কথাটা হচ্ছিল দক্ষিণ কলকাতার এক ওষুধের দোকানে, কয়েক সপ্তাহ আগে। দোকানের মালিক বলছিলেন যে নোটবন্দির পর থেকে তাঁর দৈনিক বিক্রি প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমেছে, এবং এই হারে চললে কিছু দিন বাদে কমে তা অর্ধেকে দাঁড়াবে। বললেন, আশপাশের সব দোকানেরই এক অবস্থা। অনেকেই ভাবছেন দোকানের কর্মচারী ছাঁটাই করার কথা। “কিন্তু ওষুধ ছাড়া লোকের চলছে কী করে?” তাঁর মন্তব্য, “খেতে পেলে তবে তো ওষুধ কিনবে!”
নেহাতই এক জনের অভিজ্ঞতা এবং মতামত। কিন্তু এর মধ্যে দিয়ে কেন্সের সামগ্রিক চাহিদার তত্ত্বের মূল যুক্তিটা পরিষ্কার ধরা পড়ে। আয় কমলে ভোগ্যদ্রব্যের চাহিদা কমে, ভোগ্যদ্রব্যের চাহিদা কমলে ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাটা পড়ে, তখন সেখানে বিনিয়োগ কমা এবং কর্মীদের ছাঁটাই করার প্রবণতা বাড়ে, যার ফলে সাধারণ মানুষের আয় কমে, যার ফলে চাহিদা আরও কমে— এই হল মন্দার বাজারে কেন্সীয় বিষচক্র। এর থেকে বেরোনোর উপায়? সরকার ব্যয় বৃদ্ধি করলে (বা করের বোঝা কমালে) মানুষের আয় বাড়বে, তার থেকে ভোগ্যদ্রব্যের চাহিদা বাড়বে, আর অর্থনীতির পালে হাওয়া লাগবে, তার থেকে বেসরকারি ক্ষেত্রেও বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু মুশকিল হল, এর ফলে বাজেটের ঘাটতি এবং মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়বে। তা ছাড়া সরকারের ঋণের বোঝা এমনিতেই যথেষ্ট বেশি, তাই আরও ঋণ নেওয়ার পথও সীমিত।
পরিসংখ্যানও বলছে, ভারতীয় অর্থনীতির অবস্থা বেহাল। মূল্যবৃদ্ধির হার বাদ দিয়ে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধির হার (রিয়াল গ্রোথ রেট) যদি দেখি, সেটা গত আর্থিক বছরে কমে দাঁড়িয়েছে ৪.৯%। এক বছর আগে এই হারের যে আগাম হিসেব সিএসও (সেন্ট্রাল স্ট্যাটিসটিকাল অফিস) দিয়েছিল, তা ছিল ৭%, এবং তখনও বলা হচ্ছিল, সেটা বিশ্বের সর্বাধিক বৃদ্ধির হারের মধ্যে পড়ে। বর্তমান হিসেব অনুযায়ী এক দশকেরও বেশি আগে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সঙ্কটের সময়ের পর এটাই সর্বনিম্ন বৃদ্ধির হার। আর সরকারি রাজস্ব এবং ব্যয় যেহেতু বর্তমান মূল্যের ভিত্তিতেই হয়, তাই মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ না করে যদি জাতীয় আয়ের আপাত বৃদ্ধির হার দেখি, তা হল ৭.৫%, যা ১৯৭৮-এর পরে নিম্নতম। বৃদ্ধির হার নিয়ে বড়াই করা বা বাড়িয়ে বলার সমস্যা হল, কোনও না কোনও সময় তো সরকারের নিজস্ব আয়-ব্যয়ের হিসেবও করতে হয়, তখন যদি রাজস্ব বৃদ্ধির হার সন্তোষজনক না হয়, বাজেটের সব হিসেবও তালগোল পাকিয়ে যাবে। তাই এই মুহূর্তে সরকার যে আর্থিক সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে তার জন্যে অতি বড় সমালোচকও সহানুভূতিশীল হতে বাধ্য— যতই হোক, দেশের অর্থনীতির সমস্যার প্রভাব সবার ওপরে পড়ে।
কিন্তু সমস্যাটার গুরুত্বটা পুরোপুরি স্বীকার না করলে সমাধান পাওয়া মুশকিল। এই প্রসঙ্গে সরকারি বা সরকারের পরামর্শদাতা অর্থনীতিবিদদের কিছু কিছু উক্তি কানে আসছে, যা খুব একটা ভরসা জোগাচ্ছে না। কেউ বলছেন, এ তো বাণিজ্যচক্রের ওঠাপড়া; কেউ বলছেন, সারা পৃথিবী জুড়েই তো বৃদ্ধির হার কমেছে; কেউ আবার বলছেন, দেশের বৃদ্ধি তখনই তো হবে যদি রাজ্যগুলোর বৃদ্ধি হয়। যা পড়ে, কাল না হোক পরশুর পরের দিন সেটা উঠবে, এটা যেমন সত্যি, তেমনই টানা আঠারো মাস দেশে বৃদ্ধির হার ক্রমাগত নিম্নগামী, গত আড়াই দশকে তার সমতুল্য উদাহরণ খুঁজে পাওয়া মুশকিল— এটাও সমান সত্যি। আর সত্যিই কি সর্বত্র বৃদ্ধির হার নিম্নগামী? ভারতের বৃদ্ধির হার আর সারা পৃথিবীর বা নিম্ন-আয়ের দেশগুলির গড় বৃদ্ধির হার তুলনা করলে দেখা যাবে যে ২০১৬ সালের পর থেকে ভারতের বৃদ্ধির হার আপেক্ষিক ভাবেও নিম্নগামী। আর রাজ্যগুলোর বৃদ্ধির হার দেশের বৃদ্ধির হারকে যে প্রভাবিত করে এ কথাটা তো সংজ্ঞা অনুযায়ীই সত্যি— যেমন সত্যি যে সারা দেশের আয়বৃদ্ধির হার শেষ বিচারে প্রতিটি নাগরিকের আয়বৃদ্ধির হারের ওপর নির্ভর করবে। সরকার তো আর মজন্তালী সরকার নয় যে শুধু হিসেব রাখবে, খাজনা আদায় করবে, আর ধমকধামক দেবে! এ নেহাতই খারাপ ফলাফলের মুখোমুখি হয়ে দায়িত্ব এড়াবার যুক্তি।
তা হলে করণীয় কী? প্রথমে সমস্যাটার গভীরতা বুঝতে হবে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (এনএসএস) ভোগ্যদ্রব্যের ওপর ব্যয়ের যে হিসেব পাওয়া যায়, তা অনুযায়ী ২০১১-১২ থেকে ২০১৭-১৮ সালের মধ্যে গড় মাথাপিছু জাতীয় ব্যয় কমেছে প্রায় ৪%। গ্রামাঞ্চলে এই হ্রাসের হার ৮.৮%, আর শহরাঞ্চলে স্বল্প (২%) হারে বৃদ্ধি হয়েছে। অথচ, ন্যাশনাল অ্যাকাউন্টস স্ট্যাটিসটিক্স (এনএএস) দফতরের হিসেব বলছে, গড় ভোগ্যদ্রব্যের ওপর ব্যয়ের বৃদ্ধির হার প্রায় ৬%। তা তো হতেই হবে, কারণ ভোগ্যদ্রব্যের ওপর ব্যয় জাতীয় আয়ের প্রায় ৬০%। তাই যেখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে (জাতীয় আয়ের ৩০%) বৃদ্ধির হার সর্বশেষ হিসেবে ১% হয়েছে, সেখানে ভোগ্যদ্রব্যের ওপর ব্যয় যথেষ্ট হারে না বাড়লে ৫% হারে জাতীয় আয় বাড়বে কী করে?
দুই সংস্থার কারও পরিসংখ্যানব্যবস্থাই যে সমস্যামুক্ত নয়, এ কথা সর্বজনবিদিত। কিন্তু সরকার শুধু এনএসএস-এর রিপোর্ট প্রকাশ করতে দেয়নি এর নানা সমস্যা আছে বলে। তা থাকতেই পারে, কিন্তু তার উত্তর তো রিপোর্টকে ধামাচাপা দেওয়া হতে পারে না! সন্দেহ থেকেই যায় যে রিপোর্টে দেশের অর্থনীতির যে ছবি বেরোচ্ছে তা মনোমতো না হওয়ার জন্যেই এই সিদ্ধান্ত— না হলে, এনএএস-এরও তো হাজার সমস্যা, তার ভিত্তিতে ৫% আয়বৃদ্ধির হারের কথা বলা হচ্ছে কেন?
দ্বিতীয়ত, এই দুই পরিসংখ্যান-শ্রেণির মধ্যে সাযুজ্যের অভাব থাকার একাধিক সম্ভাব্য কারণ আছে। তার একটা বড় কারণ হল দেশের অর্থনীতিতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপস্থিতি এবং পরিসংখ্যানে সেটার কী ভাবে মোকাবিলা করা হচ্ছে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ বা প্রত্যক্ষ করব্যবস্থার আওতার বাইরে এই যে ক্ষেত্র (যার মধ্যে কৃষিও পড়ে), সেখানে জাতীয় আয়ের প্রায় অর্ধেক উৎপাদিত হয়, আর শ্রমবাহিনীর প্রায় ৮৫% সেখানে নিয়োজিত। অথচ জাতীয় আয়ে এই ক্ষেত্রের অবদান পুরোটাই সংগঠিত ক্ষেত্রের পরিসংখ্যান থেকে অনুমান করে হিসেব করা হয়। এনএসএস যেহেতু সারা দেশের ওপর ভিত্তি করে পরিবারভিত্তিক সমীক্ষা, তাতে অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপস্থিতি অনেক বেশি ধরা পড়ে। উপযুক্ত নীতির আলোচনায় অসংগঠিত ক্ষেত্রকে ভুললে চলবে না।
সরকারি ব্যয়প্রসার অসংগঠিত ক্ষেত্রের উপর প্রভাবের কথা ভেবে করা প্রয়োজন। দেশবাসীর একটা বড় অংশ এখানেই নিয়োজিত, তাই সার্বিক জনকল্যাণের দিক থেকে তা কাম্য, শুধু সেই কারণে নয়। যেহেতু অসংগঠিত ক্ষেত্রে দরিদ্রতর মানুষ বেশি সংখ্যায় আছেন, বর্ধিত আয় থেকে তাঁদের খরচ করার প্রবণতা আরও বিত্তশালী শ্রেণির মানুষের থেকে বেশি, কারণ আয়ের সঙ্গে আনুপাতিক হারে সঞ্চয় করার প্রবণতাও বাড়ে। আর তাঁদের ব্যয়বৃদ্ধি হলে গণভোগ্য সামগ্রীর চাহিদা বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে সংগঠিত ক্ষেত্রের ওপরেও। তার থেকে বেসরকারি ক্ষেত্রে বিনিয়োগের বৃদ্ধির হার, যা বর্তমানে তলানিতে ঠেকেছে, তাও বাড়বে, এবং অর্থনীতি বিষচক্র থেকে মুক্ত হবে।
অনেকে বলছেন আয়করে ছাড় দেওয়ার কথা। আয়কর রাজস্ব জাতীয় আয়ের ২.৫ শতাংশের বেশি নয়, আর এর আওতায় পড়েন জনসংখ্যার বড়জোর ৩ শতাংশ। আর, করদাতাদের আয় অপেক্ষাকৃত ভাবে বেশি, তাই এর থেকে ব্যয় কতটা বাড়বে আর সঞ্চয় (বা, ঋণশোধ) কতটা বাড়বে, তা পরিষ্কার নয়। একই কথা প্রযোজ্য কোম্পানি করের ক্ষেত্রেও।
আর্থিক সংস্কার অবশ্যই চাই, যাতে উৎপাদনক্ষমতা বাড়ে, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি বৃদ্ধির সম্ভাবনা বাড়ে। কিন্তু অর্থনীতির গাড়ি যখন গাড্ডায় পড়ে, তখন স্বল্পমেয়াদি সরকারি নীতির প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত তাকে ঠেলে আবার রাস্তায় তোলা। রাস্তা মেরামত পরে হবে। কিছু সরকারি প্রকল্পে ব্যয়বৃদ্ধিতে দুটি উদ্দেশ্যই সাধিত হতে পারে, যেমন পরিকাঠামোর ওপর ব্যয়। কিন্তু তা ছাড়াও যে যে প্রকল্পে অসংগঠিত ক্ষেত্রে দরিদ্র মানুষের প্রত্যক্ষ ভাবে আয়বৃদ্ধি হয়, তার দিকে মনোনিবেশ করা দরকার, যেমন একশো দিনের কাজ। ব্যয়প্রসারের সুযোগ অপরিমিত নয়, মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা সদাবিরাজমান, তাই কতটা ব্যয়বৃদ্ধি করা যাবে আর কতটা বর্তমান বরাদ্দের মান ধরে রাখতে হবে, সেই সিদ্ধান্ত অর্থমন্ত্রককে বিবেচনার সঙ্গে করতে হবে।
সবার আগে অর্থনীতির গাড়িকে ঠেলে চালু করা চাই, আর তার জন্যে চাই অনেকের সম্মিলিত ধাক্কা।
লেখক অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক, লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy