গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস
একশো বছরের নিঃসঙ্গতা’-র কথা মনে পড়ে? আজ যেমন আমরা শামুকের মতো ঘরের চৌহদ্দির চেনা খোলসের মধ্যে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিয়েছি, তেমনই অবরুদ্ধ এক সময়ের কথা আছে গত শতাব্দীর লাতিন আমেরিকার এই মহৎ উপন্যাসে। এই উপন্যাসে লেখক গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (ছবিতে) বেশ কয়েকটি মহামারির কথা বলেছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে আছে অনিদ্রার মহামারি। এক কল্পিত জনপদ ‘মাকোন্দো’-র বুয়েন্দিয়া পরিবারে হাজির হয় একটি ছোট্ট মেয়ে রেবেকা, যার বাবা-মার কথা এই পরিবারের কেউ মনে করতে পারে না। এই বহিরাগত, অপরিচিত রেবেকাই প্রথম আক্রান্ত হয় অনিদ্রায়। সবার আগে তা বুঝতে পারে বাড়ির পরিচারিকা আদিবাসী বিসিতাসিয়োন এবং সবাইকে সে সতর্ক করে দেয়। বলে যে এই মহামারির ভয়ঙ্কর দিক কিন্তু ঘুমোতে না পারা নয়, বরং স্মৃতির অবলুপ্তি।
শুরুতে কেউ তার কথায় আমল দেয় না। পরিবারের কর্তা হোসে আর্কাদিয়ো বুয়েন্দিয়া এ সব নেহাতই আদিবাসীদের কুসংস্কার ভেবে হেসে উড়িয়ে দেন। বলেন, না ঘুমোলে জীবনে অনেকটা বেশি সময় পাওয়া যাবে। কিন্তু বেশ কিছু সপ্তাহ পরে আবিষ্কার করেন যে তারা সকলেই সংক্রমিত। বিগত পঞ্চাশ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে কেউ ঘুমোতে পারেনি। তাদের বাড়িতে তৈরি ক্যান্ডি বিক্রি হত বাজারে। ফলত পুরো শহর সংক্রমিত হয়ে গেল খুব দ্রুত। তখন হোসে আর্কাদিয়ো গ্রামের সব পরিবারের কর্তাদের ডেকে মাকোন্দোকে অবরুদ্ধ করার প্রস্তাব দিলেন, যাতে অন্যান্য গ্রামে এই মহামারির সংক্রমণ না ঘটে। বাইরের লোকের জন্য মাকোন্দোর খাবার বা জল ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হল, কারণ তত দিনে বোঝা হয়ে গিয়েছে যে রোগটা মুখে মুখে ছড়াচ্ছে। তার পর এক দিন এই অবরুদ্ধ অবস্থায় মানুষ এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গেল যে আপৎকালীন পরিস্থিতিকেই তারা স্বাভাবিক অবস্থা হিসেবে মেনে নিল, এবং ঘুমের মতো একটা ফালতু বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে যে যার কাজ করে যেতে লাগল। তখনই এল সেই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি— বিস্মৃতি।
কী এই বিস্মৃতি? বিসিতাসিয়োন সে কথা আগেই বলে দিয়েছিল। যখন সংক্রমিত ব্যক্তিটি জাগ্রত অবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে, ধীরে ধীরে মুছে যেতে শুরু করবে তার ছেলেবেলার স্মৃতি, তার পর ভুলে যাবে জিনিসপত্রের নাম ও তার উদ্দেশ্য, সব শেষে ভুলে যাবে অন্যদের পরিচয়, এমনকি আত্মপরিচয়ও। আর তখন এমন এক জড়বুদ্ধি অবস্থায় পরিণত হবে যার আর কোনও অতীত থাকবে না। অতীত নেই, অর্থাৎ স্মৃতির অভিজ্ঞতা নেই। স্মৃতি কী? বোর্হেস সংক্ষেপে খুব সুন্দর ভাবে বলেছেন, আমরা হলাম আমাদের স্মৃতির সমষ্টি (Somos nuestra memoria)। স্মৃতি হারিয়ে গেলে ‘আমি’ এই ব্যক্তিটির কী পড়ে থাকে? কিছুই না, হাড়-মাংসের একটি কাঠামো ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তখন সে কার সঙ্গে কথা বলবে? কী নিয়েই বা কথা বলবে? এমনকি একা একা স্বপ্ন দেখার জন্যও যে স্মৃতির প্রয়োজন! এই স্মৃতিহীনতাই নিঃসঙ্গতার প্রতীক।
আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে গার্সিয়া মার্কেস যে মহামারির বর্ণনা দিয়েছেন, তা প্রায় ভবিষ্যদ্বাণীর মতো আজকের সংক্রমণের প্রতিটা পর্যায়ের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে। তবে কি এখন সেই সামগ্রিক নিঃসঙ্গতার দিকে এগোচ্ছি আমরা? এর প্রতিকারই বা কী? এখনও পর্যন্ত কোনও দেশ তার হদিশ দিতে পারেনি। তবে গার্সিয়া মার্কেস পেরেছেন। তাঁর গল্পে মাকোন্দোকে অনিদ্রার হাত থেকে বাঁচায় মেলকিয়াদেসের পুরিয়া। মেলকিয়াদেস এ উপন্যাসের অন্যতম এক স্তম্ভ; সে যাযাবর, সারা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়েছে, তার জ্ঞান অসীম এবং সে মৃত্যুত্তীর্ণ।
আমরাও যেন তেমন কোনও উত্তরণের অপেক্ষায়। আমাদের স্মরণকালে এ রকম আর কোনও ঘটনা ঘটেনি, একমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ বাদে, যাতে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ একই সমস্যায় আক্রান্ত, একই আতঙ্কে বিপর্যস্ত, একই অনিশ্চয়তায় বিষণ্ণ। বিশ্বযুদ্ধের সময়ে অন্ততপক্ষে শত্রু ও মিত্র দু’জন দু’জনকে চিনত। জানত, লড়াইটা ছিল নিজেদের মধ্যে। কিন্তু এই শত্রুর ভিতর-বাহিরের অনেক কিছুই এখনও আমাদের অজানা। সেই অপরিচিতের ভয় আমাদেরকে গ্রাস করছে। তাই আমরা স্বনির্বাসনে; স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী, কারও কাছাকাছি যাচ্ছি না, মুখোশ ঢেকে রেখেছে আমাদের মুখ, ‘হাতের উপর হাত রাখা’ এখন নিষিদ্ধ। আর এ ভাবে বিচ্ছিন্ন হতে হতে এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি, যখন অবরোধের দিনলিপি তার নতুনত্ব হারিয়ে দৈনন্দিনে পরিণত হচ্ছে আর বিরক্ত হওয়ার উৎসাহটুকুও হারিয়ে ফেলে আমরা একা হওয়া থেকে ক্রমশ সামগ্রিক নিঃসঙ্গতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy