Advertisement
২১ নভেম্বর ২০২৪
ব্যক্তিনির্ভর রাজনৈতিক দলে এ রকমই হয়ে থাকে, সর্বত্র
West Bengal Politics

কবে, কী ভাবে, প্রশ্ন সেটাই

শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮-এর লোকসভা ভোটে এখানে কংগ্রেসের প্রার্থী বাছাই কমিটির দায়িত্ব না পেয়ে ’৯৭-এর শেষে মমতা দল ছাড়লেন। এমন যে হতে পারে, তার আভাস ছিল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০২৪ ০৭:০৩
Share: Save:

একে একে দুই হয়, দুয়ে দুয়ে চার। আশা করা যায়, এ নিয়ে কারও কোনও অভিযোগ বা সন্দেহ নেই! যদি না থাকে, তা হলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরসূরি যে অভিষেক, তা নিয়েই বা এত চর্চা কিসের? এটা তো স্বতঃসিদ্ধ। শুধু এখনও না-জানা বিষয়টি হল, কবে কাজটি হবে এবং কী ভাবে।

দেশের অনেক আঞ্চলিক দলের মতো তৃণমূলও মূলত এক জনের একক ক্যারিসমা দিয়ে তৈরি। দলটি পত্তনের ইতিহাস নতুন করে আলোচনার প্রয়োজন আর নেই। কেবল এটুকুই ঝালিয়ে নেওয়ার যে, প্রদেশ কংগ্রেসের গোষ্ঠী কোন্দলে মমতা ও তাঁর পার্ষদ, সমর্থক, অনুরাগীরা ‘কোণঠাসা’ হয়ে পড়েছিলেন। দলের হাই কম্যান্ডের কাছেও তাঁরা ‘প্রত্যাশিত’ স্বীকৃতি পাচ্ছিলেন না। যদিও জনগণের দৃষ্টিতে মমতা তখন রাজ্যে শাসক সিপিএমের বিরুদ্ধে আন্দোলনে সবচেয়ে লড়াকু ও বিশ্বাসযোগ্য মুখ।

শেষ পর্যন্ত ১৯৯৮-এর লোকসভা ভোটে এখানে কংগ্রেসের প্রার্থী বাছাই কমিটির দায়িত্ব না পেয়ে ’৯৭-এর শেষে মমতা দল ছাড়লেন। এমন যে হতে পারে, তার আভাস ছিল। তৃণমূল কংগ্রেস নামটিও তাঁর আগেই ভাবা ছিল। কিন্তু আসল ঘটনাটি ঘটেছিল প্রায় বিনা নোটিসে। এক বিকেলে কী কারণে এবং কতটা আকস্মিক ভাবে তিনি পরের দিনই নতুন দল ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন, সাংবাদিক হিসাবে আগাগোড়া তার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। পরে যদিও এ নিয়ে বাজারে নানা রকম ‘গল্প’ বেরিয়েছে। সেই সব প্রসঙ্গ থাক।

মোদ্দা কথা হল, তৃণমূল সর্ব অর্থে মমতার দল। সমাজবাদী পার্টি যেমন মুলায়মের দল, ডিএমকে করুণানিধির, এনসিপি শরদ পওয়ারের ইত্যাদি। কালের নিয়মে নতুন প্রজন্ম উঠে এলেও এই পরিচিতিগুলি জনমনে থেকে যায়। আর তৃণমূলের ক্ষেত্রে তো মমতা স্বয়ং এখনও পূর্ণ বিরাজমান। তাই তাঁর দলে জয়-পরাজয়, উত্থান-পতন, সাফল্য-ব্যর্থতা সব কিছুই আজও ‘মমতা’-য় বর্তায়। তিনিও বলতে পারেন বিধানসভার ২৯৪ বা লোকসভার ৪২ আসনে তিনিই তাঁর দলের প্রার্থী।

বিরোধী নেত্রী থেকে শাসক— দুই ভূমিকাতেই তাঁর এই অবস্থান চ্যালেঞ্জ করার পরিস্থিতি ওই দলে তৈরি হয়েছে বলে মনে করি না। এর মধ্যে ভাল-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, গণতন্ত্র-স্বৈরতন্ত্র খুঁজতে গেলে হন্যে হতেই হবে। কারণ ব্যক্তিনির্ভর যে কোনও দলে এমনটাই হয়ে থাকে। বিশেষ করে দল যদি তাঁর নেতৃত্বে ‘এগোতে’ পারে, তবে তো কথাই নেই! বঙ্কিমচন্দ্র কবেই বলেছেন, ‘চাঁদমুখের সর্বত্র জয়’। রাজনীতিতে ‘ভোট-মুখ’এর বেলাতেও বিষয়টা অনেকটা সেই রকম।

কিন্তু কোনও পরিস্থিতিই চিরকালীন হতে পারে না। তাই সময়ের দাবি অনুযায়ী মুলায়ম যাদবের দলে অখিলেশ আসেন, লালু যাদবের দলে তেজস্বী, করুণানিধির দলে স্ট্যালিন ও তস্য পুত্র। এমন উদাহরণ বিস্তর আছে।

অনেক ক্ষেত্রেই দলের মূল নেতা নিজে উত্তরসূরিকে দায়িত্ব দিয়ে তৈরি হতে সাহায্য করেন। ইন্দিরা গান্ধী থেকে শুরু করে লালু, মুলায়ম, দেবগৌড়া প্রমুখ সকলে তা-ই করেছেন। ইন্দিরা তাঁর তৈরি কংগ্রেসে সঞ্জয় গান্ধীকে সাধারণ সম্পাদক করে ধাপ প্রস্তুত করছিলেন। সঞ্জয়ের অকালমৃত্যুর পরে রাজীবকে রাজনীতিতে এনে তিনি ওই পদটিই দেন। মমতা দশ বছর আগে তৃণমূলের সাংসদ করেছিলেন অভিষেককে। দলের যুব শাখার প্রধান থেকে আজ তিনি সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হিসাবে গোটা সংগঠনের দায়িত্বে।

এর পিছনেও কোনও গূঢ় তত্ত্ব বা উদ্দেশ্য খোঁজার দরকার আছে কি না জানি না। প্রথমত, যাঁর নামে দল, তিনি কাকে কোন পদের অধিকারী করবেন, এটা মূলত তাঁর ভাবনা। দ্বিতীয়ত, নিজের সৃষ্টির প্রতি স্বাভাবিক মমত্ব বোধ সবার থাকে। সেটা রাজনৈতিক দল, সংস্থা, ব্যবসা যা-ই হোক। সেখানে নির্ভরতার সবচেয়ে বড় জায়গা পরিবারের লোক।

রাজনীতির প্রতি অভিষেকের আগ্রহ তৈরি হয় ছোটবেলা থেকেই। শৈশবের অভিষেককে দেখা গিয়েছে খেলাচ্ছলে ছোট্ট লাঠির ডগায় এক টুকরো কাপড় বেঁধে বাড়ির অঙ্গনে দৌড়ে ‘দিদিকে মারলে কেন’ বলে ‘প্রতিবাদ’ করতে। মমতার মাথা জুড়ে তখন লালু আলমের লাঠি মারার ব্যান্ডেজ। বড় হয়ে মমতার সান্নিধ্য তাঁকে রাজনীতিতে আরও বেশি প্রভাবিত করে।

২০১৬-র কিছুটা চাপের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের দ্বিতীয় দফা জয়ের পরে ২০১৪-তে প্রথম সাংসদ হওয়া অভিষেকের ছবি-সহ ‘ম্যাচ উইনার’ হোর্ডিং শহরে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাতে ওই দলে এবং জনগণের মধ্যে আলোড়নও ওঠে। আর তখন থেকে এটাও বোঝা গিয়েছিল যে, নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব জাহির করতে অভিষেক পিছপা নন। আজ তিনি নেতৃত্বে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত।

যিনি যে কাজই করতে আসবেন, সেই কর্মক্ষেত্রে তাঁর উচ্চাশা থাকা সঙ্গত। শুধু রাজনীতির সাপ-লুডোয় দ্রুত মই দিয়ে উঠে সাপের মুখে পড়ে গেলেই মুশকিল। অভিষেকের মধ্যে ‘চঞ্চলতা’র বিভিন্ন প্রকাশ কিন্তু ছিল। ইদানীং বোধ হচ্ছে, তিনি সচেতন ভাবেই নিজেকে নানা দিক থেকে বদলে ফেলছেন। তাঁর সহিষ্ণুতা, যুক্তিবোধ, সংযত পদক্ষেপ এখন আলোচিত হয়। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের পর থেকে এটা বেশি করে নজরে পড়ছে। যাকে ‘অভিষেক-২’ বলা যেতেই পারে।

বিজেপির কাছে ঘা খাওয়া তৃণমূলকে ’২১-এর বিধানসভা ভোটের জন্য প্রস্তুত করার অন্দর-পর্বে তাঁর ভূমিকা অনেকেরই জানা। ’২৪-এর লোকসভাতেও তা-ই। তৃণমূলের কাছে ওগুলি ছিল বড়সড় চ্যালেঞ্জ। মমতাকে সামনে রেখেই অভিষেক ভোটের ভার অনেকখানি বহন করেছেন।

যদিও তৃণমূলের একাংশ থেকে বহু সাধারণ মানুষ মমতা এবং অভিষেকের মধ্যে ‘বিরোধ’ খুঁজতে উৎসুক। অনেকে বলে থাকেন, তৃণমূলের একেবারে উঁচুতলায় এই ‘সংঘাত’ দলে ভাঙন পর্যন্ত ধরিয়ে দিতে পারে। তবে কাজের সূত্রে মমতা এবং অভিষেক দু’জনকেই কিছুটা কাছ থেকে দেখার সুযোগে যেটুকু বুঝেছি, তাতে এর বেশিটাই জল্পনা বা রজ্জুতে সর্পভ্রম! মতান্তর হলেও সব সময় তা মনান্তর হয় না।

আসলে বড় এবং ছোট-র মধ্যে মান-অভিমান বা মতের অমিল যে কোনও পারিবারিক সম্পর্কের অলঙ্কার। যেমন হয়, তেমনই মিটে যায়। এ ক্ষেত্রেও আলাদা কিছু নয়। মনে রাখতে হবে, মমতা রাজনীতিতে প্রাজ্ঞ। আর অভিষেকও বুদ্ধিমান ও পেশাদারিত্বে আস্থাশীল। হাঁস মেরে ডিম খাওয়ার ‘পরিণাম’ তাঁরা কেউই কম বোঝেন না।

মমতা যে এখনও তৃণমূলের প্রধানতম শক্তিস্থল এবং বিকল্পহীন ভোটের মুখ, সেটা অভিষেক বিলক্ষণ জানেন। আবার মমতাও বোঝেন, ভোট-কৌশলের রূপায়ণে সাংগঠনিক পরিকাঠামো তৈরি থেকে নতুন প্রজন্মের ভোটারদের কাছে পৌঁছনোর ক্ষেত্রে অভিষেকের ভূমিকা এখন যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, একে অপরের পরিপূরক।

এই প্রেক্ষাপটেই এ বার ‘নব-অভিষেক’ প্রসঙ্গ। তৃণমূলের সরকারে মমতার পরে অভিষেক মুখ্যমন্ত্রী— এই ঘোষণায় কোনও ‘আবিষ্কার’ নেই। আগ্রহের বিষয় একটিই, ’২৬-এর বিধানসভা নির্বাচনের দৌড় শুরুর আগে কথাটি উঠল কেন? অভিষেক অচিরে রাজ্য মন্ত্রিসভায় যোগ দিতে পারেন বলেও ইতিমধ্যেই গুঞ্জন উঠেছে। অনেকে ভাবছেন, এটা মাঠে নামার আগে ‘পিচ’ তৈরির সবুজ সঙ্কেত। অনেকের মতে, ‘বয়স্ক’ মন্ত্রী-নেতাদের কাছে প্রচ্ছন্ন বার্তাও। আদৌ কী, জানা নেই।

’২৬-এর ভোট হতে বছর দেড়েক। অধিকাংশের অনুমান, মমতা যত দিন সক্ষম ও সক্রিয় থাকবেন, তত দিন তাঁর প্রাধান্যকে মান্যতা দিয়েই এগোবেন অভিষেক। দরকারমতো প্রশাসনের কাজকর্ম নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ‘পরামর্শ’ দেওয়ার সুযোগ শাসক দলের শীর্ষ নেতার থাকে। অভিষেক তো তাঁর দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক।

কিন্তু রাজনীতির গতিপথ সর্বদা এক রকম থাকে না। তাই বিধানসভা ভোটের আগেই সাংসদ পদ ছেড়ে অভিষেক সরাসরি সরকারে যোগ দেবেন কি না, সেই আগ্রহ থাকছেই। আপাতত প্রতীক্ষা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy