প্রার্থনা: গিরিশ কারনাড রচিত ‘হয়বদন’ নাটকের একটি দৃশ্য।
বিশ্বাস করুন, গিরিশ কারনাডের দেহাবসানের খবরটা পড়েই ভেবেছি, তা হলে হিটলিস্টে গৌরী লঙ্কেশ-এর পরে থাকা অবধারিত ব্যক্তিটিকে ওরা নিকেশ করে দিল। গৌরী-হত্যার প্রতিবাদে নাকে অক্সিজেন নল নিয়ে গিরিশ ‘আমিও শহুরে নকশাল’ প্ল্যাকার্ড বুকে ধর্নায় বসেছিলেন। সারা ক্ষণ গোঁড়া হিন্দুত্বের জোরালো প্রতিবাদ করে গিয়েছেন গিরিশ। এই প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলকে ফিরিয়ে আনবেন না— এই মর্মে স্মারকলিপিতে স্বাক্ষর করেছিলেন যে ৬০০ জন থিয়েটার-ব্যক্তিত্ব, গিরিশ তাঁদের এক জন। যখন বেঙ্গালুরু এয়ারপোর্টের নাম টিপু সুলতানের নামে রাখার প্রস্তাব করেন তিনি, এক জন মুসলমান সুলতানের নাম করেছেন বলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। গিরিশ পিছু না হটে বলেন, শিবাজির থেকে টিপুর গুরুত্ব ইতিহাসে কিছু কম নয়।
গিরিশ কারনাডের সঙ্গে আমাদের পরিচয় এরও অনেক দিন আগে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য পড়তে শুরু করার দিনগুলিতে হাতে এসে পড়েছিল প্যাপিরাস প্রকাশনার কয়েকটি বই— শঙ্খ ঘোষের অনূদিত ‘হয়বদন’, ‘রক্তকল্যাণ’, স্বপন মজুমদারের ‘নাগমণ্ডল’, ‘তুঘলক’। স্বপন মজুমদারের সঙ্গে অনুবাদক চিত্তরঞ্জন ঘোষ। পরে গিরিশকে খবরে, সোশ্যাল মিডিয়াতে জেনেছি। মহাকাব্য, সংস্কৃত আখ্যান, লোকগাথার সূত্র ধরে কাহিনিকে যে এমন বুনে তোলা যায়, নাট্যের ভেতরে বাইরে যে এমন সমান্তরাল কথন চলতে পারে, সেখান থেকে চরিত্ররা যে ইচ্ছেমতো ঢুকে পড়ে, কুতর্ক জোড়ে, টিপ্পনী কাটে, আর সেই থেকে যে একটা জমাটি গল্পে জটিল সব প্রশ্ন উঠে পড়ে, আর দর্শকদের মনে হয় যে— সামনে ঘটে যাচ্ছে অভিনয়ের ভেতর অভিনয়, এত সব আমরা তার আগে ভাবতেও পারিনি।
গ্র্যাজুয়েশনে পাঠ্য ছিল ‘হয়বদন’, ‘তুঘলক’। ‘হয়বদন’-এর (১৯৭২) কাহিনিসূত্র কথাসরিৎসাগর। দেবদত্ত, কপিল হরিহর-আত্মা। দেবদত্ত ব্রাহ্মণ, শাস্ত্রজ্ঞ, সংস্কৃত কাব্যানুরাগী। কপিল অব্রাহ্মণ, ফলে অধিক সক্ষম শরীর তার, বনে-জঙ্গলে-নদীতে-গাছের ডালে অবাধ যাতায়াত। দেবদত্ত পদ্মিনীর স্বামী হয়। তার পর, ঠিক যেমনটা কথাসরিৎসাগরে, তিন জনে একসঙ্গে বেড়াতে বেরোয়। কালী মন্দিরে মানত অনুযায়ী নিজ মুণ্ড তরোয়ালে কেটে অর্পণ করে দেবদত্ত। বন্ধুবিচ্ছেদ সইতে না পেরে কপিলও তাই করে। এদের মুণ্ডহীন দেহ খুঁজে পেয়ে পদ্মিনী তো দিশেহারা। মা কালী আবির্ভূত হয়ে পদ্মিনীর দুঃখে বিচলিত হয়ে বলেন কাটা মুণ্ড জোড়া দিলেই প্রাণ ফিরে পাবে দুই বন্ধু। অন্ধকারে ভুল হয় পদ্মিনীর। মুণ্ডবদল হয়ে যায়। এমন অস্তিত্বসঙ্কটে কথাসরিৎসাগরের নিদান— মাথাই অস্তিত্বের মূল। ফলে দেবদত্তের মাথা, কপিলের শরীর হল দেবদত্ত। কপিলের মাথা, দেবদত্তের শরীর হল কপিল।
যেমনটা নগুগি ওয়া থিয়ং’ও লিখেছিলেন (১৯৮৬), উপনিবেশিত থাকার কালে মনের ওপর ঔপনিবেশিক শক্তির যে আধিপত্য তৈরি হয়, স্বাধীন হলেই তা আপনা থেকে চলে যায় না। স্বাধীনতা পাওয়ার পর তাই মনের বি-ঔপনিবেশিকরণের (ডি-কলোনাইজ়েশন) প্রশ্ন ওঠে। আমাদের দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সঙ্গীত নাটক অকাদেমিতে বি-ঔপনিবেশিকরণের পদক্ষেপ হিসেবে জাতীয় থিয়েটারের আদর্শ সূচিত হয়। ১৯৭০-১৯৮০’র মধ্যে তা একটি সংহত রূপ নেয়। এই দুই দশকে মূলত অকাদেমির সম্পাদক সুরেশ অবস্তি-র নেতৃত্বে জাতীয় থিয়েটার হয়ে ওঠে ‘শিকড়ের থিয়েটার’ (theatre of roots)। পশ্চিমি বাস্তবতাবাদ, কথানির্ভর শরীরচালনা থেকে বেরিয়ে ক্রমে শিল্পীরা লোক বা আঞ্চলিক ‘ফর্ম’গুলি থেকে নিজেদের উপস্থাপনার ভাষা নির্মাণ করতে থাকেন। অকাদেমির সহকারী সম্পাদক উমা আনন্দ বলেন, এই যে নতুন জাতীয় থিয়েটার, তা হল জাতির একতার অভিব্যক্তি, কিন্তু তা কোনও একমাত্রিক অর্থে ‘জাতীয়’ নয়। ‘জাতীয়’ কথাটির অর্থ এখানে একই সঙ্গে দেশের নানা অঞ্চলের নাট্যচর্চাকে এক জায়গায় আনা, দেশীয় শিল্পের নানা বয়ানের সমাহার ঘটানো। এই কারণে, বিষয়, ফর্ম বা অনুষ্ঠানের প্রেক্ষিত আলাদা হলেও কে এন পানিক্কর, রতন থিয়াম, হাবিব তনভির থেকে গিরিশ কারনাড— সকলকেই রাখা যায় এই ‘জাতীয় থিয়েটার’-এর ছাতার নীচে। এঁরা প্রত্যেকে দেশীয় বা স্থানীয় ঐতিহ্য থেকে নাটকের কাহিনি ও শৈলী আহরণ করেছেন।
দেশীয় শিকড়-নির্ভর এই ‘জাতীয় থিয়েটার’-এর ধারণা যেখানে শুরু, সেই অকাদেমির বয়ানে পশ্চিম ও প্রাচ্যের মধ্যে একটা বৈপরীত্য ও বিরোধ লক্ষ করা যেতে পারে। প্রশ্ন তোলা হতে পারে, ‘ভারতীয়’ বলতে যদি আমরা পশ্চিমি আলোকপ্রাপ্তির বিপরীত-সন্দর্ভ, বিকল্প আধুনিকতা ও জাতীয় বোধনির্মাণে পাশ্চাত্যের অভিঘাতকে মুছে ফেলতে চাই, তবে সেটা আবার ঔপনিবেশিক ইতিহাসের গুরুত্ব অস্বীকার করা হয়ে যাবে না তো? এ ছাড়া, বহুভাষিক বহুমাত্রিক আঞ্চলিকতার মধ্যেও তো আছে নানা নিজস্ব ইতিহাস, সামাজিকতা ও ঐতিহ্য, কিংবা নানা উপ-গোষ্ঠীর অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি। সুতরাং, ‘জাতীয়’ প্রকল্প ক্রমাগত এমন একটি প্রকল্প হয়ে দাঁড়ায়, যার মধ্যে ক্রমাগত ছেদ ও ভেদ বোঝানো হয়ে থাকে। অর্থাৎ ‘জাতীয়’ কোনও একমাত্রিকতা বোঝাতেই পারে না। এ বার প্রশ্ন— সে ক্ষেত্রে ‘জাতীয়’ কথাটি কি উপযুক্ত শিরোনাম?
গিরিশ কারনাড জানিয়েছিলেন, তাঁর মাথায় যে সব ছবি আসে, সেগুলো যে ভাষাতে লিখলে তাঁর সুবিধে হয়, সে ভাষাতেই তিনি লিখে রাখেন। হয় কন্নড়ে (মাতৃভাষায়), নয়তো ইংরেজিতে (অর্জিত ভাষায়)। মরাঠিতেও দখল ছিল তাঁর। কখনও মূল নাটকটি হয় কন্নড়ে, তিনি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন নিজে, কখনও উল্টোটা। ‘হয়বদন’-এর সূত্রটি গিরিশের কাছে আসে টমাস মানের জার্মান ভাষার একটি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ থেকে, যে গল্প তার সূত্র পেয়েছে কথাসরিৎসাগর থেকে। আবার, ‘অগ্নি মাত্তু মালে’ (অগ্নিবর্ষা) নাটকটির সূত্র তিনি পেয়েছেন রাজাগোপালচারীর মহাভারতের অনুবাদ থেকে। ফলে যাকে আমরা শুদ্ধ শিকড়ের সন্ধান ভাবছিলাম, সেই ‘বিশুদ্ধ মার্গীয়’ বা ‘বিশুদ্ধ লোকজ’, কারনাড তাকে নিয়ে যান ব্যক্তির পঠনের নানাস্তরীয় অভিজ্ঞতার মধ্যে। জানালেন, মূল বা উৎস কখনও বিশুদ্ধ হতে পারে না, সে বহু হাতফেরতা হয়, নানা ঘাট-আঘাটা ঘুরে সে রূপ পায়। নানা সংস্কৃতির বেড়া ডিঙিয়ে, নানা ভাষায় প্রকাশ পেয়ে আবার সে কোনও ভারতীয় ভাষায় ফিরে আসতে পারে। তাই, গিরিশ কারনাড ‘শিকড়’ বলতে সব কিছুতেই নানা চিহ্ন দেখতে পান ও দেখান।
ক্রমাগত তাঁর নাটকে তাই জাতপাত, ব্রাহ্মণত্ব, শাস্ত্রের মর্যাদা প্রশ্নের মুখে পড়তে থাকে। কিছুই আর পূর্ণ ভাবে তুলে আনা সম্ভব হয় না। ফলে, দেবদত্তর মুণ্ডধারী শরীরে কপিলের স্মৃতি থেকে যায়, আর, কপিলের মুণ্ডধারী শরীরে, দেবদত্তর। তাদের মধ্যে নিরন্তর দ্বন্দ্ব চলতে থাকে, উভয়ের সত্তা তখন চিরতরে খণ্ডিত। আর কেউ না ধরতে পারুক, কালী কিন্তু বলেই ফেলেন, স্বামী ও স্বামীর বন্ধুর মুণ্ডবদল আসলে পদ্মিনীরই পাকানো ঘোটালা। কেননা পদ্মিনী দেবদত্তর মন ও কপিলের শারীরিকতা একসঙ্গে কামনা করেন। শেষে, দেবদত্ত কপিল পরস্পরকে হত্যা করলে পদ্মিনী সতী হয়, সতী নারী পদ্মিনীর উপাখ্যান বদলে যায়, কারণ সে শেষাবধি বহু পুরুষকে মনে নিয়ে চিতায় ওঠে।
এক শিক্ষক বলেছিলেন, আমরা সকলেই আসলে দেবদত্ত, কপিল। আমাদের এক দিকে মনন, আর অন্য দিকে শরীরের অভিজ্ঞতা, এক দিকে পশ্চিমি জ্ঞানচর্চা, অন্য দিকে দেশীয়। এখন বুঝি, আরও আছে। এক দিকে মার্গ, অন্য দিকে লোক। এক দিকে গোঁড়া শাস্ত্র, অন্য দিকে রিচুয়াল। এই সব দোটানার মাঝে অজস্র দেবদত্ত আর অজস্র কপিলের দ্বান্দ্বিকতা। আমরাই পদ্মিনী। দুই মেরুর মাঝের স্তরগুলিতেই আমাদের বসবাস, ইতিহাস, আকাঙ্ক্ষা। সেটাই আমাদের ভারতীয়ত্ব। ‘জাতীয়’ বলে কী-ই বা খোঁজা যাবে আর!
‘অগ্নিবর্ষা’ নাটকে ব্যাধকন্যা নিত্তিলাই বলেছিল, যে ভগবান নিজেকে বদলান না, অজর অমর থেকে যান, সেই ভগবান কখনও সৃষ্টি করতে পারেন না। গিরিশ কারনাড এমন এক ‘জাতীয়’ ঐতিহ্যের কথা বলেন, যা বদলের মধ্য দিয়ে, বহু টুকরোয় ভেঙে পড়ার মধ্যে দিয়ে পুনর্জন্ম পেতে থাকে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy