নেতৃত্ব? রাজঘাটে মহাত্মা গাঁধীর সমাধিতে সংবিধান পাঠরত রাহুল গাঁধী, সনিয়া গাঁধী, মনমোহন সিংহ, দিল্লি, ২৩ ডিসেম্বর। পিটিআই
কোথায় যাবে হিন্দুরা? ভগবান না করুন, কাল যদি ফ্রান্সে কোনও শাসক এসে হিন্দুদের বার করে দেয়, হিন্দুরা কোথায় যাবে? এই দুনিয়ায় আর কোথায় যাবে সে? এখানেই আসবে! আর কোথাও যেতে পারে না। যদি আফ্রিকা থেকে সব হিন্দুকে বার করে দেয়, তা হলে এখানেই আসবে। আমাদেরও উচিত তাদের অভ্যর্থনা জানানো।
ঠিক এক সপ্তাহ আগে এক সাক্ষাৎকারে এই কথাগুলো বলেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। আপাত ভাবে মনে হয়, সহানুভূতিশীল এক জন রাষ্ট্রনেতা তো এমনটা বলতেই পারেন। তবে একটু তলিয়ে ভাবলেই বোঝা যায়, হিন্দুরা বিপদে পড়লে এ দেশে আশ্রয় নেবে বলার পিছনে মূল ভাবনাটি হল— ভারতই হিন্দুদের দেশ। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত যাকে বলেন, ‘হিন্দুস্তান। হিন্দু রাষ্ট্র।’
২০২৫-এ আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ। সঙ্ঘ পরিবার নিশ্চয়ই আশা করছে, স্বাধীনতার ৭৫তম বর্ষ ২০২২-এ না হলেও অন্তত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের শতবর্ষে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন পূরণ হবে। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, প্রথমে ৩৭০ রদ। তার পর তিন তালাককে ফৌজদারি অপরাধের তকমা দিয়ে মুসলিমদের দেওয়ানি বিধিতে হস্তক্ষেপ। অযোধ্যায় রামমন্দির তৈরি। এ বার নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও এনআরসি। ভবিষ্যতে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি। বিজেপি-আরএসএস আসলে হিন্দু রাষ্ট্রের পথে এগোতে চাইছে। গত এক বছরে পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা ভোটে বিজেপি ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে ঠিকই। বাংলার গা-ঘেঁষা ঝাড়খণ্ড বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্তরে মোদী সরকারের যাত্রাপথ দেখে বিরোধীরা টের পাচ্ছেন, এক সময় সঙ্ঘের যে হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনাকে অবাস্তব বা অসম্ভব মনে হত, এখন যেন তা ধরাছোঁয়ার মধ্যে।
আসল প্রশ্ন অন্য। কংগ্রেস তথা বিরোধী শিবির এই হিন্দু রাষ্ট্রের মোকাবিলায় কোন কৌশল নেবে? কংগ্রেসের দিক থেকে হিন্দু রাষ্ট্রের ভাবনার পাল্টা কোনও যুক্তি বা ভাষ্য এখনও অমিল। সনিয়া-রাহুল গাঁধীরা রাজঘাটে সত্যাগ্রহে বসতে পারেন। কিন্তু সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ করে কি হিন্দু রাষ্ট্র আটকানো যাবে? বিরোধীদের কি সেই শক্তি রয়েছে?
নয়া নাগরিকত্ব আইন, এনআরসি-র বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে হিংসার পিছনে কংগ্রেসের মদত রয়েছে বলে প্রধানমন্ত্রী থেকে বিজেপি নেতৃত্ব বার বার অভিযোগ তুলেছেন। জবাবে গুলাম নবি আজাদ মুচকি হেসে বলেছেন, আমাদের এত শক্তি থাকলে তো আমরাই ক্ষমতায় থাকতাম! প্রবীণ কংগ্রেসির রসিকতা আসলে নির্মম সত্য। নয়া নাগরিকত্ব আইনকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে কংগ্রেস সংসদে সরব হয়েছে। কিন্তু সব ধর্মনিরপেক্ষ দলকে কংগ্রেস রাজ্যসভায় এক মেরুতে নিয়ে আসতে পারেনি। জেডি(ইউ), বিজু জনতা দল বা ওয়াইএসআর কংগ্রেসের মতো স্বঘোষিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিও কংগ্রেসের পাশে দাঁড়ায়নি। নয়া নাগরিকত্ব আইন-এনআরসি-র বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ হচ্ছে ঠিকই। সেই বিক্ষোভের নেতৃত্ব বা রাশ কোনওটাই কংগ্রেস বা বিরোধীদের হাতে নেই। বিরোধীরা এককাট্টাও হতে পারেননি।
সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দু রাষ্ট্রের স্বপ্ন নতুন কিছু নয়। তাঁরা এ নিয়ে লুকোছাপাও করেন না। সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত প্রতি বছরের মতো এ বছরও নাগপুরে বিজয়া দশমীর বক্তৃতায় বলেছেন, ‘‘রাষ্ট্র ও আমাদের সামাজিক পরিচিতি সম্পর্কে সঙ্ঘের দৃষ্টিভঙ্গি ও ঘোষণা খুবই স্পষ্ট ও চিন্তাভাবনা করে ঠিক করা। তা হল, ভারত হল হিন্দুস্তান, হিন্দু রাষ্ট্র। যাঁরা ভারতের, যাঁরা ভারতীয় পূর্বপুরুষের বংশধর, যাঁরা রাষ্ট্রের গরিমার জন্য কাজ করছেন, সেই সব ভারতীয়ই হিন্দু।’’ অমিত শাহ গোটা বিশ্বের হিন্দুদের জন্য ভারতের দরজা খোলা রাখার কথা বলছেন। মোহন ভাগবত যুক্তি দিয়েছেন, হিন্দুদের একজোট করার অর্থ ইসলামের বিরোধিতা নয়।
কংগ্রেস বা ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির হাতে কি এই হিন্দু রাষ্ট্রের প্রচারের বিরুদ্ধে কোনও কার্যকর হাতিয়ার রয়েছে?
বিজেপি নেতৃত্ব প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, কংগ্রেস বলুক, তারা হিন্দু শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে নয়। কংগ্রেস বলুক, তারা পাকিস্তান-আফগানিস্তান-বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলিমদের আশ্রয় দেওয়ার পক্ষে। লোকসভা ভোটের আগে মন্দিরে মন্দিরে ঘুরে নিজেকে পৈতেধারী শিবভক্ত বলে তুলে ধরা রাহুল গাঁধীর পক্ষে এই চ্যালেঞ্জ নেওয়া কঠিন। এক দিকে নরম হিন্দুত্বের রাজনীতি, অন্য দিকে মুসলিম তোষণ— বিজেপির হাতে দু’দিক থেকেই আক্রমণ করার অস্ত্র মজুত রয়েছে।
হিন্দু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে পাল্টা লড়াইয়ে নামা দূরে থাক, কংগ্রেস এখনও সাড়ে পাঁচ বছর আগে ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে অস্তিত্বের সঙ্কটের প্রশ্ন থেকেই বেরিয়ে আসতে পারেনি। প্রধান বিরোধী দলের দুর্বলতা দেখে বিরোধী নেতানেত্রীরাও কংগ্রেসকে নেতৃত্ব ছেড়ে দিতে রাজি নন। রাজ্যওয়াড়ি বিধানসভা ভোটে মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, রাজস্থানের পর মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ডও বিজেপির হাতছাড়া হয়েছে। হরিয়ানাতেও বিজেপি ধাক্কা খেয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্তরে মোকাবিলা হলে বিরোধী শিবির যে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ধারেকাছে আসতে পারছে না, তা ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে স্পষ্ট। বিরোধীরা এমন এক ‘ওয়ান ম্যান শো, টু ম্যান আর্মি’-র মুখোমুখি, যাঁরা কোন দিক থেকে আক্রমণ করবেন, তা বিরোধীরা আঁচই করতে পারেন না।
সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন-এনআরসি’র বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের প্রতিবাদের থেকে কংগ্রেস দূরত্ব বজায় রাখবে, না তার লাগাম নিজের হাতে নিতে চাইবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। কংগ্রেস বিজেপির হিন্দুত্বের মোকাবিলা করবে, না অর্থনীতির সঙ্কটে গরিব মানুষের সমস্যা নিয়েই সরব হবে, তা নিয়েও শীর্ষনেতৃত্বে দ্বিধা। অর্থনীতির বেহাল দশার বিরুদ্ধে জনসভা ডেকে রাহুলের ‘আমি রাহুল সাভারকর নই, রাহুল গাঁধী’ হুঙ্কারেই তা স্পষ্ট।
কংগ্রেস নেতাকর্মীরা এক সময় ভাবতেন, রাহুল গাঁধী দলের শীর্ষপদে এলেই দল ফের পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠবে। সে আশা আর নেই। প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরাকে নিয়েও দীর্ঘদিনের ‘মিথ’ ছিল, তাঁর হাতে জাদুকাঠি রয়েছে। প্রিয়ঙ্কা সক্রিয় রাজনীতিতে নেমে পড়তে সেই মিথও উধাও। বাকি পড়ে থাকে শুধু কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষ মতাদর্শ। কিন্তু সঙ্ঘ যে গতিতে হিন্দু রাষ্ট্রের দিকে এগোচ্ছে, তার বিপক্ষে কংগ্রেস বা বিজেপি-বিরোধী অন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি পাল্টা ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের ভাবনা তুলে ধরতে পারছে কি? উত্তর, না।
সংসদের শীতকালীন অধিবেশনের সময়ই দুই বিজেপি সাংসদ রবি কিশন, গোপাল নারায়ণ সিংহ সাফ বলে দিয়েছেন, ভারতকে এখনই হিন্দু রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করে দেওয়া উচিত। সঙ্ঘের নেতারা বলছেন, হিন্দু রাষ্ট্রে ভয় পাওয়ার কী আছে? যাঁরা ভারতে রয়েছেন, তাঁরা সকলেই হিন্দু। তাঁর ধর্ম যা-ই হোক! এ দেশে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ বলেই এখনও গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা টিকে রয়েছে। মহাত্মা গাঁধী থেকে সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন বার বার স্পষ্ট করেছেন, হিন্দু শব্দ দিয়ে কোনও ধর্মকে বোঝানো হয় না। আসলে এ এক শাশ্বত সংস্কৃতি। গাঁধীজি যে ‘রাম রাজ্য’-এর কথা বলেছেন, তার সঙ্গে হিন্দু রাষ্ট্রের বিশেষ ফারাক নেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের এক মঞ্চে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। বিরোধীরা আগেও এক মঞ্চে এসেছেন। কিন্তু তাঁরা কী ভাবে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ তথা সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্বের মোকাবিলা করবেন, কী যুক্তি সাজাবেন, তা স্পষ্ট হয়নি। এনআরসি-র বিরোধিতায় নরেন্দ্র মোদী কিছুটা কৌশলগত নরম সুর নিলেও হিন্দুত্বের পথ থেকে যে মোদী-শাহ সরবেন না, তা বলাই বাহুল্য।
হিন্দুত্বের চাঁচাছোলা ভাষায় বিরোধিতা করতে পারেন বামপন্থীরা। বিজেপি নেতারা তা জানেন। তাঁরা টের পাচ্ছেন, নাগরিকত্ব আইন-এনআরসি-র বিরুদ্ধে প্রতিবাদে পুরোভাগে বামপন্থী উদারমনস্করাই। আর তাই নরেন্দ্র মোদীকে দিল্লির রামলীলা ময়দানে দাঁড়িয়ে কোনও এক প্রকাশ কারাটকে নিশানা করতে হয়। কিন্তু রাজনৈতিক ভাবে বাম দলগুলি এখন কোণঠাসা। বাংলায় তাঁদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াই চলছে।
১৯২৫-এ আরএসএস-এর সঙ্গেই একই বছরে এ দেশে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। একশো বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সিপিএম-সিপিআইয়ের ‘লাল কিলে পর লাল নিশান’-এর স্বপ্ন এখন ফিকে। সমবয়সি আরএসএস লালকেল্লায় গেরুয়া পতাকা ওড়ানো সময়ের অপেক্ষা বলে মনে করছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy