Advertisement
৩০ জানুয়ারি ২০২৫

ভারতের মুসলিম আধুনিকতাবাদী

দালোয়াইয়ের লিখিত প্রবন্ধ ‘ইতিহাসের বোঝা’ (১৯৬৮) আজও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান অনুদার গণতান্ত্রিক পরিবেশে এই প্রবন্ধ ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ের জন্যই বিশেষ ভাবে স্মরণীয়।

পঙ্কজ কুমার চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৭ নভেম্বর ২০২০ ০০:০১
Share: Save:

রামচন্দ্র গুহ তাঁর মেকার্স অব মডার্ন ইন্ডিয়া বইয়ে হামিদ দালোয়াইকে ভারতের ‘শেষ আধুনিকতাবাদী’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। অধিকাংশ ভারতীয়ের কাছেই নামটা অচেনা। ১৯৩২ সালে তাঁর জন্ম এক শ্রমজীবী মুসলমান পরিবারে, ১৯৭৭-এর মৃত্যু। দালোয়াইয়ের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল ভারতীয় মুসলিমদের গণতন্ত্র এবং আধুনিকতার প্রতি মনোভাব পরিবর্তন করা। ১৯৭০ সালে তিনি মুসলিম সত্যশোধক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। এই নতুন সংগঠন মুসলিম মহিলাদের অধিকার উন্নয়নে ব্রতী হয়। এই সংগঠনের প্রয়াসের মধ্যে ছিল আইন এবং প্রথার মাধ্যমে তিন তালাক প্রথার অবলোপ করা। তিনি সব ভারতীয়ের জন্য অভিন্ন দেওয়ানি বিধির প্রবক্তা ছিলেন। তিনি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে মানুষের জীবনে সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ দূর করতে চেয়েছিলেন।

দালোয়াইয়ের লিখিত প্রবন্ধ ‘ইতিহাসের বোঝা’ (১৯৬৮) আজও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান অনুদার গণতান্ত্রিক পরিবেশে এই প্রবন্ধ ভারতীয় হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ের জন্যই বিশেষ ভাবে স্মরণীয়। “কোনও ব্যক্তি বা সমাজের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ সর্বদা আসে না। দেওবন্দের উলেমার চাপে নতি স্বীকার করে হিন্দুদের সঙ্গে একযোগে ইংরেজি শিক্ষার মাধ্যমে আধুনিকতাকে গ্রহণ করার প্রথম সুযোগ মুসলিম সমাজ হারায়। কিছু কাল বাদে ইতিহাস তাদের আর একটি সুযোগ এনে দেয়। তা হল ভারতীয় জাতীয়তাকে বলীয়ান করতে হিন্দুদের সঙ্গে পা মেলানো। কিন্তু, হিন্দু এবং মুসলিম সমাজ যে স্বতন্ত্র এবং সমান্তরাল, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে তারা সেই সুযোগও হারায়।”

তাঁর মনে হয়েছিল, এ এক দুঃখের বিষয় যে “ভারতের মুসলিম যুবসমাজে যুক্তিবাদী আত্মসমালোচক শ্রেণির অস্তিত্ব নেই। হিন্দু সাম্প্রদায়িকতা যদি মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার কারণ হয়, তা হলে একই ভাবে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার জন্য দায়ী।” এই বিরল সংস্কারকের মতে, মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা এখনও সমান্তরাল সমাজের ধারণা পরিহার করতে পারেননি, রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক করতে শেখেননি। তাঁদের কাছে ‘মুক্তি’র ধারণা হল ভারতের মুসলিম সমাজের কাঠামোকে অপরিবর্তিত রাখা। এই কারণে ভারতের মুসলিম সমাজের একাংশ বর্তমান কাঠামোতেও মুসলিমত্বকে একটি মৌলিক জাতির মতো অপরিবর্তনীয় রাখার চেষ্টা করেন।

তাই আশা রাখতে হবে, ভারতীয় মুসলিম সমাজের তরুণ প্রজন্মের উপরেই। তাঁরা কি এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করবেন? দালোয়াই ভেবেছিলেন, এখানেই ভারতীয় মুসলমান সমাজের মুক্তি এবং আধুনিকীকরণের তৃতীয়, হয়তো শেষ, সুযোগ। তাঁদের সমস্যার কার্যকর সমাধানের একমাত্র উপায় হল ইতিহাসের সংস্কারগুলিকে সম্পূর্ণ ভাবে পরিহার করা। ইতিহাস এবং ঐতিহ্যপ্রসূত ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্ত হলেই তাঁরা মানবিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ মুক্ত, আধুনিক মননের ধারণায় পৌঁছতে পারবেন।

সর্বজনীন ভারতীয় জাতীয়তার জন্য মুসলিম সমাজকে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সমাজের অঙ্গীভূত হতে হবে। “এই লক্ষ্যে পৌঁছতে দরকার সর্বাগ্রে আধুনিক, উদার ও ধর্মনিরপেক্ষ এক ক্ষুদ্র শ্রেণি গঠন করা। আমার মতো মানুষেরা বস্তুত এই চেষ্টাই চালাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি যে ধর্ম কোনও আদর্শ সমাজের ভিত্তি হতে পারে না। এর অর্থ, হিন্দু বা মুসলিম কোনও ধর্মই আদর্শ সামাজিক বিন্যাসের উপকরণ হতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে মুসলিম সমাজ সমান অধিকার এবং সুযোগ দাবি করতে পারে। কিন্তু, তারা বিশেষ মর্যাদা বা সুবিধা দাবি করতে পারে না। আমি বিশ্বাস করি যে কাশ্মীর ভারতের অঙ্গ; ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রত্যেক পাকিস্তানি আগ্রাসনকে বলিষ্ঠ প্রত্যাঘাতের মাধ্যমে জবাব দিতে হবে।”

আর একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন দালোয়াই। “হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে মোকাবিলা করার চেষ্টাকে আমি আত্মঘাতী বলে মনে করি। হিন্দুরা অধিকতর মাত্রায় সামাজিক উন্নতি এবং আধুনিকীকরণ অর্জন করলেই মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে পরাজিত করতে পারবে। হিন্দুদের আরও অস্বচ্ছ এবং আরও গোঁড়া হতে দিলে মুসলিম সাম্প্রদায়িকতাকে কোনও দিনই দূর করা যাবে না। আমি হিন্দু বা মুসলিম সব ধর্মেরই মধ্যযুগীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে।” আজকের পরিপ্রেক্ষিতেও এই কথা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। ভারতীয় সমাজের গরিষ্ঠ হিন্দুদের অগ্রগতি এবং শক্তিবৃদ্ধি হলেই দেশের অন্যান্য সমাজও উন্নতির পথে এগিয়ে যাবে। দালোয়াইয়ের সতর্কবার্তা এই প্রসঙ্গে স্মরণীয়: “আমি আরও জোরের সঙ্গে বলতে চাই যে, হিন্দুরা যদি ধর্মকে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় তা হলে তারা মুসলিমদের গোঁড়া বিশ্বাসের নিগড় থেকে মুক্ত করতে পারবে না। তাই মুসলিমদের আধুনিকীকরণ হিন্দুদের আধুনিক হওয়ার উপরই নির্ভরশীল।”

আসলে, কোনও সমাজের মধ্যে ইতিহাসসৃষ্ট কুসংস্কার এবং শত্রুতার থেকে সমাজকে মুক্ত করার কাজটা কঠিন, কিন্তু আবশ্যিক। কে কী ভাবে তা করছেন, তার উপরই সমাজের গতি নির্ভর করে। ভারতীয় মুসলিম সমাজ যত তাড়াতাড়ি তা অনুধাবন করবে, ততই তাদের মঙ্গল— বলে গিয়েছিলেন হামিদ দালোয়াইরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy