প্রতীকী চিত্র।
গুজব হিমবাহের মতো। তার শুরুটা হয় সাধারণ ভাবে। তার পরে ক্রমে ক্রমে তা শক্তিসঞ্চয় করে এগিয়ে যেতে থাকে।
‘আই কিউ’-এর আবিষ্কর্তা জার্মান বিজ্ঞানী উইলহেম স্টার্ন গুজব নিয়ে একটি মজার পরীক্ষা করেন ১৯০২ সালে। একটি গল্প এক জন আর এক জনকে শোনাবেন। তিনি যা শুনলেন, আলাদা ভাবে আর এক জনকে শোনাবেন। এ ভাবে অনুক্রমিক ভাবে কিছু মানুষের মধ্যে পর পর গল্পটি প্রবাহিত হবে। স্টার্ন দেখলেন, যত দূরে যাচ্ছে, মূল গল্পটির বিষয়, খুঁটিনাটি ইত্যাদি ক্রমে বদলে যাচ্ছে এবং ধারালো হয়ে উঠছে। আমাদের রাঢ় বাংলায়ও প্রাসঙ্গিক একটি ছড়া আছে, ‘হাটে গেইছিল মামীর মা, দেখে আইসেছে বাঘের পা, মামী বলল্যাক, আমি শুইনল্যম, মরি বাঁচি বুন্ বাঘ দেইখলম’।
স্টার্নের পরীক্ষার প্রায় চার দশক পরে আমেরিকার মনোবিজ্ঞানী রবার্ট হ্যাম্পডেন ন্যাপ গুজব নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি জানান, গুজব ব্যবহার করে মানুষের ভাবাবেগকেই। সমাজের ভাবাবেগকে প্রকাশ ও তুষ্ট করার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে গুজবের। তিনি গুজবকে প্রধানত, তিন ভাগে ভাগ করেন। প্রথমত, অবাস্তব স্বপ্নপূরণের গুজব। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মিত্রপক্ষের দেশগুলিতে গুজব রটেছিল যে জাপান বেশি দিন যুদ্ধ করতে পারবে না। কারণ, তাদের তেলের সঞ্চয় ছ’মাসেই শেষ হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, ভীতিসঞ্চারি গুজব। যেমন, ছেলেধরার গুজব। তৃতীয়ত, বিভেদ সৃষ্টিকারী গুজব। আমাদের দেশে এমন গুজব প্রায়ই রটে, যা সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদ তৈরি করে। এই দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির গুজব তাদের ধ্বংসাত্মক প্রকৃতির জন্য সমাজের চরম অনিষ্ট করে।
মানবসভ্যতার আদিকাল থেকেই মুখে মুখে কথা ছড়িয়ে জিভের তাণ্ডবে ক্ষতিসাধনে পারঙ্গম থেকেছে গুজব। বাইবেল বলছে, ‘তরবারির ধারে অত পতন হয়নি, যত না পতন ঘটেছে জিভের ধারে’। শেক্সপিয়র তো গুজবকে ব্যক্তিরূপ আরোপিত করলেন। তাঁর ‘হেনরি ফোর্থ’ নাটকের দ্বিতীয় ভাগের শুরুতেই মঞ্চে গুজব-এর প্রবেশ। তার পরণে জিহ্বা-অঙ্কিত বেশ। সে নিজের পরিচয় দিয়ে বলে তার জিভে নিন্দার আবাস আর তার কাজ পুরুষদের কান ভারী করা। সে যেন এক বাঁশি, যা বাজে আন্দাজি সন্দেহ আর ঈর্ষায়।
মধ্যযুগে চতুর্দশ শতাব্দীতে প্লেগের প্রাদুর্ভাব সঙ্কটে ফেলেছিল ইউরোপকে। সেই সময়ে গুজব রটিয়ে দেওয়া হয় যে ইহুদিরা খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের কুয়োর জলে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। তার পরিবর্তে শয়তান প্লেগ থেকে রক্ষা করছে ইহুদিদের। এই গুজবের জেরে ১৩২১ সালে ফ্রান্সে অন্তত পাঁচ হাজার ইহুদিকে জীবন্তদগ্ধ করে হত্যা করা হয়।
১৭৫০ সালে রাজা পঞ্চদশ লুই-য়ের রাজত্বে রক্ষিবাহিনী শহর পরিষ্কার করার জন্য পথশিশুদের তুলে শিবিরে আটকে রাখছিল। প্রতি শিশুপিছু পুরস্কার পাওয়ার তাগিদে পুলিশ বাড়াবাড়িই করে ফেলেছিল। রটে যায়, রাজা লুই-এর কুষ্ঠরোগ হয়েছে, তাঁর চিকিৎসায় শিশুরক্তে স্নানের প্রয়োজন। তাই এই অপহরণ। অবশেষে শিশুদের ছেড়ে দিয়ে এই উদ্ভট গুজব ও তজ্জনিত প্রজারোষ থেকে মুক্তি পান রাজা।
আফ্রিকার রুয়ান্ডা-য় সংখ্যালঘু তুতসি ও সংখ্যাগুরু হুতুগোষ্ঠীর মধ্যে দ্বন্দের প্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে যে গণহত্যায় আট লাখ তুতসি ও নরমপন্থী মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল সেখানেও গুজবের ছিল এক বড় ভূমিকা। আমাদের দেশে সেতু তৈরির জন্য মানুষের বা শিশুর মাথা লাগবে, এই গুজব বেশ প্রাচীন। আর এই সময়ে বহুপ্রচলিত, অপহরণ করে কিডনি চুরি করে নেওয়ার গুজব।
গুজবের উৎপত্তি ও ছড়িয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিজ্ঞানীরা অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা বলছেন, ভয় ও উদ্বেগতাড়িত মন প্রস্তুত থাকে গুজবকে গ্রহণ করার জন্য। যেন এটি সমাধান। সম্মিলিত ভাগীদারিতে তা ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে হয়তো মুক্তির পথ খোঁজে মানুষ। অনেক সময় সংবাদের বিকল্প হিসেবে কাজ করে গুজব। আবার অনেক সময় গল্প, গুজব আড্ডায় ‘ফিলার’ হিসেবে কাজ করে। তার পরিবেশন ‘জোকস’ পরিবেশনের মতোই দিতে পারে বিনোদন অথবা জোগাতে পারে মর্যাদা। নর্দার্ন আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হেলেন হার্টন-এর মতো মনোবিজ্ঞানীরা আবার গুজবকে যোগ করেছেন বিবর্তনবাদের সঙ্গে। জানিয়েছেন, টিকে থাকার জন্য প্রথম থেকেই মানুষের ঝোঁক মস্তিষ্কে ঋণাত্মক তথ্য সঞ্চয় করার দিকে। তাই তার কাছে ফুলের বাগান কোথায় আছে সেই তথ্য জানার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কোথায় বাঘ আছে বা বাঘ থেকে বাঁচার উপায়ের তথ্য। হয়তো অবচেতনে এখানেই লুকিয়ে আছে গুজবের অনুমোদন বা প্রশ্রয় পাবার কারণ।
সভ্যতার অগ্রগতি, শিক্ষার প্রসার মানুষকে যুক্তিবাদী হতে শেখায়। গুজবের অস্তিত্বকে মুছে দেবার ক্ষমতা আছে যুক্তিবাদী মনের। তবু গুজবের আজও মৃত্যু নেই। তার কারণ, আধুনিক সভ্যতাও মানুষকে সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে পারছে না। অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন সঙ্কটের রন্ধ্র দিয়ে ঢুকে পড়ছে গুজব। যা আগে ছড়াত মুখে মুখে, এখন তা সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি দিয়ে পলকে ছড়িয়ে পড়তে পারছে।
আর যার হাত ধরে গুজব চরম ক্ষতি করছে তা হল হিংসা। এখন গোপনে নয়, হিংসা প্রকাশ্যেই লালিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে। আমাদের দেশে মানুষকে জীবন্ত পুড়িয়ে তাঁর ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়াকে গৌরবজনক মনে করছে ধর্মান্ধ/ হিংসান্ধ মানুষ। আমাদের যে দিন মহাষষ্ঠী ছিল, সে দিন আমেরিকার ফ্লোরিডার আইনপ্রণয়নকারী পরিষদ স্কুলে শিক্ষকদের বন্দুক রাখার আইনগত অনুমোদন দিচ্ছে। এ সব হিংসার পেছনে কাজ করছে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মনোজাগতিক নানা উপাদান। সিনেমা, সিরিয়াল ইত্যাদি বিনোদনের সঙ্গে মিশিয়ে পরিবেশন করছে হিংসার উপাদান। মান্যতা পাচ্ছে তা। এক দিকে আর্থিক অপ্রতুলতা, বেকারত্ব, অন্য দিকে পণ্যায়নের সংস্কৃতির অমোঘ আহ্বান।
অপ্রাপ্তি উসকে দিচ্ছে ক্রোধ। তা হিংসার মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে নিচ্ছে। বিভিন্ন কারণে জমছে আইন-শাসনের ওপর ভরসাহীনতা। তাই ছেলেধরার গুজবেই হোক বা
অন্য কিছু—যুক্তিহীন ভাবে, নিষ্ঠুর ভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে মানুষকে ।
গুজব ও হিংসা দুই-ই সভ্যতার পরিপন্থী। সভ্যতার আলোকে মলিন না করার দায় নিতে হবে সকলকেই। চোখ-কান বন্ধ করে গুজবকে বিশ্বাস নয়, যাচাই করে নিতে হবে খবরের সত্যতা যুক্তিবাদী মনে। প্রশাসনকে যেমন গুজবের বিরুদ্ধে প্রচার করতে হবে, তেমনই কড়া হাতে দমনও করতে হবে। এ ভাবেই হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে পরিত্রাণের পথ ।
আসানসোলের চিকিৎসক ও সাহিত্যকর্মী
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy