শুরুতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে তা বিপজ্জনক হতে পারে। নিজস্ব চিত্র
এ বছরেও ব্যতিক্রম হল না। বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার শাল-সমৃদ্ধ বনাঞ্চলে ফি বছরই এই সময়ে আগুন লাগে। সেই রীতি মেনে যেন বাঁকুড়ার গঙ্গাজলঘাটি, শুশুনিয়া পাহাড়, কেশরার পাশাপাশি পুরুলিয়ার বাঘমুণ্ডি, বলরামপুরের পাহাড়ের বনরাজি দিন কয়েক আগে পুড়ল আগুনে।
বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলের বেশির ভাগ জায়গায় শাল গাছের ছড়াছড়ি। শীতের মাঝামাঝি থেকেই গাছের পাতা শুকোতে শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যেই শুকনো হলুদ পাতায় প্রায় ঢাকা পড়ে বন। দু’জেলার কয়েক হাজার হেক্টর বনভূমিতে জমে থাকা এই শুকনো শাল পাতা বারুদের মতো অপেক্ষা করে একটু আগুনের জন্য।
অথচ আগুনে না পুড়লে প্রাকৃতিক নিয়মেই এই পাতার স্তর ধীরে ধীরে সারে পরিণত হয়। বর্ষার জলে বনভূমির ক্ষয় রোধ করতে, মাটির নীচে জলকে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে ভূগর্ভস্থ জলের সঞ্চয় বাড়াতে, নানা বন্য জন্তু, উদ্ভিদ, কীটপতঙ্গ, পাখি-সহ অন্য প্রাণীর বংশ বিস্তারের পাশাপাশি তাদের বেঁচে থাকার পরিবেশ তৈরি করতে শাল পাতার পুরু আচ্ছাদন মাটির উপরে যেন বর্মস্বরূপ।
পাশাপাশি, বনভূমির মাটি উর্বর করে বাস্তুতন্ত্র রক্ষায় একমাত্র প্রাকৃতিক উপায়ও বটে। এত বিশাল পরিমাণ বনভূমির মাটিকে উর্বর করতে, তাকে রক্ষা করতে আর কোনও সহজ উপায় আমাদের কাছে নেই।
এখন প্রশ্ন, বনে আগুন লাগে কেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ইচ্ছাকৃত ভাবে আগুন লাগানো হয়। যাঁরা জঙ্গলে জ্বালানি সংগ্রহ করতে যান, তাঁরা জঙ্গলের দুর্গম পথ এড়িয়ে পায়ে হাঁটা পথ ধরেই জ্বালানি সংগ্রহ করেন। গোটা বনে এ সময়ে শালের শুকনো হলুদ পাতা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এমন ভাবে থাকে যে, সেই সব হাঁটাপথ বুঝতে অসুবিধা হয়। আর চেনা রাস্তা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তায় যাতায়াত যথেষ্ট বিপজ্জনক। কারণ, বনের পথ সর্বত্র সমতল নয়। কোথাও উঁচু কোথাও নিচু, কোথাও গর্ত, কোথাও নুড়ি-পাথরের সমাবেশ তো কোথাও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পাথরের খণ্ড হাঁ করে আছে। শুকনো পাতার স্তর এমন ভাবে আচ্ছাদিত হয়ে থাকে যে, পথের বিপদ আঁচ করা যায় না।
পাশাপাশি, বিষাক্ত সাপ, পোকামাকড়ও পাতার মধ্যে লুকিয়ে থাকে। এই সব সমস্যার সমাধান হল পাতার স্তরে আগুন লাগানো। পথ তখন একেবারে সাফ। তা ছাড়া, আগুনে প্রচুর ছোট-মাঝারি-বড় গাছ পুড়ে গেলে সেগুলি সহজে সংগ্রহ করা যায়।
আবার, যারা বনের গাছ চুরি করে, বনভূমির নীচের দিক পরিষ্কার থাকলে বনকর্মীদের গতিবিধি বোঝা তাদের পক্ষে সহজ হয়। বন সাফ থাকলে কাঠ কাটতেও সুবিধা হয়। পাশাপাশি, বনে আগুনে পুড়ে গেলে বনের মধ্যে অনেক দূর পর্যন্ত সহজে দেখা যায়। এতেও কাঠ চুরিতে সুবিধা হয়। তাই এই সব চোরেরাও জঙ্গলে আগুন ধরায়।
পাশাপাশি, শিকারিরাও আগুন লাগায়। বন্যপ্রাণীরা আগুনে ভয় পায়। বনে হঠাৎ আগুন লাগিয়ে দিলে জন্তুরা ভয় পেয়ে দিকভ্রান্ত হয়ে এ দিক ও দিন ছুটতে থাকে। হারিয়ে যায় ওদের বাসস্থান। আগুন লেগে বনের নীচের দিক পরিষ্কার হয়ে গেলে শিকারিদের শিকারেও সুবিধা হয়। বাসস্থান বা লুকনোর জায়গা না মেলায় সহজেই বন্যপ্রাণীরা শিকার হয়। আগুনের ভয়ে ছুটোছুটিতে অনেক পশুর বাচ্চাও পালাতে পারে না। শিকারিরা সহজেই তাদের শিকার করে। এমনকি, বড় প্রাণীরাও অনেক সময়ে আগুনে ঝলসে যায় না হয় মারা যায়। আগুন নেভার পরে আতঙ্কের রেশে অনেক প্রাণীর বংশবৃদ্ধিও ব্যাহত হয়।
এর সঙ্গে গোচারণের এলাকা বাড়ানোর জন্য, জঙ্গল লাগোয়া এলাকার জমি দখলের উদ্দেশ্যে এবং বনভূমির মধ্যে যাতায়াতকারী বা ভ্রমণকারীরা নিজেদের অজান্তেই জ্বলন্ত সিগারেট, বিড়ি বা দেশলাই কাঠি ছুড়ে ফেলার ভুলেও জ্বলে ওঠে জঙ্গলের শাল পাতার স্তূপ।
শুরুতে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে তা বিপজ্জনক হতে পারে। বিশেষ করে যদি বাতাস বয়। তখন আগুনের লেলিহান শিখা শাল পাতার স্তূপ ছাড়িয়ে ধীরে ধীরে আধা শুকনো গাছ, গুড়ি, পড়ে থাকা কাঠকে পুড়িয়ে দাবানলের রূপ নিতে থাকে। তখন বাদ যায় না সবুজ লতা-পাতা, উদ্ভিদের কন্দ, বীজ ও মূল, মাটির নানা উপকারী জৈব-অজৈব পদার্থ থেকে শুরু করে জীবজন্তুও। ঠিক যেমনটি হয়েছিল কয়েক মাস আগে আমাজনের জঙ্গলে, অস্ট্রেলিয়ায় ও বিশ্বের বেশ কিছু জঙ্গলে। পুরুলিয়া ও বাঁকুড়ার দুর্গম পাহাড়ি বনভূমিও তার ব্যতিক্রম নয়।
করোনার আতঙ্কে যখন সবাই গৃহবন্দি, তখন বনে আগুন নেভানোর কাজ বেশ কঠিন। আর শুধু বন দফতরের নিচু তলার কর্মচারীদের দোষ দিলে হবে না। আগুন রোধে শুধু বন দফতর নয়, যৌথ বন পরিচালনা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত সকলকে এবং প্রশাসনকেও সক্রিয় ভাবে এগিয়ে আসত হবে। বনের আগুন রোধে চাই সচেতনতা আর সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সমস্ত স্তরের আধিকারিকদের বনসুরক্ষা কমিটিদের সঙ্গে বারবার সভা করে আগুন বন্ধে কাণ্ডারীর ভূমিকা নিতে হবে।
সুখের কথা, বনে আগুন লাগানোর কুফল সম্পর্কে মানুষ, বিশেষ করে বনকে ঘিরেই যাঁদের জীবন আবর্তিত হয়, তাঁরা আজ অনেকটাই সচেতন। প্রাকৃতিক ভাবে আগুন লাগলে কিছু করার নেই। তবে মানুষের কোনও কার্যকলাপে যেন সবুজ ধ্বংস না হয়, তা লক্ষ্য রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।
অবসরপ্রাপ্ত বন আধিকারিক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy