ছবি: সংগৃহীত
সব কিছুকে ছাপিয়ে শাড়িই আজ ভাইরাল। ঠিক দু’দিন আগেও যারা জিনস বা সালোয়ার কামিজ পরে মহা উৎসাহে সরস্বতী পুজোর কেনাকাটা করেছে, কুমোরপাড়া থেকে প্রতিমা নিয়ে গিয়েছে, স্কুলে বসে হইহই করে পুজোর নানা রকম কাজ করেছে, তারাও আজ শাড়ি-শোভিত।
শীতের শেষ উৎসব
অলিখিত ভাবে শীতের শেষ উৎসব সরস্বতী পুজোই। এই পুজোয় ঠিক পুজো পুজো আবহ তৈরি না হলেও শহর-গ্রাম দুই জীবনেই একদিনের জন্য হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়ে যায়। রাস্তাঘাট নবীন প্রজন্মের ভিড়ে থইথই করে। এ বার গতকাল আর আজ— দু’দিন এই ব্যস্ততার ছবিই দেখছে সমস্ত উত্তরবঙ্গ। এ বছর ’দুদিন সরস্বতী পুজোর লগ্ন থাকায় উৎসবের আমেজ যেন আরও বেড়ে গিয়েছে।
শাড়িদিবস
দুর্গাপুজোর অষ্টমীতে যেমন শাড়িই বাঙালির স্পেশাল পোশাক, ঠিক তেমনই সরস্বতী পুজোতেও শাড়ি পরতেই হবে। সারা বছর যাদের জিনস বা সালোয়ার কামিজই সঙ্গী, আজ তারাও বেছে নিচ্ছে সেই সাবেক শাড়িকেই। তরুণী, চাকরিজীবী মহিলা বা গৃহবধূরা বিভিন্ন সময় শাড়ি ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু তা বলে স্কুলের চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ শ্রেণির মেয়েরা? কিংবা ইংরেজিমাধ্যম স্কুলের সাহেবি পোশাক পরা মেয়েরা? আজ, সরস্বতী পুজোয় দিনে তাদের সবার পরিধেয় শাড়িই। কারণ, বাঙালি মেয়েদের আজ শাড়িদিবস।
শাড়িই কেন?
সরস্বতী পুজোয় কেন শাড়ি পরতেই হবে, তার কোনও নির্দিষ্ট উত্তর নেই। শাড়ির সঙ্গে হয়তো বড় হয়ে ওঠার একটা অদৃশ্য সম্পর্ক কোথাও লুকিয়ে থাকে। বেশির ভাগ স্কুলে অষ্টম থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর মেয়েরা শাড়ি পরে। সেটাও এক রকম বড় হয়ে ওঠার স্বাদ। আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি আর আর্থসামাজিক অবস্থান এখন অনেকটাই বদলে গিয়েছে। এই বদল পরিবারকেও প্রভাবিত করেছে। কিন্তু ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার যে স্বাদ, তার বদল একটুও হয়নি। হয়নি বলেই আধুনিকতা যখন প্রায় হাতের মুঠোয়, ঠিক সেই সময়ে এই প্রাচীন পোশাকের প্রতিই নবীন প্রজন্ম সরস্বতী পুজোর দিনে এতটাই আগ্রহী।
অন্য অনুভূতি
বাঙালির অলিখিত ভালবাসা দিবসও এই সরস্বতী পুজোর দিনটাই। ভ্যালেন্টাইনস ডে কাকে বলে, তা অনেক দেরিতে জেনেছে আমবাঙালি। তার আগে তার ভালবাসা দিবস ছিল এই সরস্বতী পুজোই। স্কুল ইউনির্ফম পরা মেয়েগুলো কেমন যেন অচেনা হয়ে যায় এই শাড়ি পরার দিনটাতে। স্কুলে স্কুলে সরস্বতী পুজো, এক স্কুল থেকে অন্য স্কুলে ঠাকুর দেখতে যাওয়া, এরই মাঝে কত প্রেমের আশ্লেষ! আবার কত প্রেম যে অঙ্কুরেই ঝরে গিয়েছে, তারও কোনও হিসেব নেই। আবার এই দিনেই আলাপের সূত্রপাত হয়েছে, এমন কত যুগল যে এখন সংসারজীবন পালন করছেন, তারও কোনও হিসেব নেই। বছর বছর স্কুল-কলেজে পড়ুয়াদের মুখগুলো বদলে যায়। নেহাৎ সাদামাটা পুজো থেকে পুজোর আঙ্গিকেরও জৌলুশ বাড়ে। পুজোয় অাধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও সেই শাড়ি পরে প্রথম বড় হয়ে ওঠার সাবেক অনুভূতিটা একচুলও বদলায় না। সেই অনুভূতিরই চলমান ছবি দেখছে এখন উত্তরের আনাচকানাচ।
চেনা ছবির বাইরে
কিন্তু শাড়ি পরে হঠাৎ বড় হয়ে ওঠার স্বাদ কি সবাই নিতে পারল? যে মেয়েটির বাবা ভিন রাজ্যে শ্রমিকের কাজ করেন বা যার বাবার রোজগারের সম্বল বলতে স্রেফ একটা ভ্যানরিকশা অথবা যার মা কাজ করেন চা-বাগানে পাতা তোলার— তারাও কি সমান ভাবে এই অচেনার আনন্দকে উপভোগ করতে পারল? এ রাজ্যে ছাত্রছাত্রীরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুল ইউনির্ফম পায় সম্পূর্ণ বিনামূল্যে। এতে যে দরিদ্র পরিবারের উপকার হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু শাড়ি? প্রাথমিক থেকে অষ্টম শ্রেণির মেয়েরা তো সেটা স্কুল থেকে পায় না। আজ তারা তা হলে কী করবে? ‘পথের পাঁচালী’র অপু আর দুর্গা যেমন তাদের বাবার কাছে আবদার করত, আজকের কোনও দুর্গাও হয়তো ঠিক একই ভাবে তার বাবার কাছে আবদার করে একটা শাড়ির জন্য! বন্ধুদের সঙ্গে সেও এই অচেনার আনন্দের ভাগ নিতে চায়!
উজ্জ্বল এক ঝাঁক
শাড়ি নেই বা শাড়ি কেনার ক্ষমতা নেই যাদের, তারাও বেমানান নয় এই উৎসবের দিনে। অতি সাধারণ পোশাক পরা মেয়েরাও আজকের দিনে ঝলমল করে ওঠে। হয়তো মায়ের শাড়িতে। হয়তো শাড়ি ছাড়াই। হয়তো এই আশায় বুক বেঁধে যে, সামনের বছর জোগাড় হয়ে যাবে শাড়ি!
(লেখক কোচবিহারের বাণেশ্বর জিএসএফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy