অলিখিত নীতিটি হইল, রাজ্যপালকে দেখা যাইবে, কিন্তু শোনা যাইবে না। তাঁহার যদি একান্তই কিছু বক্তব্য থাকে, তবে সেই কথাটি তিনি সন্তর্পণে সরকারকে জানাইবেন। অসীম দুর্ভাগ্য, পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল এই নীতিটিকে সম্মান করিতে একেবারেই নারাজ। রাজভবনে অধিষ্ঠিত হওয়া ইস্তক তিনি রাজ্য সরকারের সহিত তাঁহার বিরোধের কথা, বিভিন্ন ঘটনায় তাঁহার ‘অপমানিত’ হইবার কথা ইত্যাদিকে ক্রমাগত গণপরিসরে লইয়া আসিয়াছেন। কোভিড-১৯ অতিমারির আবহও তাঁহাকে দমাইতে পারে নাই, বরং লকডাউনের কুবাতাসে তাঁহার এই বিচিত্র প্রবণতা যেন আরও উত্তেজিত। এত দিন অবধি রাজনীতির ঊর্ধ্বে থাকিবার যে ভঙ্গিটুকু তিনি বজায় রাখিতেছিলেন, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সহিত সাম্প্রতিকতম পত্রযুদ্ধে সেই আব্রুটুকুও উধাও! সংখ্যালঘু তোষণের প্রসঙ্গ টানিয়া কার্যত সরাসরি রাজনৈতিক তরজায় নামিলেন তিনি। বলিবার কারণ আছে— বিজেপি নেতাদের সহিত অতঃপর তাঁহার ফারাক মাত্র ইহাই যে, তাঁহারা বিবিধ মঞ্চে বা দলীয় কার্যালয়ে বসিয়া রাজনৈতিক বিষোদ্গার করেন, আর শ্রীধনখড় তাহা করেন রাজভবনের অন্দরমহল হইতে। মহামান্য রাজ্যপাল কি ভুলিয়াছেন যে— রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি যে পদাধিকারবলে ‘পরামর্শ’ দিয়া চলিয়াছেন, সেই পদে থাকিবার আবশ্যিক শর্তই হইল পূর্বাশ্রমের রাজনৈতিক আনুগত্য অতিক্রম করা? সম্পূর্ণ সংবিধান-বহির্ভূত ভাবে চলিয়া তিনি রাজভবনকে দলীয় রাজনীতির ক্লিন্নতায় নামাইয়া আনিলেন না কি?
চিঠিতে দস্তখত রাজ্যপালের। কিন্তু, চিঠির বক্তব্য তাঁহার নহে, এমন সন্দেহ অহেতুক বলা যায় কি? বিরোধী রাজনৈতিক দল-শাসিত রাজ্যে রাজ্যপালকে কেন্দ্রীয় সরকারের আয়ুধ হিসাবে ব্যবহার করিবার প্রবণতাটি এই দেশে নূতন নহে। এক কালে ইন্দিরা গাঁধীও একাধিক রাজ্যে এই কাজটিই করিয়াছিলেন। নরেন্দ্র মোদীর আমলেও বারংবার এই ঘটনা ঘটিতেছে। গত ছয় বৎসরে বিভিন্ন রাজ্যের রাজ্যপালকে ন্যক্কারজনক ভাবে ‘ব্যবহৃত’ হইতে দেখা গিয়াছে— বিশেষত, রাজ্যের জননির্বাচিত সরকার ফেলিয়া বিজেপির সরকার গঠনের ক্ষেত্রে। বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও রাজভবন নয়াদিল্লির অঙ্গুলিহেলনে পরিচালিত হইতেছেন বলিয়া সন্দেহ অসঙ্গত নহে। রাজ্যপালের চিঠির বয়ানটি প্রসঙ্গত প্রণিধানযোগ্য। বিজেপি নেতারা নিজামুদ্দিন মারকাজ়ের ঘটনাটিকে যে ভাবে ব্যবহার করিতেছেন, শ্রীধনখড়ের চিঠিতে কার্যত একই ভাবে সেই ঘটনার উল্লেখ রহিয়াছে। ক্ষুদ্রস্বার্থসর্বস্ব রাজনীতিক যে ভাষায় কথা বলেন, রাজ্যপালের চিঠিতে অবিকল সেই ভাষা দেখিয়া আশঙ্কা হয়, রাজভবনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করিবার খেলায় হয়তো ইহা নূতন ধাপ— অতঃপর আর রাখঢাকের বালাই রাখা হইবে না। রাজভবন আর মুরলীধর সেন লেনের মধ্যে কেবল সওয়া দুই কিলোমিটারের ভৌগোলিক দূরত্বটুকুই অবশিষ্ট থাকিবে।
এই অবাঞ্ছিত পত্রযুদ্ধের কার্যকারণ যাহাই হউক না কেন, শ্রীধনখড়ের নাম রাজ্যের ইতিহাসে চিরস্থায়ী হইল। তাহা সুনাম নহে। পশ্চিমবঙ্গে যখন অতিমারির কবলে ত্রস্ত, বিধ্বস্ত, রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হিতাহিতজ্ঞান বিসর্জন দিয়া অশোভন এবং বিপজ্জনক তরজায় নামিলেন। ক্ষুদ্র রাজনীতির তাড়নায় ভুলিলেন যে, এই সময়টি স্বার্থসিদ্ধির নহে, সম্মিলিত ভাবে মানুষের স্বার্থরক্ষার কাজে আগাইয়া আসিবার।। রাজ্য প্রশাসনের বিরুদ্ধে কোনও বক্তব্য থাকিলেও এই সময়ে তাঁহার একমাত্র কর্তব্য ছিল, রাজ্য প্রশাসনের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ানো। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিরোধ বা দৃ্ষ্টিভঙ্গির পার্থক্য থাকিলেও যুদ্ধকালীন সময়ে সেই বিরোধ ভুলিতে হয়। আর শ্রীধনখড়ের পদটি রাজনৈতিক নহে, সাংবিধানিক।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy