জয়দেব মেলায়। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী
জয়দেবের পিতার নাম ভোজদেব, মাতা বামদেবী; আর তাঁর স্ত্রী হলেন পদ্মাবতী। সংস্কৃত সাহিত্য এবং সঙ্গীত শাস্ত্রে জয়দেবের অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। তিনি ছিলেন রাজা লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি। আকৈশোর ভাবুক ও উদাসীন প্রকৃতির জয়দেব দয়ানিধি নামে কাশীর এক সাধুর নিকট দীক্ষা গ্রহণ করেন। যৌবনে সন্ন্যাস নেওয়ার ইচ্ছেয় নীলাচলের পথে অগ্রসর হন। কিন্তু সন্ন্যাস নেওয়া আর হয় না। পদ্মাবতীকে বিয়ে করে সংসারে বাঁধা পড়তে হয় তাঁকে। জয়দেবের স্ত্রী-ভাগ্য ভাল। পদ্মাবতীকে সাধন-সঙ্গিনী হিসেবেই পেয়েছিলেন তিনি। সংসারে থেকেও পদ্মাবতীকে নিয়েই সাধনকর্মে রত হন জয়দেব। জয়দেবের সাধনার নাম ‘পরকীয়া সাধনা’। এ পথের অধিকার কেবল নিষ্কাম ভক্তের। জয়দেবের জীবনের মূলমন্ত্র ছিল কৃষ্ণপ্রেম। স্বকীয়া রমণী পদ্মাবতীকে পরকীয়া ভাবে সাধনায় চিরসময় পরমপুরুষের দিব্যানুভূতি লাভ করেন তিনি। জয়দেবের সাধনচিন্তার পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে।
‘গীতগোবিন্দ’ রচিত হয় দ্বাদশ শতাব্দীতে। এই কাব্য সম্পূর্ণ হওয়ার মূলে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। কাব্যটির মানভঞ্জন পালা রচনায় কবি বেশ বিপদে পড়েছিলেন। কৃষ্ণ কী ভাবে প্রেমময়ী রাধার মান ভাঙাবেন! জয়দেব গোস্বামীর হৃদয়ে সৃষ্টি-সমস্যার এই অধ্যাত্ম-আগুন জ্বলে ওঠে। এমন অশান্ত হৃদয়ে এক দিন পুথি ছেড়ে তিনি স্নানে গিয়েছেন। কুটিরে কেবল পদ্মাবতী। তিনিও কবির এই মানসিকতার জন্য চিন্তান্বিত। এমন সময় দেখেন—অন্য দিনের তুলনায় অনেক আগেই কবি স্নান সেরে ফিরে এসেছেন। তারপর মধ্যাহ্ন-ভোজন শেষ করে আবার পুথি নিয়ে বসেন। নিত্যদিনের ন্যায় পদ্মাবতীও স্বামীর প্রসাদী থালায় অন্ন-গ্রহণে বসেছেন। এমন সময় এক বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে। পদ্মাবতী দেখেন, স্বামী আবার স্নান সেরে ফিরছেন। ভয়ে-বিস্ময়ে পদ্মাবতী এর রহস্য জানতে চাইলেন। এ দিকে পদ্মাবতীকে আহার করতে দেখে জয়দেবও অবাক। পূর্বাপর সমস্ত ঘটনা জানালেন পদ্মাবতী। দু’জনেরই বিস্ময়ের শেষ নেই। কথিত, রহস্য জানার জন্য তাঁরা পুথির কাছে উপস্থিত হলেন। পুথিতে যা দেখলেন, তা দেখে তাঁরা অনির্বচনীয় বিস্ময়ে রোমাঞ্চিত হলেন। কবি জয়দেব তাঁর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যের যে পাদপূরণ নিয়ে বড় চিন্তান্বিত ছিলেন, সে জায়গায় কে যেন লিখে গেছেন—‘স্মরগরলখণ্ডনং মম শিরসি মণ্ডনং দেহিপদপল্লবমুদারম’। কৃষ্ণপ্রেম-সাধক ও সাধিকা জয়দেব ও পদ্মাবতী দেখলেন, প্রেমময় কৃষ্ণ স্বয়ং রাধার চরণ মাথায় ধরে পরকীয়া তত্ত্বের মহিমাকে মানুষের শিরোধার্য করে গিয়েছেন।
জয়দেব গোস্বামী নিজে গীতিকার এবং গায়ক ছিলেন। নৃত্যশিল্পে পারদর্শী ছিলেন পত্নী পদ্মাবতী। ‘পদ্মাবতী সুখসমাজ’ নামে জয়দেবের একটি গীতিনাট্যের দল ছিল। এই দলে কৃষ্ণের উক্তি সহ অন্যান্য গানগুলি গাইতেন জয়দেব। আর রাধা ও তার সখীদের উক্তিগুলি নৃত্যযোগে পরিবেশন করতেন পদ্মাবতী। জয়দেব-পদ্মাবতীর সঙ্গীত-শাস্ত্রে পারদর্শিতার কথা ‘সেক শুভোদয়া’ গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। সেই কাহিনি অনুসরণেই মুক্তপদ দে তাঁর ‘তীর্থময় বীরভূম’ বইয়ে বলেছেন, প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ব্যুঢ়ন মিশ্র ওড়িশা জয় করে লক্ষ্মণ সেনের রাজসভায় উপস্থিত হন। রাজসমীপে তিনি ‘পটমঞ্জরী’ রাগ গাইলেন। গান শেষ হলে দেখা গেল, সভার কাছে থাকা অশ্বত্থ গাছটি পত্রহীন হয়ে গিয়েছে। সকলে হতবাক। রাজা ব্যুঢ়ন মিশ্রকে জয়পত্র দিতে প্রস্তুত হয়েছেন, এমন সময় রাজসমীপে হাজির হন পদ্মাবতী। তিনি রাজসমীপে প্রস্তাব রাখেন জয়পত্র জয়ের প্রতিযোগিতা হোক—‘হয় আমার সঙ্গে না হয় জয়দেবের সঙ্গে ব্যুঢ়ন মিশ্র প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করুন’। প্রতিযোগিতা হয়েছিল পদ্মাবতীর সঙ্গে। পদ্মাবতী তাঁর অপূর্ব কণ্ঠে ‘গান্ধার’ রাগ পরিবেশন করেন। সে রাগ শুনে রোমাঞ্চিত সভাসদ পদ্মাবতীর জয়ধ্বনি দেন। ব্যুঢ়ন মিশ্র জানান—নারীর সঙ্গে তিনি প্রতিযোগিতা করবেন না। তখন জয়দেবকে রাজসভায় আহ্বান জানানো হয়। স্থির হয় সুরের আকর্ষণে যিনি পত্রহীন বৃক্ষ হরিৎ পত্রে সজীব করতে পারবেন তিনিই জয়পত্র পাবেন। ব্যুঢ়ন মিশ্র তাঁর অক্ষমতা জানান। তখন জয়দেব ‘বসন্তরাগ’ আলাপ শুরু করেন। জয়দেব-কণ্ঠনিঃসৃত বসন্তরাগ আলাপ-ধ্বনিতে সভাসদ বিমোহিত হন এবং পত্রহীন বৃক্ষ সজীব-কিশলয়ে পূর্ণ হয়। রাজা লক্ষ্মণ সেন সেদিন সানন্দে গীতসুধাকর জয়দেবকে জয়পত্রে সম্মানিত করেন।
জয়দেব-কেঁদুলির মেলা বহু প্রাচীন। এই মেলা প্রসঙ্গে কিছু প্রমাণ, কিছু কিংবদন্তির কথা বলতে হয়। ১৮৮২ সালে প্রকাশিত বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসে অজয়তীরে কেন্দুবিল্বে জয়দেব গোস্বামীর মেলার কথা রয়েছে। আমরা বলি আরও অতীতের কথা। জয়দেব গোস্বামীর ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্য রচিত হয় ১১৫৯ সালে। সেই সময়েই এক পৌষ-সংক্রান্তির দিন কবি জয়দেব মকর-বাহিনি গঙ্গার সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন বলে কথিত। পৌষমাসের শেষ দিন কবি জয়দেব ভোরবেলা গঙ্গাস্নানে যেতেন। এক বার কোনও অসুবিধার জন্য স্নানে যেতে না পারার মতো পরিস্থিতি দেখা দেয়। এর জন্য মনের মধ্যে তিনি অশান্তি অনুভব করেন। সংক্রান্তির পূর্বরাত্রে চোখের জল নিয়ে শয্যা গ্রহণ করেন। সেই রাত্রেই কবি এক অলৌকিক স্বপ্ন দেখেন। মকরবাহিনী গঙ্গা হেসে বলেছেন—‘ক্ষোভ দূর কর। তুমি যেতে পারলে না যখন, তখন আমি আসব অজয়ের স্রোত বেয়ে কদমখণ্ডীর ঘাটে। তোমার স্পর্শে ধন্য হব আমি।’
ঘুম ভেঙে কবির বিস্ময়ের সীমা ছিল না। ভোরের অন্ধকারেই কদমখণ্ডীর ঘাটে গিয়ে উপনীত হন জয়দেব। দেখেন ঘাটের সম্মুখে অজয়ের জলধারা থেকে দিব্য মণিময়—কঙ্কনপরা দু’খানি অমলধবল বর্ণাভ হাত বেরিয়ে ঊর্ধ্বে উঠেছিল। মা গঙ্গা কবিরাজ গোস্বামীকে সঙ্কেতে জানিয়েছিলেন, তাঁর আগমন বার্তা। মা-গঙ্গার দর্শনধন্য উল্লসিত কবি জয়দেব সেদিন অপার আনন্দে আপ্লুত হয়ে অনেক সাধু-সন্ন্যাসীদের নিমন্ত্রণ জানিয়ে এক মহোৎসবের আয়োজন করেন। অনেকে মনে করেন, তখন থেকেই ওই দিনটি স্মরণে প্রত্যেক বছর কেঁদুলিতে বহু বৈষ্ণবের সমাগম ঘটে এবং মহোৎসব হয়। আবার দ্বাদশ শতাব্দীর কোনও এক পৌষ সংক্রান্তির দিন জয়দেবের তিরোধান ঘটে। বৃন্দাবনের নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের ছেচল্লিশতম গুরু ছিলেন তিনি। গুরুর দেবতা দর্শন ও তিরোধানের তিথিতে নিম্বার্ক সম্প্রদায়ের বহু সন্ন্যাসী পবিত্র কদমখণ্ডীর ঘাটে তর্পণ করতে আসতেন। তাঁদেরই এক জন ছিলেন রাধারমণ ব্রজবাসী। তাঁর উদ্যোগ ও বর্ধমান রাজবাড়ির অর্থ নিয়ে কেঁদুলিতে জয়দেবের জন্মভিটের উপরে রাধাবিনোদ মন্দির তৈরি হয়। বর্ধমানের রাজা ত্রিলোকচাঁদ বাহাদুর ১৬৯২ সালের পৌষ সংক্রান্তির দিনই নাকি ওই মন্দিরে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করেন এবং মন্দির উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এক বিশাল উৎসবের আয়োজন করেন।
আমাদের অনুমান জয়দেবের স্মৃতিরক্ষার্থে আয়োজিত সেই উৎসবই এক দিন জয়দেব মেলা নামে পরিচিত হয়। পরকীয়া সাধক ও গীত সুধাকর জয়দেব স্মরণে বাউল সমাবেশও স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক জনমানসে ছড়িয়ে পড়া এই মেলায়—গোপীযন্ত্রের গাবগুবাগুব ধ্বনিতে অশ্বত্থবটের পত্রপল্লবে শিহরণ জাগে, বাঁয়া তবলায় দিদাম দিদাম রবে ঘা পড়ে, পায়ে নূপুর ঝঙ্কার দেয় আর তালে তালে শোনা যায় দেহতত্ত্বের গান।
লেখক গবেষক ও সাহিত্যকর্মী, মতামত নিজস্ব
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy