পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের উৎসব পর্ব এ বারের মতো সাঙ্গ হল। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট মোট প্রদত্ত ভোটের ৪৫.৫% ভোট এবং ৩৫০টি লোকসভা আসন পেয়ে আগামী পাঁচ বছরের জন্য ভারত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার অতি শীঘ্রই গ্রহণ করবে। প্রতিষ্ঠানবিরোধী সমস্ত উপাদানগুলিকে সম্পূর্ণ ভাবে নস্যাৎ করে দিয়ে সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিজেপির এই বিশাল জয় নিঃসন্দেহে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই অভূতপূর্ব সাফল্য, বঙ্গ রাজনীতির অঙ্গনে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা করল বলে মনে করা যেতেই পারে। অপর দিকে, বঙ্গ রাজনীতির প্রাঙ্গণে বিজেপির এই বিপুল উত্থান ‘বামফ্রন্টিদের’ কতখানি অপ্রাসঙ্গিক করে ফেলল, সেই দায় আমার নয়, বঙ্গ ‘বামফ্রন্টিদের’। কিন্তু বামপন্থা নিয়ে কিছু কথা বলার দায় এবং দায়িত্ব আপামর জনসাধারণের আলবাত আছে। তাই আমারও আছে।
আজ ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে ভূমি সংস্কার, অপারেশন বর্গা, স্কুলস্তরে সকলের অবৈতনিক শিক্ষার সুযোগ ইত্যাদি বিস্মৃতির অতল গভীরে শ্যাওলা ঘেরা প্রস্তরের নিরাপদ আশ্রয়ে। বরং আজ ২০১৯-এ দাঁড়িয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ‘বাম ভোট রামে’ হস্তান্তরের ঘটনার ঘনঘটা। কিন্তু এই ‘বাম ভোট রামে’ হস্তান্তরের ঘটনার দায় কি বামপন্থার? না কি প্রাগৈতিহাসিক ভাবনায় সমৃদ্ধ বঙ্গীয় ‘বামফ্রন্টিদের’? বঙ্গীয় ‘বামফ্রন্টিরা’ যত না কান পেতেছে মানুষের অন্তরে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলে ফেলেছে মিডিয়ার অন্দরে, সমাবেশের প্রান্তরে। আর রক্ত পতাকার ধ্বজাধারী হিসেবে দাবি করা এই ‘বামফ্রন্টিদের’ হাত বেয়ে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে বামপন্থার গাঢ় লাল রং। বর্তমান বঙ্গীয় তথা ভারতীয় রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বামপন্থার প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বকে এতটুকুও অস্বীকার না করেও একথা নিশ্চিত ভাবে বলা যেতে পারে যে, বামপন্থা ভারতীয় রাজনীতিকে নতুন পথের দিশা দেখাবে এমন দিবাস্বপ্ন অতি কট্টর বামপন্থীদেরও হয়তো আজ বিস্মিত করে তুলবে। বিশেষত, যাঁদের হাতে ভারতীয় বামপন্থা রক্ষার ধ্বজা বিগত দিনে এবং বর্তমান সময়কালে ন্যস্ত, তাঁদের হাত ধরে বামপন্থা যতটা না গৌরবান্বিত হয়েছে, তার চেয়ে বোধ হয় ঢের বেশি কলুষিত হয়েছে। তাই লাল দিগন্তের জন্য অনন্ত প্রতীক্ষাই এখন একমাত্র মুক্তির পথ বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে!
অন্য দিকে, বঙ্গ রাজনীতিতে বিজেপির এই অভূতপূর্ব উত্থানের পিছনে তৃণমূল কংগ্রেসের দায় কতখানি, তা নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করার দায় তৃণমূল কংগ্রেসের। কিন্তু কয়েকটি কথা এই প্রসঙ্গে না বললে ইতিহাসের কাছে দায়ী থেকে যেতে হবে যে! পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্পের সুবিধার আওতার বাইরে থেকে গিয়েছেন এমন মহিলার সংখ্যা এই বঙ্গদেশে নিতান্তই কম। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ‘সবুজসাথী’ প্রকল্পের মাধ্যমে দেওয়া সাইকেলও আজ বাংলার প্রায় প্রতিটি ঘরে ঘরে। গ্রামাঞ্চলে রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং বিদ্যুৎ পরিষেবার ব্যাপক উন্নতিসাধনের বাস্তব সত্য অস্বীকার করার কোনও পরিসর নেই। তবু কেন এই নির্বাচনী বিপর্যয়! কোথায় তা হলে ফাঁকটা রয়েই গেল?
বঙ্গ রাজনীতিতে বিজেপির এই বিপুল উত্থানের পিছনে ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি, উগ্র জাতীয়তাবাদী আবেগের উস্কানি, সার্জিকাল স্ট্রাইকের সাফল্যের গৌরবান্বিত প্রচার এবং সর্বোপরি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ব্যক্তিগত করিশ্মা যদি কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে, তা হলে নিশ্চয়ই আরও এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বঙ্গসমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়েছিল, যা তৃণমূল কংগ্রেসের বিজয়রথকে এমন ভাবে প্রতিহত করতে মরমে মরমে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিরুদ্ধমত প্রকাশের পরিসরের সঙ্কোচন, বিরোধীশূন্য রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ প্রতিষ্ঠার বলপূর্বক প্রচেষ্টা, অন্য দলের হয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান দখলের অদম্য আকাঙ্ক্ষা, সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক মনোভাবের অনুপ্রেরণায় ক্ষমতার আস্বাদে অন্য দল ছেড়ে আসা নেতা, কর্মীদের বাদবিচার না করেই দলে অন্তর্ভুক্তি এবং সর্বোপরি, বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারে অনভিপ্রেত হস্তক্ষেপ কি বহুলাংশে দায়ী নয় এই ‘বাম ভোট রামে’ এবং ‘কংগ্রেসি ভোট রামে’ হস্তান্তরের প্রক্রিয়া সৃষ্টির পিছনে! এই সকল প্রত্যক্ষ উপাদানের চোরা স্রোত কিন্তু ফল্গুধারায় মিশে ছিল বঙ্গসমাজের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। মূক প্রতিবাদ নীরবে প্রমাদ গুনছিল শুধুমাত্র সুযোগের প্রতীক্ষায়। এই পরিসরে সাম্প্রতিক অতীতে পাঁচ জন বিশিষ্ট মানবধিকার ও সমাজকর্মীকে গ্রেফতারের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মহামান্য সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণ পুনরায় উল্লেখ করার প্রাসঙ্গিকতা এনে দিল... “গণতন্ত্রে বিরোধী মত হল প্রেসার কুকারের সেফটি ভালভের মতো, যা খুলে নিলে প্রেসার কুকারে বিস্ফোরণ হতে পারে”।
তাই যা হওয়ার তাই হল। আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বোধহয় রাজনীতির দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা ভুলে যেতে বসেছিলেন। ভোটারেরা কোনও দলের বংশ পরম্পরাগত সম্পত্তি নন। বরং দেশের আপামর ভোটারেরা নিজেদের অভিজ্ঞতা, চেতনা, উপলব্ধি এবং বিবেকের দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক মননশীল মানুষ। যাইহোক, এই নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করার বিস্তর সময় পড়ে রইল বিজয়ী ও বিজিত রাজনৈতিক যুযুধান সব পক্ষের কাছেই।
সত্যটা হল, আগামী পাঁচ বছরের জন্য বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ভারতের রক্ষাকর্তা, নীতি নির্ধারক এবং সংবিধান ও গণতন্ত্রের ‘চৌকিদার’ হিসেবে দেশের আপামর জনসাধারণের দ্বারা নির্বাচিত। আর এই পাঁচ বছরে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের কাছে অন্য অনেক কিছু প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা থাকার সঙ্গে সঙ্গে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় প্রমাণ করার দায়ও কিন্তু বর্তে গেল। গণতন্ত্র শব্দটি শুধুমাত্র ভারতীয় সংবিধানের পাতায় থিতিয়ে পড়ে থাকবে, না কি এই শব্দটির প্রকৃত ব্যবহারিক প্রয়োগে আমরা সকলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে নিজেদের ভাবতে পারব, তা প্রমাণ করার দায়বদ্ধতা কিন্তু রয়ে গেল বিপুল জনমত নিয়ে নির্বাচিত বিজেপি নেতৃত্বাধীন এই এনডিএ সরকারের কাঁধে।
ভারতের নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত তথ্য অনুসারে, ভারতের মোট নির্বাচক মণ্ডলীর মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাংশ মানুষ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে তাঁদের গণতান্ত্রিক ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। আর এই ৬৪ শতাংশ প্রদত্ত ভোটের মধ্যে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট প্রায় ৪৫.৫ শতাংশ ভোট পেয়েছে। সুতরাং, বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট ভারতের মোট নির্বাচকমণ্ডলীর প্রায় ২৯ শতাংশ (৪৫.৫% × ৬৪%) মানুষের ভোট পেয়ে ভারত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করবে। অর্থাৎ, ভারতের মোট নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের পক্ষে ভোট দেননি। আর এখানেই লুকিয়ে আছে গণতন্ত্র শব্দটির প্রকৃত প্রয়োগের পরিসর।
দেশের মোট নির্বাচকমণ্ডলীর মধ্যে এই ৭১ শতাংশ মানুষ যাঁরা বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকারের পক্ষে ভোট দেননি, তাঁরাও কিন্তু দেশের নির্ভেজাল নাগরিক এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোর অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। তাঁদের কথা শোনা, তাঁদের ব্যথা বোঝা, তাঁদের নিরাপত্তার দায় গ্রহণ করা, তাঁদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিসর সঙ্কোচন না করা, তাঁদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করা, সংবিধান প্রদত্ত প্রাপ্য অধিকার থেকে তাঁদের কোনও ভাবে বঞ্চিত না করা ইত্যাদি গণতন্ত্রের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।
আর এই সকল প্রক্রিয়ার সুষ্ঠু প্রয়োগের মধ্যেই মিশে আছে প্রকৃত গণতন্ত্রের বহিঃপ্রকাশ এবং নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের প্রকৃত রাজধর্ম। বাকিটা বলবে অমোঘ সময়।
লেখক সমাজবিজ্ঞানের গবেষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy