Advertisement
২৫ নভেম্বর ২০২৪
আমরা সহস্র প্রাণ

‘একত্ব = আনুগত্য’ সমীকরণ তৈরির চেষ্টা করছে দেশের শাসক

প্রাচীন ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে স্থানীয় ভাষাই লাগে। এবং তেমন ভাষা একটাই, গোটা দেশে। ফ্রান্সকে যদি ফরাসিতে বা রাশিয়াকে যদি রুশ ভাষায় চেনে দুনিয়া, ভারতকে হিন্দিতে চিনবে না কেন?

আবাহন দত্ত
শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৩
Share: Save:

মোদী সরকারের তখন বছর দেড়েক বয়স। আমরা, যাদবপুরের এমএ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা, জানতে পারলাম যে বিপন্ন ও দেশীয় ভাষা সংরক্ষণের জন্য প্রকল্প চালু করছে সরকার। ভাল কথা— অনেক টাকা পাবে বিশ্ববিদ্যালয়, ছাত্রছাত্রীদের কাজের সুযোগ মিলবে। কিন্তু ধন্দও জাগল, বিজেপি সরকার তো কেবল সংস্কৃত আর হিন্দিকেই পোক্ত করতে চায় বলে জানতাম, তা হলে হঠাৎ বিপন্ন আর দেশীয় ভাষার প্রতি দরদ কেন? এক প্রবীণ মাস্টারমশাই বোঝালেন, ঐতিহ্যের সংরক্ষণের পিছনেও এক রকম রাজনীতি থাকে। ভারত রাষ্ট্রের কর্তারা যত বেশি করে তার প্রচুরতম ইতিহাসের ভাণ্ডার তৈরি করে বিশ্বের দরবারে মেলে ধরবে, তত বোঝা যাবে তার ভয়ানক প্রতাপ। শক্তিশালী জাতি তৈরির গোড়ার দিককার একটা শর্ত হল সুমহান গৌরবোজ্জ্বল স্বর্ণালি অতীত নির্মাণ। ইউরোপীয়েরা সে কথা কবেই বুঝেছে। আমরা ইতিহাস-সচেতন নই, এত দিন ডুবে মরেছি।এ বছরের মাঝামাঝি কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের তৈরি জাতীয় শিক্ষানীতির খসড়াতেও দেখা গেল ইংরেজি-বলা (উচ্চবিত্ত?) জনতাকে কটাক্ষ করে বলা হয়, তাঁদের ইংরেজিমুখী মানসিকতার জন্যই সমাজের নিচুতলার মানুষের প্রবেশ এত কঠিন। উপনিবেশের ভাষা রপ্ত না থাকায় বহু কর্মঠ-মেধাবী-শিক্ষিত যথাযোগ্য সুযোগ পাচ্ছেন না। ভাষার বর্তমান ক্ষমতা-কাঠামোকে ভেঙে সমাজ-শিক্ষা-কর্মসংস্থানে প্রকৃত সাম্য আনবে নয়া শিক্ষানীতি। আবারও, কথাগুলো ভাল, কিন্তু ইংরেজির বনাম হিসেবে আনা হল হিন্দি (যা নাকি ৫৪ শতাংশ দেশবাসীর বুলি), শিক্ষাব্যবস্থায় যে ভাষাকে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ে বহু সময় উত্তাল হয়েছে দেশ, বিশেষত অহিন্দিভাষী এলাকাগুলি।

এটুকু রাখঢাকও অবশ্য রাখেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ১৪ সেপ্টেম্বর হিন্দি দিবসে বলেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে হিন্দিকে সরিয়ে নেওয়া হলে সংগ্রামের আত্মাটাই বিনষ্ট হবে, কেননা প্রাচীন ভারতীয় দর্শন-সংস্কৃতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখতে স্থানীয় ভাষাই লাগে। এবং তেমন ভাষা একটাই, গোটা দেশে। ফ্রান্সকে যদি ফরাসিতে বা রাশিয়াকে যদি রুশ ভাষায় চেনে দুনিয়া, ভারতকে হিন্দিতে চিনবে না কেন?

অর্থাৎ, সুর চড়ল তিন ধাপে। এক, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি বাঁচিয়ে রাখতে দৈনন্দিনতায় আনতে হবে ভারতীয় ভাষাগুলিকে। দুই, তাদের মাথার ওপর অখিল ভারতের ছাতা বসানো হল, হিন্দির হিসেব মেলানোর চেষ্টা হল। এবং তিন, পালিশবিহীন ভঙ্গিতে, মন্ত্রী সে কথা বলেও ফেললেন। অবশ্য তাঁদের অভিভাবকেরা যে ভারতের স্বপ্ন দেখে, তাতে গোটা ভারতকে এক সুতোয় বাঁধার কাজটা লাগাতার করে যেতে হবে। সরু দাগে হোক বা মোটা দাগে।

২০১৯ জুড়ে সব রকম চেষ্টাই দেখলাম। গোড়ায় সুচের কাজ। সূক্ষ্ম কারুকলা। পরিকল্পনা করে ইতিহাস সাজানো, দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা, বিদ্যার্থীদের তা শেখানো। বুনন ঘন হতে হতে একটু গোদা ভাবে ছুরিও চালাতে হল। সংযোগ ভাষা শেখানোর নামে দেশের সব স্কুলে হিন্দি চালুর সুপারিশ। এই প্রকল্প সূক্ষ্ম তো নয়ই, নতুনও নয়। তাই বাধা এল, সরকার পিছু হটল। শেষে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-সঙ্কোচ ঝেড়ে ফেলে তরবারি চালালেন শাহ। লাভ অবশ্য তবুও হল না, প্রতিবাদ দৃঢ়তর হল।

তবে মোদী-শাহ যে হেতু হারার বান্দা নন, অতএব তিনটে ধাপই ভাল করে চিনে রাখা দরকার। আগামী বছরের লড়াইয়ে কাজে দিতে পারে।

জাতির বৌদ্ধিক উন্নয়নে গ্রন্থাগার বা অভিলেখাগার বা সংগ্রহশালার গুরুত্ব সন্দেহাতীত। কিন্তু শিক্ষার বিকাশ যদি এর এক পিঠ হয়, আর এক পিঠ সচেতন স্মৃতির নির্মাণ। অতীত-যাপনের নানা উপায় এখানে অপ্রতুল বলেই বঙ্কিমচন্দ্র বিরক্ত হয়ে ‘বাঙ্গালার ইতিহাস’ লিখেছিলেন। বিশ্বের তাবৎ উন্নত দেশে কেমন পায়ে পায়ে মিউজ়িয়াম। সেরামিক থেকে হুইস্কি, সামান্য কুটো পর্যন্ত কেমন করে তারা জমিয়ে রাখতে পারে, অন্যকে দেখাতে জানে। কিন্তু ইতিহাস বাঁচানোর দায়িত্ব কে বা কারা নিচ্ছে, সেটাও ততোধিক জরুরি। যে বা যারা ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ, প্রতিষ্ঠা ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে, তাদের চরিত্র বুঝতে হবে; কোনটা ঠাঁই পেল বা পেল না, খুঁটিয়ে খেয়াল করতে হবে। কর্তাদের নির্মিত কাঠামোর ওপরেই নির্ভর করে, কাকে কী ভাবে দেখানো হবে, কে হবে প্রান্তিক। মোদী সরকার নিজের মতো করে অতীত তুলে ধরতে পারে— প্রয়োজনে বিকৃত করেও— আপত্তিটা এই সূত্রেই।

জাতীয় শিক্ষানীতির সবচেয়ে বড় গোলমালটা ছিল তার বাহন— তিন-ভাষা নীতি। প্রত্যেক শিশুকে স্কুলে তিনটে ভাষার তালিম নিতে হবে, তা-ও আবার প্রাথমিক বা প্রাক্‌প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করে, তার পর একটা প্রাচীন ভাষা শিখতে হবে। এত শিক্ষক কোথায় জুটবে, ছাত্রজীবনের কত অংশ স্রেফ ভাষা শিখতেই কেটে যাবে ইত্যাদি ‘জাগতিক’ প্রশ্ন মহৎ উদ্দেশ্যের সামনে ফিকে হলেও, অহিন্দিভাষীরা ইংরেজি জানা সত্ত্বেও কেন হিন্দি নামক আর একটি সংযোগ ভাষা শিখতে বাধ্য, এর ব্যাখ্যা নেই। আর এক সমস্যা, ভারতীয় ভাষা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজির গুরুত্ব কমিয়ে দেওয়া। সব রকম বিদ্যাচর্চায় ভারতীয় ভাষার গুরুত্ব বাড়ানো নিয়ে সংশয় নেই, কিন্তু তা থেকে ইংরেজি বাদ দিলে দুটো বিপদ আছে। এক, ভারতীয়দের বিশ্ববিদ্যার সঙ্গে যোগ ক্ষীণতর হবে, এবং দুই, পড়ে থাকা দ্বিতীয় বিকল্প হিসেবে সর্বত্র বিরাজমান হয়ে উঠবে হিন্দি।

অমিত শাহের কথা থেকে বোঝা যায়, দেশি বা ভারতীয় বলতে তাঁরা হিন্দিকেই বোঝেন। বিদেশি ভাষার ‘অনুপ্রবেশ’ রুখতে একক সেনানী হিসেবে এই ভাষাকেই খাড়া করা হয়েছে। মানুষের ব্যক্তিসত্তার প্রকাশ ভাষা, যদি ‘ভারতীয়=হিন্দি’ সমীকরণটা দাঁড় করিয়ে দেওয়া যায়, তা হলে সেই সত্তা প্রতিষ্ঠা করা যাবে। উল্টো দিকে, ভারতে যে বৈচিত্র ও বহুত্বের স্বীকৃতি রয়েছে, তাকে ধরে দেশের নানা জাতিগোষ্ঠীর স্বাতন্ত্র্যের দাবি বার বার জোরদার হয়। বিজেপির ভারত-ভাবনার কোনও স্তরেই— নৃগোষ্ঠীগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক— যে হেতু একত্ব বিনা কিছু নেই, তাই ‘একত্ব = আনুগত্য’ সমীকরণ আঁকা যেতেই পারে।

শেষ অবধি ভাষার প্রশ্নে কেন ঠোক্কর খেল বিজেপি? ভারত ইংরেজ-শাসন মুক্ত হলেও কাজের ভাষা ইংরেজিকে তো বর্জন করেইনি, বরং বিশ্বের সঙ্গে যোগের মাধ্যম বানিয়েছে। প্রাচীন বিদ্যা ও সংস্কৃতির পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ভারতীয়েরা আগ্রহী হলেও দেশবাসী বোঝেন, ঐতিহাসিক ভাবে কেবল হিন্দি বলয়টাই কাদের ভিত, এবং কী স্বার্থে তারা ভারত চালানোর চেষ্টা করছে। কাদের মন্ত্র হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান। কারা এক ভারত গড়তে চায়, শত পুষ্প বিকশিত করে নয়, এক বাহনের পিঠে চাপিয়ে। ভারতবাসী জানেন, সেই বাহন সংখ্যাগুরুর ধর্ম, এবং হিন্দি ভাষা। অথচ এক ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে সেই স্বাধীনতার পর থেকেই দক্ষিণ ভারতের নেতৃত্বে লড়ে চলেছেন ‘সংখ্যালঘু’ ভাষাভাষী।

‘অখণ্ড ভারত’ হতেই পারে, তবে ঘাড় ধরে একসূত্রে বেঁধে নয়, সহস্র মনকে প্রাণবান রেখেই।

অন্য বিষয়গুলি:

Education Policy BJP Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy