইয়া গেলে বাড়ি ফিরিতাম।’’
অবশ্য হরেকৃষ্ণ তাঁর সাহিত্য জীবনের শুরুতেই পেয়েছিলেন হেতমপুরের রাজপরিবারের আনুকূল্য। মূলত তাঁর পরামর্শেই কুমার মহিমানিরঞ্জনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘বীরভূম অনুসন্ধান সমিতি’। এই সমিতির ব’কলমে হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় তিন খণ্ডে ‘বীরভূম বিবরণ’ গ্রন্থ রচনা করেন। পায়ে হেঁটে সংগ্রহ করেছিলেন বীরভূমের গ্রাম-গ্রামান্তরের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস। সংগ্রহ করেন ডাঙ্গা, ডহর, ঢিবি এবং দীর্ঘ পুস্করিণীর অতীত কাহিনি। যদিও হরেকৃষ্ণ নিজে তাঁর সংগ্রহগুলিকে ইতিহাস বলতে রাজি হননি। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘বীরভূমের কয়েকটি পল্লী ও তীর্থক্ষেত্রের কাহিনী মাত্র।’’ বীরভূম বিবরণ প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই হইচই পড়ে যায় সাহিত্যিক মহলে। কেউ কেউ এই গ্রন্থকে আঞ্চলিক সাহিত্যের আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। বরেণ্য সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এ গ্রন্থ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘‘এ কথা অকুন্ঠ ভাবে বলতে পারি তিনি যতটা সম্ভব বীরভূমের ইতিহাসের যাবতীয় উপকরণ তার মধ্যে একত্রিত করে রেখেছিলেন। পরবর্তীকালে ইতিহাস দৃষ্টি সম্পন্ন কোনো ঐতিহাসিক অধ্যাপক বীরভূমের ইতিহাস রচনায় হাত দিলে তাকে সাহিত্যরত্ন মহাশয়ের গ্রন্থ তিনখানির সাহায্য নিতেই হবে।’’
হরেকৃষ্ণ তাঁর প্রতিভার গুণে সে সময়ের বহু বিদগ্ধ মানুষের স্নেহ, শ্রদ্ধা, ভালবাসা এবং সম্মান আদায় করে নিতে পেরেছিলেন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ বসু, সুকুমার সেন, রমেশচন্দ্র মজুমদার, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সজনিকান্ত দাস, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় প্রত্যেকেই ছিলেন তাঁর গুণগ্রাহী। ১৩২৬ বঙ্গাব্দে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী তাঁকে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। হরেকৃষ্ণ তাঁর সাহিত্য জীবনে নানা প্রত্ন-অনুসন্ধানের কাজ করেছিলেন বিশেষ দক্ষতার সঙ্গে। রাঢ় বাংলার বহু মন্দির-মসজিদ, শিলাফলক এবং তাম্রফলকের গায়ে লিখিত বহু দুর্বোধ্য লিপির অর্থ উদ্ধার করেছিলেন তিনি। বীরভূমের পাইকর গ্রামের চেদিরাজ কর্ণদেবের শিলালিপি আবিষ্কার করে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের প্রশংসা পেয়েছিলেন। বীরভূমের দীঘি, পুষ্করিণী, ডাঙা ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা নানা কিংবদন্তি কাহিনির ভিতরের ইতিহাসকে খুঁজে বের করার অনন্য কৃতিত্ব ছিল তাঁর।
প্রথম জীবনে হরেকৃষ্ণ জেলার ঐতিহাসিক পুরাতত্ত্ব উদ্ধারে এবং জেলার অতীত অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকলেও পরবর্তী সময়ে তিনি বৈষ্ণবদর্শন এবং বৈষ্ণব সাহিত্যের উপরে দীর্ঘস্থায়ী কাজ করে যান। এই কাজই তাঁকে বৈষ্ণব সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেয়। ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘কবি জয়দেব ও শ্রী শ্রী গীতগোবিন্দ’ গ্রন্থটি প্রকাশের পরেই বোঝা যায় যে, বাংলা সাহিত্যে একটি শক্তিশালী কলম তাঁর কৌলিন্য নিয়েই উঠে আসছে। এই গ্রন্থটি প্রকাশের সুবাদেই হরেকৃষ্ণ যেন নতুন ভাবে আবিষ্কৃত হলেন। তাঁর শ্রম, মেধা এবং পাণ্ডিত্যকে সম্মান জানাতে বাধ্য হল বাংলা সাহিত্য। এ সময় তিনি বৈষ্ণব সাহিত্যের বহু উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। সুনীতিকুমারের সঙ্গে চণ্ডীদাস পদাবলি, বিখ্যাত সমালোচক শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘জ্ঞানদাস পদাবলী’, সুকুমার সেনের সঙ্গে ‘রামগোপাল দাস: রসকল্পবল্লী ও অন্যান্য নিবন্ধ’ ইত্যাদি গ্রন্থগুলি সুনামের সঙ্গে সম্পাদনা করেন। এ ছাড়াও তাঁর একক সম্পাদনায় ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’, ‘শ্রীচৈতন্য ভাগবত’ সহ বেশ কিছু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। অন্য দিকে তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি ‘পদাবলী পরিচয়’ ,‘বাংলার কীর্তন ও কীর্তনীয়া’ , ‘গৌড়ীয় বৈষ্ণব সাধনা’ , ‘গৌরবঙ্গ সংস্কৃতি’ প্রভৃতি গ্রন্থগুলি বৈষ্ণব সাহিত্যের অনন্য সম্পদ হয়ে রয়েছে। কমন্ডলু নামে একটি কাব্যগ্রন্থও লিখেছিলেন তিনি। বৈকালি নামে একটি দৈনিক এবং বীরভূম বার্তা নামে একটি সংবাদ সাপ্তাহিক সম্পাদনার কাজও করেছিলেন কিছুদিন।
১৩২৬ বঙ্গাব্দে সাহিত্যরত্ন সম্মান পাওয়ার পরে নবদ্বীপের পণ্ডিত সমাজের বঙ্গ বিবুধ সভা তাঁকে সাহিত্য শাস্ত্রী উপাধি প্রদান করে। ১৯৭১ সালে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ডি-লিট দিয়ে সম্মান জানায়। এ ছাড়াও বাংলা এবং বাংলার বাইরের বহু বৈষ্ণব সাহিত্য অনুরাগী এবং প্রতিষ্ঠান তাঁকে সম্মানিত ও সংবর্ধিত করে।
যা সত্য, তা স্পষ্ট ভাষায় জানাতে কুণ্ঠা ছিল না হরেকৃষ্ণের। সে যত বড় মাপেরই মানুষ হোন না কেন, সত্যকে এড়িয়ে চলেছেন বলে মনে হলে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই তিনি তাঁর প্রতিবাদ করেছেন। তিনি যেমন রাজকুমার মহিমানিরঞ্জনকে ছেড়ে কথা বলেননি, তেমনই সুনীতিকুমার চট্টপাধ্যায়ের কোনও মত সঠিক মনে না হলেও প্রতিবাদ করেছেন। বসন্তকুমার রায় বিদ্বদবল্লভ আবিষ্কৃত শ্রীকৃষ্ণকীর্ত্তন কাব্যগ্রন্থটিকে সুনীতিবাবু আদি চণ্ডীদাসের রচনা বলেছিলেন। এর প্রতিবাদ করেছিলেন হরেকৃষ্ণ। তবে এ ক্ষেত্রে সুনীতিবাবুও হরেকৃষ্ণের প্রতি কোনও রাগ বা দুঃখ প্রকাশ করেননি। বরং তাঁদের সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়।
বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্যের অন্যতম পুরোধাপুরুষ হরেকৃষ্ণ আজীবন কাটিয়েছেন তাঁর জন্মভূমি কুড়মিঠা গ্রামেই। নগর জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে গ্রামের মাটি, জল, আলো, বাতাসকেই আপন করে নিয়েছিলেন। তাই এক অর্থে এই কুড়মিঠা গ্রাম বাংলার বৈষ্ণব সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে পবিত্র তীর্থভূমি।
(লেখক সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy