প্রতিহত করো, হে জনতা, প্রতিহত করো।
ঔপনিবেশিকদের লুণ্ঠন প্রতিহত করো
এবং অনুসরণ করো শহিদের কাফেলা।
২০১৫ সালে নিজের লেখা এই কবিতাটি ইউটিউবে পাঠ করেছিলেন প্যালেস্তিনীয় কবি (আরবি ভাষার) ও চিত্রগ্রাহক দারিন তাতাউর। আর সেই অবধি একটি মুহূর্তও তিনি রাষ্ট্রের রক্তচক্ষু থেকে অব্যাহতি পাননি। দারিনের বয়স এখন ছত্রিশ। তিনি নাজারেথ (ইজ়রায়েল)-এর কাছে রেইনে অঞ্চলের বাসিন্দা। ২০১৫ সালেই অক্টোবরে দারিন প্রথম গ্রেফতার হন। কয়েক মাস বন্দি থাকেন। ২০১৬ সালে ছাড়া পেলেও তেল আভিভে আরও চার মাস গৃহবন্দি ছিলেন। সেই সময় ফোন, ইন্টারনেট সহ সমস্ত যোগাযোগের মাধ্যম তাঁর আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। শেষের দিকে কোনও আত্মীয় সঙ্গে থাকলে সপ্তাহান্তে মাত্র দু’ঘণ্টার জন্য বাইরে বেরোতে দেওয়া হত দারিনকে। কারণ ইজ়রায়েল সরকারের ভাষায় এই মহিলা নাকি জনগণের নিরাপত্তার পক্ষে ক্ষতিকারক। গত ৩১ জুলাই বিচারে দারিনের পাঁচ মাসের কারাদণ্ড হয়েছে।
দারিনের বিরুদ্ধে পুলিশের অভিযোগ ছিল, তিনি সন্ত্রাসবাদকে উস্কানি দিয়েছেন এবং সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তাঁর কবিতা ‘ক্বায়েম ইয়া শাবি, ক্বায়েমাহুম’ এক পুলিশ অফিসার অনুবাদ করেছেন আর সেটাই প্রমাণ হিসাবে দাখিল করা হয়েছে আদালতে। বলা হয়েছে, এই কবিতার বিষয়বস্তু হিংসার পরিবেশ এবং সন্ত্রাসের কারবারিদের ইন্ধন জোগাবে। দ্বিতীয় অভিযোগ, তিনি প্যালেস্তিনীয় ‘যুদ্ধবাজ’ সংগঠন ‘ইসলামিক জিহাদ’কে সমর্থন জানিয়েছেন। তৃতীয় অভিযোগ, দারিন এক আরব ইজ়রায়েলি মহিলার ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছেন, যিনি ‘ছুরি নিয়ে আস্ফালন’-এর অপরাধে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। ছবির ক্যাপশন, ‘আমিই পরবর্তী শহিদ।’
আলোচ্য কবিতার শব্দমালা আমাদের নিঃসন্দেহে প্যালেস্তিনীয়-ইজ়রায়েলি সংঘাতের আবহে টেনে আনে। কিন্তু দারিনের দাবি, তাঁর কবিতার ভুল অর্থ করা হয়েছে। তাঁর আইনজীবী গ্যাবি ল্যাস্কি বার বার বলার চেষ্টা করেছেন, যে কবিতাটি আসলে কবির মনের এক শৈল্পিক প্রকাশ, একে ‘হিংসা’র পর্যায়ে ফেলা যায় না। আরও বলেছেন, “আদালতের এই রায় বাক্স্বাধীনতা এবং অনুভূতি প্রকাশের অধিকার খর্ব করছে; ইজ়রায়েলে বসবাসকারী সংখ্যালঘু প্যালেস্তিনীয়দের সাংস্কৃতিক অধিকারও লঙ্ঘন করা হচ্ছে।’’ এর আগেও দারিনের লেখা দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে: দ্য ফাইনাল ইনভেশন ও দি আটলান্টিক ক্যানারি টেলস। কারান্তরালে থাকার সময় লিখেছেন, আ পোয়েট বিহাইন্ড দ্য বারস। ইংল্যান্ড থেকে তাঁর একটি অনূদিত কবিতার বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে, আ ব্লেড অব গ্রাস। এ সবের জন্য তাঁকে সরাসরি রাষ্ট্রযন্ত্রের কোপে পড়তে হয়নি। তবে প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে তাঁর উপন্যাস, মাই ডেনজারাস পোয়েম। দারিনের বক্তব্য, এই বই তাঁকে করা অনেক প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর দেবে।
একশো পঞ্চাশ জন আমেরিকান লেখক কবি-সহ সারা পৃথিবীর সাহিত্যকর্মীরা দারিনের কারাদণ্ডের তীব্র বিরোধিতা করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন এলিস ওয়াকার, ক্লাউদিয়া র্যাঙ্কিন, নাওমি ক্লেইন। এঁরা সবাই ‘পুলিতজ়ার’ পুরস্কার জয়ী। আসলে ইজ়রায়েল সরকার গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার প্যালেস্তিনীয় কবি, সাহিত্যিকদের বন্দি করে চলেছে। অনেককে হত্যাও করেছে বলে অভিযোগ। ঘাসান কানাফানি, মাজেদ আবু শারার, কামাল নাসের প্রমুখ সেই নিহতের তালিকায় আছেন। নির্বাসিত হয়েছেন মহম্মদ দারউইশ। দারিন এই নিগৃহীতের ধারাবাহিকতায় নবতম সংযোজন। বিবিসি-র জেরুজ়ালেমের প্রতিনিধি ইওলান্দে নেল তাই বলেছেন, “দারিনের বিষয়টি বাক্স্বাধীনতার অধিকারের প্রসঙ্গেই সকলের কাছে পরিচিত। এই গ্রেফতারির ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রতিক কালে ‘অধিকৃত ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে’ কী বিপুল হারে ইজ়রায়েলি আরব ও প্যালেস্তিনীয় সাহিত্যিকদের বন্দি করা হচ্ছে।’’ পেন ইন্টারন্যাশনাল-এর প্রেসিডেন্ট জেনিফার ক্লিমেন্ট বলেছেন, “আজ পেন দারিন তাতাউরের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমরা তাঁর যন্ত্রণাকাতর কারাজীবন, বিচার, গৃহবন্দিত্ব সম্পর্কে জানি, এও জানি যে তিনি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবি তোলেন। আমরা তাঁর মুক্তির দাবি জানাই।’’
দারিনকে ইজ়রায়েলিদের উপর হামলার প্রেরণাদাত্রী হিসাবে দেখানো হচ্ছে। তাঁর অভিযোগ, তাঁকে ‘শারীরিক নির্যাতন ও ধর্ষণ’ করা হয়েছে। দারিন বলেছেন, ‘‘অপরাধীরা আমার গ্রেফতারে ইন্ধন জুগিয়েছে, ইজ়রায়েলি কর্তৃপক্ষ সেই কাজ শেষ করেছে। কিন্তু এদের কেউ আমার কবিতা থামাতে পারেনি।’’ তাঁর কবিতার ভাষায়, “জেরুজ়ালেমে বসে আমি আমার ক্ষতস্থানে প্রলেপ দিয়েছি আর নিজের যন্ত্রণার মধ্যে শ্বাস নিয়েছি/ এবং আমার হৃদয়কে আমি বহন করেছি হাতের তালুতে।/ আমি কখনও পতাকা নামিয়ে রাখিনি।’’ দারিনের কবিতার পতাকায় আসলে শহিদের রক্ত লেগে আছে। কোন শহিদের কথা বলব? হতে পারে সে কিশোর মহম্মদ আবু খাদির, যাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে মারা হল। হতে পারে হাদিল আল হাসলামাউন, যে আঠারো বছরের তরুণকে গুলি করে খুন করা হল। অথবা সেই আঠারো মাসের শিশু আলি দাওয়াবসেনও হতে পারে, যাকে তার মা বাবার সঙ্গে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেওয়া হল। দারিনের চোখে, “এরা সকলেই শহিদ’’। এদের হত্যা করেছে যে ইজ়রায়েলি হানাদাররা, তাদের দেখিয়ে তাই দারিন বলেন, “হে আমার বিদ্রোহী জনতা, তোমরা প্রতিহত করো!’’
দারিন মনে করেন, তাঁর বিচারের পুরোটাই রাজনৈতিক। তাঁর ভাষায়, “আমি বন্দি কারণ আমি প্যালেস্তিনীয়।’’ তিনি নির্দ্বিধায় জানিয়ে দেন, “আমি কারাদণ্ডই আশা করেছিলাম, সুবিচার নয়।’’ কেন নয়? কারণ ‘‘এটি ইজ়রায়েলি কোর্ট আর ইজ়রায়েলি কোর্টে প্যালেস্তিনীয় অভিযুক্ত সুবিচার পেতেই পারে না।’’ তাঁর বক্তব্য ঠিক কি না, আমাদের জানা নেই। তবে এটা সারা পৃথিবী জানে, যে ‘আরব-ইজ়রায়েল’ যুদ্ধের পর থেকে ইজ়রায়েলে বসবাসকারী প্যালেস্তিনীয় নাগরিকদের বিন্দুমাত্র শান্তি নেই, স্বাধীনতা নেই। অথচ তাঁরা এখন ইজ়রায়েলের মোট জনসংখ্যার কুড়ি শতাংশ অধিকার করে আছেন। আর ‘নিজভূমে পরবাসী’ হিসাবে ‘জিয়োনিস্ট মিলিশিয়া’র তাড়া খাওয়া সেই সাত লক্ষ প্যালেস্তিনীয় তো অবর্ণনীয় দুর্ভাগ্যের শিকার। ইজ়রায়েল ঠিক করছে কি করছে না, আমেরিকা কার পক্ষ নিচ্ছে, ‘অধিকৃত অঞ্চল’-এর ঠিক চিত্রটা কী— এই সব প্রশ্ন নিয়ে অনেক বিতর্ক চলতে পারে। কিন্তু এ কথা অনস্বীকার্য, পৃথিবীর উদ্বাস্তু মানচিত্রে একা প্যালেস্তাইনই তুলে দিয়েছে পাঁচ কোটি বাস্তুহারা মানুষ, যাঁরা একটা স্থায়ী ঠিকানা খুঁজে পাচ্ছেন না।
তবু পরাধীনতার ওই বদ্ধ জীবনে দারিনরা চিরকালই দু-একটি জানলা খুলে রাখেন। সেই জানলা দিয়ে সত্য দেখার চেষ্টা থেকে যায় চরম আকালেও। হত্যা, নির্বাসন, কারাদণ্ড যে দারিনদের খোলা জানলা কিছুতেই বন্ধ করতে পারে না, সে কথা আমরা ভারতীয়রা ভালই জানি। তাই আমরা নতজানু হচ্ছি সেই বন্দি কবির সামনে, যিনি তাঁর ‘ফাইনাল চ্যাপ্টার’-এ কিছু দিন আগেই লিখেছিলেন— ‘‘আমাকে ছেড়ে দেওয়া হবে না কারাদণ্ড, এ প্রশ্ন আমি করতেই পারি। তবে পরিশেষে এটাই বলব, সিদ্ধান্ত যাই হোক, আমি শেষটা করব মুক্ত হয়েই!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy