দু’দিন ধরে সরযূর তীরে, হনুমানগঢ়ী মন্দির থেকে দশরথ মহল সর্বত্র, ঘুরতে ঘুরতে বুঝলাম, রামচন্দ্র এখানে আজ বিস্মৃত। বাবা রামচন্দ্র। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ের এক রামানন্দী সন্ন্যাসী। গ্বালিয়রের মানুষ, আসল নাম শ্রীধর বলবন্ত জোধপুরকর। ১৯০৫ সালে ফিজি দ্বীপের পথে জাহাজে ওঠার আগে নিজের নাম বলেছিলেন, রামচন্দ্র। ফিজিতে গিয়েছিলেন চুক্তিবদ্ধ শ্রমিক হিসেবে, আখের খেতে কাজ করতে। মাঝে মাঝে অন্য পরিযায়ী শ্রমিকদের শ্রীরামচরিতমানস পড়ে শোনাতেন। সহসা মাথার পোকা নড়ে উঠল। দেশছাড়া শ্রমিকদের খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসায় মালিকদের আরও সুবিধা দেওয়া উচিত বলে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়লেন। সেখানকার ব্রিটিশ সরকার তাঁর নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করল।
রামচন্দ্র স্বদেশে পালিয়ে এলেন। ডেরা বাঁধলেন অযোধ্যার কাছে কসাইপুর গ্রামে। সেটা ১৯১৬। রোজ ভোরে জলযোগ সেরে, হাতে রামায়ণ নিয়ে আশপাশের গ্রামে চলে যান। রামায়ণ পড়ে চাষিদের বলেন, “রাবণের দশ মাথা মানে যন্ত্রের মতো। এই যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য, এটাও একটা যন্ত্র। রাজা-মহারাজা থেকে তালুকদার, সুদখোর মহাজন সবাই তার অংশ। যন্ত্রের সবচেয়ে বড় মাথা হল বড়লাট।” মহাযুদ্ধের সময় অযোধ্যার জমিদারেরা চাষি ও অন্যদের থেকে ‘লড়াই চাঁদা’ নামে বেআইনি কর আদায় করে। তার বেশির ভাগই যায় যুদ্ধে ইংল্যান্ডকে সাহায্য করতে। রামচন্দ্র গ্রামের গরিবদের নিয়ে গড়লেন ‘অওধ কিসান সভা’। হনুমানগঢ়ীতে প্রথম সভায় গেলেন হাত-পায়ে-ঘাড়ে শিকল বেঁধে। গ্রামের লোকেরা তো এ ভাবেই শৃঙ্খলিত! ডাক দিলেন, “অন্যায্য লড়াই চাঁদা আমরা আর দেব না। চাষের জমিতে কুয়ো খোঁড়া ও জলসেচের অধিকার চাই।” ক’বছর পরে গাঁধীর ডাকে সংগঠনটি কংগ্রেসে মিশে যায়।
রামচন্দ্র আর এক কাজ করেছিলেন। কসাইপুর ও তার আশপাশের লোকেরা দেখা হলে ‘সালাম’ বলত। রামচন্দ্র স্লোগান তুললেন, ‘সিয়ারাম’। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই ওই ভাবে অভিবাদন জানাবে। গত জন্মাষ্টমীতে অযোধ্যায় গিয়ে দেখলাম, দশরথমহল থেকে রাম-সীতার আবাস কনক ভবন সর্বত্র লেখা ‘জয় শ্রীরাম’।
স্লোগান বদলেছে, অযোধ্যা বদলায়নি। বেশির ভাগ মন্দিরের সঙ্গে বিভিন্ন রকম ধর্মশালা রয়েছে। এই শতকের শুরুতে সেখান থেকে মহামারি ছড়াত। ১৯১২-১৩ সালে দেখা গেল, বড় তীর্থক্ষেত্র হলেও হরিদ্বার ও বারাণসীতে প্লেগ-কলেরা সংক্রমণ কম, অযোধ্যায় বেশি। যুক্তপ্রদেশের স্যানিটারি কমিশনার মেজর রবার্টসনের নেতৃত্বে তিন সদস্যের কমিটি রিপোর্টে জানাল, “তীর্থযাত্রীরা এখানে বিভিন্ন পাণ্ডা ও পুরোহিতের বাড়িতে থাকেন। সেখানে সাধ্যমাফিক প্রণামী দেন। পান্ডা এবং তীর্থযাত্রী দুই পক্ষই একে ‘লজ’ হিসেবে মানতে নারাজ। ফলে আইন অনুযায়ী স্যানিটেশন, পয়ঃপ্রণালী ও নিকাশি নালা, পানীয় জলের বন্দোবস্ত করা যায় না।” রাত কাটিয়েছিলাম একটি ধর্মশালায়, পুরনো বাড়ির উঠোন ঘিরে ক’টি ঘর, এক দিকে রাম-সীতার মন্দির।
মন্দিরগুলি ঝরোখা, সিংহদুয়ার নিয়ে অষ্টাদশ শতকের মরাঠা ও রাজপুত শৈলীতে তৈরি। রাম-সীতার প্রাসাদ কনক ভবনের ওয়েবসাইটে লেখা: “ত্রেতাযুগে কৈকেয়ী রাম ও সীতাকে এই প্রাসাদ উপহার দিয়েছিলেন। মহারাজ চন্দ্রগুপ্ত ও সমুদ্রগুপ্ত এটি সংস্কার করেন। ১০২৭ খ্রিস্টাব্দে গাজি নবাব সালারজঙ্গ সেই প্রাসাদ ভেঙে দেন। ১৮৯১ সালে বুন্দেলখণ্ডে ওরছার মহারাজা শ্রীপ্রতাপ সিংহ (নাইট গ্র্যান্ড কম্যান্ডার অব ইন্ডিয়ান এম্পায়ার) ও তাঁর মহারানি বৃষভানু কুঁয়ারি মন্দির পুনর্নির্মাণ করেন।” ১০২৭ ও ১৮৯১ সালের মাঝের ৮০০ বছরে মুঘল আমলে কী হয়েছিল, উচ্চবাচ্য নেই। অথচ, মুঘল আমলের শেষে অওধের নবাব সুজাউদ্দৌলা, আহমদউদ্দৌলাদের পৃষ্ঠপোষণাতেই অযোধ্যার রমরমা। তাঁরাই রামানন্দী সাধুদের জমি দিয়েছিলেন।
নাগেশ্বরনাথ শিব মন্দিরের প্রাচীন শিবলিঙ্গটি দেখিয়ে গাইড জানালেন, কুশ এই লিঙ্গ স্থাপন করেন। রামচন্দ্রের পুত্র তা হলে পিতার মন্দির না করে শিব স্থাপন করেছিলেন! অদূরে মণিপর্বতে গৌতম বুদ্ধ একদা ধর্মপ্রচার করেছিলেন। তখন এর নাম ছিল সাকেত। গাইড বললেন, ওটি সুগ্রীব পর্বত। যুদ্ধশেষে শ্রীরামের অভিষেকের সময় সুগ্রীব ওখানে ছিলেন। আর একটু এগিয়ে বিভীষণকুণ্ড।
অযোধ্যা যাওয়ার আগে ইতিহাসবিদ গৌতম ভদ্র পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, “একটা জিনিস মাথায় রাখবে। গোটা শহরে রামায়ণ ছড়িয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু রামচন্দ্র ঠিক কোথায় জন্মেছিলেন, সীতা রসোই-তে আদৌ সীতার রান্নাঘর ছিল কি না, এ নিয়ে তুলসীদাসেরও মাথাব্যথা ছিল না। এগুলি রামানন্দী সাধুদের তৈরি মিথ।”
অযোধ্যা থেকে ফিরতে ফিরতে মনে পড়ছিল কবীরের দোঁহা, “রামকে কে মন্দিরে দেখেছে? পুব দিকে রামের পুরী, পশ্চিমে আলির। কিন্তু নিজের হৃদয়পুরীতে খোঁজো, রাম রহিম দুজনকেই পাবে।” মধ্যযুগের আর এক সাধক দাদু বলতেন, “হিরদৈরাম সম্ভালিল মনরাখৈ বেসাস।” মানে, হৃদয়ে রামকে স্থাপন করো ও মনে বিশ্বাস রাখো। রাজস্থানের রামসনেহি সম্প্রদায়ের আরাধ্যও রাম। কিন্তু তাঁরা মন্দিরে বিশ্বাসী নন। তাঁরা বলেন, “এই শরীরই পূর্ণস্বরূপ রামের মন্দির, তাঁকে জানার ঔৎসুক্যই আরতি।” ভারতে লক্ষ জনের হৃদয়ে লক্ষ রাম।
ফেরার সময় অযোধ্যা স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি। বানরের প্রবল উৎপাত। দেহাতি এক মহিলাকে বানর প্রায় তাড়া করছে, রেলের এক রক্ষী লাঠি দিয়ে প্ল্যাটফর্মের টিনের চালায় দুমদাম পেটাচ্ছেন। শব্দসন্ত্রস্ত বানর পালিয়ে গেল। পরের দৃশ্যটা দেখার জন্য আদৌ প্রস্তুত ছিলাম না। ভদ্রমহিলা পলায়নরত সেই বানরের দিকে তাকিয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলেন। তীর্থ করতে আসা এই দরিদ্র মহিলাও জানেন, রাম-লক্ষ্মণ-হনুমান শুধু মন্দিরের প্রস্তরমূর্তিতে থাকেন না। তাঁরা হৃদয়ে থাকেন। ভক্ত প্রয়োজনে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেও তাঁদের খুঁজে পান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy