কোথা থেকে কী হয়ে যায় কিচ্ছু বলা যায় না। কোন মুহূর্ত কেমন করে যুগান্তকারী, ঐতিহাসিক হয়ে দাঁড়ায়, কেউ বলতে পারে না। না হলে ওই এক কালো ছেলের জন্য ‘দি ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা’র এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত কেঁপে উঠবে, ভেবেছিলেন পুলিশ অফিসার ডেরেক শভিন-রা? ও দেশে বর্ণবিদ্বেষের ইতিহাস তো কয়েক শতাব্দীব্যাপী— যাকে বলা যায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদি পাপ, ‘অরিজিনাল সিন’। ও দেশে বর্ণবিদ্বেষের কারণে প্রকাশ্য কৃষ্ণাঙ্গনিধনের ইতিহাসও বহুপরিচিত, মিনিয়াপোলিস কেবল যোগ হল একটা লম্বা তালিকার সঙ্গে। ও দেশে বর্ণবিদ্বেষবিরোধী আন্দোলনকেও নতুন ব্যাপার বলা চলে না। গত কয়েক বছরেই কত বার ফুঁসে উঠছে কালো মানুষদের অধিকার ও সম্মান লুণ্ঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, মিছিল। কিন্তু এ সব সত্ত্বেও জর্জ ফ্লয়েড ইতিমধ্যেই ইতিহাস, এবং ইতিহাসের জন্মদাতা। আজ যে কাণ্ড হচ্ছে মার্কিন ভূখণ্ড জুড়ে, তার তুলনা আমরা সে দেশে উনিশশো ষাটের দশকের পর আর দেখিনি, অনেকে বলবেন, তখনও এই মাত্রায় দেখিনি।
২৫ মে-র পর মিনিয়াপোলিস দেখেছে, তাদের শহরে ঘটে-যাওয়া ফ্লয়েড-হত্যায় ক্ষুব্ধ, ক্রুদ্ধ প্রতিবাদীদের স্রোত আটকাতে বন্ধ করে দিতে হয়েছে নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিন ব্রিজ, সান ফ্রান্সিসকোর গোল্ডেন গেট ব্রিজ। পোর্টল্যান্ড আর সিয়াটল-এ গ্রেফতার হয়ে চলেছেন অনেকে। শিকাগোয় ইউনিয়ন পার্কে প্রতি দিন জমা হচ্ছেন ত্রিশ হাজারের বেশি লোক। লস এঞ্জেলস-এ প্রতিবাদীরা আটকে দিয়েছেন হলিউড-এর রাস্তা। রিচমন্ড-এ ভাঙা হয়েছে এক বর্ণবিদ্বেষী নেতার স্ট্যাচু। আটলান্টা আর ফিলাডেলফিয়া শুনছে অজস্র মানুষের জমায়েত থেকে উঠে আসা হাওয়া-কাঁপানো স্লোগান: ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’! রাজধানী ওয়াশিংন ডিসি-কে এমন উত্তাল শেষ কবে দেখেছি? হোয়াইট হাউসের চতুর্দিক লোকারণ্য, সামনের রাস্তায় বিরাট করে লেখা হয়েছে প্রতিবাদের ধুয়ো— ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’, যাতে তা আকাশ থেকেও পরিষ্কার ফুটে ওঠে। প্রকাশ্যে যা দেখছি, তা-ই সব নয়। অপ্রকাশ্যে ঘটছে আরও কত কী। বিখ্যাততম সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান নিউ ইয়র্কে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন, কেননা একটি উত্তর-সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দমন-নীতির পক্ষে! ফিলাডেলফিয়ার আর একটি বড় সংবাদপত্রের সম্পাদক পদত্যাগ করেছেন, তাঁর কাগজ লুটপাট, ভাঙচুরের সমালোচনা করে হেডিং করেছিল ‘বিল্ডিংস অলসো ম্যাটার’! এই সব ঘটনা বলে দেয় সমাজের মেজাজটা। আইন-ভাঙার দলে আছেন যে মানুষরা, অনেক দুর্বিপাকে পড়েই, যন্ত্রণা সয়েই যে সে-পথে এসেছেন তাঁরা, এই কথাই বলছে আজকের আমেরিকার সমাজের বিরাট অংশ। কিছু সমীক্ষার মতে, যা দেশের সত্তর শতাংশেরও বেশি।
আর তাই, ‘আমেরিকা ২০২০’ কেবল জর্জ ফ্লয়েডের গলায় চেপে ধরা অফিসার শভিনের হাঁটুর জন্যই স্মরণীয় হয়ে থাকবে না। একে আভূমি কুর্নিশ জানাবে ভবিষ্যৎ, দেশের কালো মানুষদের সম্মান ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে দেশ স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য। সেই ভবিষ্যৎ মনে রাখবে— রোগগ্রস্ত, শোকগ্রস্ত, ক্ষুধাপীড়িত, অত্যাচারিত, অপশাসন-অধ্যুষিত ২০২০ বছরটির প্রেক্ষাপটে আমেরিকার প্রতিবাদীদের ছবি পৃথিবীময় একটা বিশ্বাস ফিরিয়ে আনছিল। মানবতার ওপর বিশ্বাস। মুক্তি আর অধিকারের যে ভাষা দীর্ঘ দিন এই দুনিয়ায় চর্চিত হয়ে এসে এখন হঠাৎ বিস্মরণ-সাগরে ডুবন্ত বলে মনে হচ্ছিল, তার প্রতি আশ্বাস।
এ কিন্তু কেবল নিজের অধিকারের কথা উঠে আসার আশ্বাস নয়— তার চেয়ে অনেক বড়, অনেক জরুরি কিছু। এ হল অন্যের জন্য লড়াই করার জোর, আর নিষ্পেষিতের অধিকার ফেরানোর দাবি তোলার সাহস। কেননা, আজকের এই বিরাট জনজোয়ার শুধু কালো মানুষদের নিয়ে তৈরি হয়নি, সাদারাও তাতে আছেন, বিরাট সংখ্যায় আছেন, নেতৃত্বে আছেন। অন্যান্য সংখ্যালঘুরা আছেন, ঘরণী-গৃহিণীরা আছেন, মায়েদের হাত ধরে শিশুরা আছে, হাই স্কুলের কৈশোর আছে। নিজের কথা নয়, অন্যের কথা বলতেই এঁরা পথে নেমেছেন! নিজের কাজ ছেড়ে, আরাম ছেড়ে, সম্ভাব্য সরকারি ক্রোধকে উপেক্ষা করে নেমেছেন। আজ এই আন্দোলনে নামার জন্য কাল এঁদের অনেকের জীবনেই ঘোর বিপদ নেমে আসতে পারে, ট্রাম্প প্রশাসন এমনই ‘খ্যাতি’র অধিকারী। তবুও তাঁরা নেমে এসেছেন।
যেখানে যেমন জনবিন্যাসই হোক না, মার্কিন সমাজে সাদারাই এখনও সংখ্যাগুরু, তাঁরাই ক্ষমতাবান। কিন্তু সংখ্যাগুরু আজ সংখ্যালঘুর সুরক্ষার দাবিতে মিছিলে পা মেলাতে মেলাতে বলছেন, ‘না-এসে পারলাম না’, ‘আই রিয়েলি কুডন’ট অ্যাফর্ড নট টু বি হিয়ার’। নিজেদের প্রত্যক্ষ ক্ষতি না হলেও পরোক্ষে সমাজের বিরাট ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, এমনই তাঁরা ভাবছেন। পুলিশ-প্রশাসনের বর্ণবিদ্বেষ থামিয়ে সমান অধিকারের কথাটা মনে করিয়ে দিচ্ছেন। আজকের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের ঐতিহাসিকতা খোদাই করছেন।
একটু কি ‘ক্লিশে’, বহুব্যবহারে একটু কি জীর্ণ কথাটা? ঠিকই তো, ‘অন্যের অধিকার’ তো এক বহুপরিচিত রাজনীতির আঙিনা, সামাজিক বোধের প্রথম মঞ্চ বলেই আমরা জানি। বিশ্বের অধিকাংশ অধিকার-আন্দোলনই তো অন্যের অধিকারের দাবিকে ঘিরে তৈরি হয়েছে, নয় কি? ষাটের দশকের সিভিল রাইটস আন্দোলনেও কি ঝাঁপিয়ে পড়েননি দলে দলে শ্বেতাঙ্গ মার্কিন, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, ছাত্রছাত্রী, এমনকি সাধারণ মানুষও? বিশ্বের অন্যত্রও, অসংখ্য কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে কি আমরা দেখিনি নাগরিক নেতাদের?
দেখেছি। কিন্তু এও দেখেছি, বিরাট বড় পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে কোথাও। সময় পাল্টেছে, রাজনীতি পাল্টেছে, সবচেয়ে পাল্টেছে সমাজের মন। খুব সংক্ষেপে আঁচড় বুলিয়ে সেই পরিবর্তনকে যদি ধরতে চাই, তবে বলতে হয়, বাম ও লিবারাল আদর্শবাদী রাজনীতির পতন, সঙ্গে সঙ্গে আইডেন্টিটি পলিটিকস বা সত্তাভিত্তিক রাজনীতির উত্থান, বাজার-অর্থনীতির বিপুল বিশ্বায়ন, আর পাল্লা দিয়ে বিশ্বায়িত আত্মস্বার্থ-মগ্নতার প্রসারণ, সেই ‘আত্ম’-এর ক্রমশ সঙ্কীর্ণ হতে-থাকা চেতনা আর ব্যঞ্জনার সংক্রমণ, এই সবই বড্ড পাল্টে দিয়েছে আমাদের চারপাশটাকে। এখন যে যার নিজের কথা বলাটাই ফ্যাশন, এবং অন্যের কথা না বলা (এবং না ভাবা)-ই হল স্বাভাবিক রাজনৈতিকতা ও সামাজিকতা।
ভারতের দিকেই তাকাই না কেন। সহজে কি আর আমরা ভাবতে পারি যে, সংখ্যালঘু মানুষ কিংবা দলিত মানুষদের জন্যে দেশ জুড়ে রাস্তায় নেমে আসছেন বিপুল সংখ্যক ‘সংখ্যাগুরু’? ছাত্রসমাজ ও কিছু বামভাবাদর্শী রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া আর কেউ? মূলস্রোতের রাজনীতিই হোক, আর সাধারণ নাগরিক সমাজই হোক, দেখেছি কি সরকারি অপশাসন বা নির্যাতনের বিরুদ্ধে এমন বাঁধভাঙা প্রতিরোধের আবেগ ঢেলে দিতে? বরং যে সব মানুষ সরকারের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলছেন—সরকারি বাবুর সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের পারিষদরাও তাঁদের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন—‘বাড়াবাড়ি’! বলেছেন, বাঃ বেশ তো সংখ্যালঘু-তোষণ! বলেছেন, এ সব স্রেফ জাতীয়তাবিরোধিতা, দেশদ্রোহিতা!
অবাক হই না। ভারত এই রকমই। জন্ম-ধর্ম-গোষ্ঠী-শ্রেণি পরিচিতির কারণে অত্যাচার এখানে হয়েই থাকে, হয়েই চলে। তাই মার্কিন দেশেই হোক, দক্ষিণ আফ্রিকাতেই হোক, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধতা আমাদের পোষায় না, আমরা বর্ণাশ্রমবাদের পুজো করি। আমরা উঁচু ওরা নিচু, আমরা পাব ওরা পাবে না, এটাই সত্যি বলে মানি! বারো বছরের বালিকা শয়ে শয়ে মাইল হেঁটে মৃত্যুতে লুটিয়ে পড়বে, মন্দিরে পা দিয়ে ফেলেছিল বলে দলিত বালককে গুলি করা হবে, উঁচু জাতে মেয়েকে ভালবেসেছিল বলে নিচু জাতের যুবককে জনসমক্ষে জীবন্ত পোড়ানো হবে, মুসলিমরা কী খায় ভেবে তাদের পিটিয়ে মারা হবে, মুসলিমদের বাড়িঘর খুঁজে খুঁজে আগুন জ্বালানো হবে: এ সব আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক, ‘নর্মাল’, ‘ন্যাচারাল’। আমাদের রাজনীতি অন্য ভাবনায় ব্যস্ত। আমাদের সমাজ— না, উদাসীন নয়— এই সব দেখেশুনে বেশ হাসিখুশি, প্রসন্ন! কোনও মুসলিম বা দলিতকে প্রধানমন্ত্রী করা? আমরা এমন অনাছিষ্টি ভাবতেও পারি না!
এমন সরল কথা কক্ষনও ভাবা যাবে না যে ‘এই ভারত’ ‘ওই আমেরিকা’র মধ্যে নেই। আলবাত আছে, খুব আছে। অনেক সময় ভারতকে টেক্কা দেওয়ার মতো করেই আছে। আছে বলেই তো জর্জ ফ্লয়েড-এর ঘটনা ঘটে। কিন্তু মানতেই হবে— কালোদের পিযে মারতে আগ্রহী যে সাদা পুলিশরা, যে নেতারা, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাঁদের আটকাতে চাওয়ার মতো একটা ‘আমেরিকা’ও ও দেশের মধ্যে আজ প্রবল শক্তিতে জানান দিচ্ছে। এটা আসলে দুই আমেরিকার মোলাকাতের গপ্পো। সুতরাং প্রশ্নটা এখন, ‘ওই আমেরিকা’টি কি ‘এই ভারত’-এর মধ্যে আছে আদৌ? আমরা তো তাকে টের পাচ্ছি না, আজও, এতটুকুও?
‘ওই আমেরিকা’ দেখে মনে পড়ছে, নোম চমস্কি (হু রুলস দ্য ওয়ার্ল্ড) বলেছিলেন, চার পাশ দেখে যা-ই মনে হোক— মুক্তি, আত্মসম্মান, ব্যক্তিমর্যাদা, নিজের জীবনের উপর নিজের নিয়ন্ত্রণের ইচ্ছে— আছে, এই সবই আছে, আপাত-ফাঁপা সমাজ-তলের ঠিক নীচেই ভেসে আছে, জেগে উঠবে সময়মতো, সক্রিয় প্রতিবাদের পরিবেশ দেখলেই ফিরে আসবে: ‘রেডি টু রি-অ্যাপিয়ার হোয়েন অ্যাওয়েকেনড বাই সারকামস্ট্যান্সেস অ্যান্ড মিলিট্যান্ট অ্যাক্টিভিজম’। ‘ওই আমেরিকা’ এই মুহূর্তে প্রমাণ করছে কতটাই আর্ষবাক্য ছিল তাঁর কথা।
আর ‘এই ভারত’?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy