Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Girl child

উচ্ছে, বেগুন, কন্যাশিশু

গত বছর নভেম্বর মাসে তামিলনাড়ুর এক বাবা এক লক্ষ আশি হাজারে বিক্রি করেন তাঁর সদ্যোজাত যমজ সন্তানের মধ্যে কন্যাটিকে। বিক্রির অর্থে আকণ্ঠ মদ্যপান করে সোনার চেন কিনে আনেন সেই কন্যার সঙ্গেই জন্ম নেওয়া পুত্রের জন্য।

সোনালী দত্ত
শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০২০ ০০:৫৩
Share: Save:

আজকাল বাজার আগুন। তরিতরকারি, মাছ— এ সব হাতের বাইরে। তবে শিশুকন্যা বেশ সস্তায় বিকোচ্ছে। সম্প্রতি মেদিনীপুরের হরিজন পল্লিতে বাবা, মা আট মাসের শিশুসন্তানকে বিক্রি করলেন মাত্র চার হাজার টাকায়। লকডাউনের দারিদ্র বাবা, মা’কে বাধ্য করেছে অর্থের বিনিময়ে নিজের সন্তানের সওদা করতে, এমনই বলা হচ্ছে। গত জুন মাসেই পশ্চিম মেদিনীপুরে এই রকম আরও একটি ঘটনা কানে এসেছিল। পরিযায়ী শ্রমিক আর গৃহ পরিচারিকার আড়াই মাসের কন্যা বিক্রি হয়েছিল হাওড়ার এক দম্পতির কাছে। শিশুটি তাঁদের তৃতীয় সন্তান। জেলার ‘চাইল্ড লাইন’-এর কোঅর্ডিনেটর অবশ্য ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করে বলেছিলেন, শিশুটি পুত্রসন্তান হলে বিক্রি হয়ে যেত না।

গত সেপ্টেম্বরে অন্ধ্রপ্রদেশের এক মা তাঁর ষোলো মাসের হারানো সন্তানকে ফিরে পান। তাকে মাত্র তিন দিন বয়সে তার বাবা দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। শিশুটি ছিল তাঁদের চতুর্থ সন্তান। তায় আবার মেয়ে। অভাবের তত্ত্ব যে খাটে না, তা নয়। বিশেষত লকডাউনের সময় নিম্নবিত্ত পরিবারগুলির নৌকা ছিল সত্যিই টলোমলো। প্রায় তেরো কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবেই কাজ হারিয়েছেন। এঁদের তিন-চতুর্থাংশ ক্ষুদ্র কারবারি বা দিনমজুর। কবে এঁরা ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন, জানা নেই। শিশুসন্তানের বিক্রি তাই বেড়েই চলেছে।

তার উপর অশিক্ষা, কুসংস্কার এবং অকেজো অবসর বাড়িয়ে দিয়েছে জন্মহার। নিয়ন্ত্রণহীন এই প্রাণের প্রবেশদ্বারে এ দেশ আলো নয়, দুর্ভাগ্যের অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তবু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। দারিদ্রে মরিয়া অভিভাবক অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কন্যাসন্তানকে বিক্রি করেন কেন? কখনও কখনও অবশ্য পুত্রসন্তানও বিক্রি হয়। গত অগস্ট মাসে হায়দরাবাদে বাইশ হাজার টাকায় এক বাবা নিজের দু’মাসের ছেলেকে বিক্রি করেছেন। কিন্তু সে এক রকম নিরুপায় হয়ে। ছেলে এবং মেয়ে দুই’ই থাকলে বিক্রির বাজারে উচ্ছে, বেগুনের ঝুড়ির পাশে মেয়ের স্থান অবধারিত।

হাথরসের পৈশাচিক ঘটনা ভারতের লিঙ্গবৈষম্য এবং নারী-বিদ্বেষকে আবার বিশ্বের সামনে প্রকট করেছে। একটি ঘটনা মিডিয়া কভারেজ পেলে প্রত্যহ ঘটে চলা নিয়মিত অন্যায়গুলিও উপেক্ষার স্তর পেরিয়ে আলোচনায় উঠে আসে। কাজেই ভ্রূণহত্যা, গার্হস্থ হিংসা, ধর্ষণ ইত্যাদির নানা তথ্য আমাদের কাঁপিয়ে দিচ্ছে। তার সঙ্গে এ বার যুক্ত হল কন্যাসন্তান বিক্রি বা পাচারের বৃত্তান্তও। সে কন্যা দিল্লির আড়াই মাসের চল্লিশ হাজারি শিশু হতে পারে, অথবা হায়দরাবাদের অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়া সতেরো বছরের কিশোরী। ভারতে প্রতি আট মিনিটে একটি শিশু বিক্রি হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাবা, মায়ের দ্বারা। আর তার সিংহভাগই শিশুকন্যা। লকডাউন কালে এ দেশে শুধু নারী নির্যাতনই বাড়েনি, কন্যাশিশুর বিক্রিও বেড়েছে হুহু করে।

জন্মদাতা কী ভাবে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেন? শিশুর মা কি সম্মতি দেন এই কারবারে? অনেক সময় দেন না। মারের ভয়ে বাধ্য হন মেনে নিতে। আবার মাঝেমধ্যে দেনও। মহিলারাও তো লিঙ্গবিদ্বেষ হৃদয়ে লালন করেন। মেয়েদের ‘সন্তান’ ভাবা, ‘মানুষ’ ভাবার মতো শিক্ষা ভারতের একটি বড় অংশেরই নেই। অথবা, মেয়েদের জন্য এই চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীন দেশে অভিভাবক চরম বিতৃষ্ণায় কন্যাসন্তান বিক্রি করে দেন। কাছে রাখলে খেতে দিতে হবে, বিয়ে দিতে হবে, পণ দিতে হবে, শ্বশুরবাড়ির অত্যাচারের খবর শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বদনামের ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকতে হবে, মেয়ে খুন হয়ে গেলে থানা ঘেরাও করতে হবে। ঝক্কি তো কম নয়? এ দেশে নারীর উপর অপরাধ হলে তার অভিযোগই লিখতে চায় না কেউ! সাজা হয় চার জনে মাত্র এক জনের। কী হবে মেয়েকে বাড়িতে রেখে? তার চেয়ে পাচার হয়ে যাক। চোখের সামনে থাকবে না। হাতে পয়সাও আসবে।

তা হলে কি শুধু অভাবে, অশিক্ষায় আর নিরাপত্তাহীনতায় এ দেশের বাবা মেয়ে বিক্রি করেন? লোভে করেন না? এই বছরই অগস্ট মাসে কর্নাটকের এক শ্রমিক বাবা তিন মাসের শিশুকন্যাকে বিক্রি করে এক লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন। তা দিয়ে কিনেছিলেন দামি মোবাইল এবং মোটর সাইকেল। স্ত্রী’কে ভয় দেখিয়ে তাঁর মুখ বন্ধ রাখেন। গত বছর নভেম্বর মাসে তামিলনাড়ুর এক বাবা এক লক্ষ আশি হাজারে বিক্রি করেন তাঁর সদ্যোজাত যমজ সন্তানের মধ্যে কন্যাটিকে। বিক্রির অর্থে আকণ্ঠ মদ্যপান করে সোনার চেন কিনে আনেন সেই কন্যার সঙ্গেই জন্ম নেওয়া পুত্রের জন্য। এই আমাদের ‘বেটি বচাও’-এর উজ্জ্বল ভারত, ডিজিটাল ভারত! এই আমরা ‘আধুনিক’ হয়েছি!

বিক্রি হয়ে যাওয়া শিশুকন্যার ভাগ্যে কী ঘটে? কিছু জন ভাগ্যবান হলে হয়তো নিঃসন্তান দম্পতির স্নেহ পায়। কিন্তু সে কপাল ক’জনেরই বা হয়? শিশু শ্রমিক, গৃহ পরিচারিকা, ভিখারি ইত্যাদি নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই। আর বাকিরা যায় দেশ-বিদেশের পতিতালয়ে। ধর্ষণ কি কেবল হায়দরাবাদ, হাথরস, কামদুনি আর দিল্লির বাসে হয়? এই সব গোপন, অথচ প্রথাসিদ্ধ ধর্ষণে যে নিশ্চুপে কত প্রাণ বেরিয়ে যায়, তার খবর কে রাখে? ২০১৮ সালে খবরে আসা বাবুভাইকে মনে আছে? আমদাবাদে উঁচু জাতের ধনী ‘পটেল’ চাষিদের ‘স্ত্রী’ জোগাড়ের জন্য সে মেয়ে কিনে আনত দেশের বিভিন্ন জনজাতি অঞ্চল থেকে। কারণ ভ্রূণেই নারী হত্যা করে করে তাদের এলাকায় তখন মেয়ের খুব অভাব। মা, বাবার বিক্রি করে দেওয়া নাবালিকা নতুন ঘরে এসে কেঁদে বাঁচে না। শারীরিক নির্যাতন তো আছেই, দিনেও অসহ্য খাটুনি। কারও ভাষা বোঝে না। আসলে তো তারা সন্তান ধারণের যন্ত্র। কন্যা নয়, পুত্রসন্তান। বংশ রক্ষা করতে হবে যে!

প্রাচীন কালে যুদ্ধজয়ী রাজা রাজ্যের সঙ্গে জিতে নিতেন গরু, ক্রীতদাস আর নারী। মেয়েরা চির কালই ভোগ্য এবং এই বাজারে পণ্যও বটে। সেই সব ভোগ্যপণ্য যে বাজারে বিকোবে, রক্ষকরা তাদের ভক্ষণ করবে, এতে আশ্চর্যের কী আছে? তাই বলে বাবা, মা-ও সন্তানকে পণ্য ভাববেন? বিশেষ করে এখন, যখন কন্যাসন্তানদের জন্য সরকারি তরফে বেশ কিছু সুবিধা পাওয়ার জন্য আইন হয়েছে?

এই প্রশ্নটি যার মনে জাগবে, বিয়ের সময় হয়তো তাকেই কেউ ‘কন্যা সম্প্রদান’ করেছে, অথবা সে-ই হয়তো তার বাবার হাত দিয়ে কারও হাতে ‘প্রদত্ত’ হয়েছে? আর যা দান করা যায়, বা যে দান গ্রহণ করা যায়, তার নাম ‘কন্যা’ হোক বা ‘মাতা’, আসলে তো সে পণ্যই এক রকম।

অন্য বিষয়গুলি:

Girl child India
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy