উপাচার্যেরা বলিয়াছেন, তাঁহাদের উপর রাজ্য সরকারের কোনও চাপ নাই, তাঁহারা স্বাধীন ভাবেই কাজ করেন। শিক্ষামন্ত্রী বলিয়াছেন, উপাচার্যেরা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই স্থির করেন, তাঁহাদের ‘আমরা কোনও চাপ দিই না।’ রাজ্যপাল তথা আচার্য বলিয়াছেন, উপাচার্যেরা খাঁচাবন্দি ও ভীত। কে ঠিক বলিতেছেন, কে ভুল বলিতেছেন, অথবা কাহার কথার কয় আনা খাঁটি এবং কয় আনা ভেজাল, বুঝ লোক যে জানো সন্ধান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের লইয়া যখন এমন বিচিত্র সওয়াল-জবাব চলিতে থাকে, এবং তাঁহারা নিজেরাও যখন সেই চাপান-উতোরের বিষয় হিসাবে সীমিত না থাকিয়া সংলাপে যোগ দেন, তখন চমৎকৃত নাগরিকের কণ্ঠে শোনা যাইতে পারে ওয়ান্ডারল্যান্ডের কাণ্ডকারখানা দেখিয়া বিস্মিত অ্যালিস-এর ভাষা: ‘কিউরিয়সার অ্যান্ড কিউরিয়সার!’ কিংবা, প্রিয়তোষের পেটের ভিতর পরশপাথর দ্রুত ক্ষয় হইতে দেখিয়া হতবাক ডাক্তার নন্দীর মতো স্বগতোক্তি: ‘অ্যামেজ়িং কেস!’ অথবা, অ-দ্বিতীয় জটায়ুর প্রতিধ্বনি: ‘হাইলি সাস্...’।
সংশয় আকাশ হইতে পড়ে না। এই রাজ্যে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অধ্যক্ষ, উপাচার্যদের উপর চাপ সৃষ্টির অভিযোগ বহু কাল ধরিয়াই বহুশ্রুত, পশ্চিমবঙ্গের অন্য অনেক ব্যাধির মতোই ইহাও বামফ্রন্টের অবদান। এবং অধিকাংশ বাম-ব্যাধির মতোই এই রোগটিকেও তৃণমূল কংগ্রেস সরকার নিষ্ঠাভরে বহন করিয়া চলিয়াছে। অনিলায়নের কাঠামোটি পার্থযুগেও মহিমময়, কেবল তাহার চালচলন পূর্ববর্তী জমানার তুলনায় আরও প্রকট, আরও স্থূল হইয়াছে। এই পুরানো সরকারি চাপের সহিত অধুনা যুক্ত হইয়াছে এক নূতন উপসর্গ। তাহার উৎস: রাজভবন। শ্রীযুক্ত জগদীপ ধনখড় সেই ঠিকানায় অধিষ্ঠিত হইয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসাবে তাঁহার নবলব্ধ ভূমিকাটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে শুরু করিয়াছেন। অতিরিক্ত এবং দৃষ্টিকটু গুরুত্ব। বস্তুত, রাজ্য সরকার তথা শাসক দলের সহিত তাঁহার প্রায় বিরামহীন দড়ি-টানাটানির প্রথম ও প্রধান ময়দান হইয়া দাঁড়াইয়াছে বিশ্ববিদ্যালয়। স্বভাবতই, উপাচার্যেরা সেই দ্বৈরথের মাঝখানে পড়িয়াছেন। তাঁহাদের বিড়ম্বনার বহু ছবি রাজ্যবাসী গত কয়েক মাসে দেখিয়াছেন। সেই ছবি গৌরবের নহে।
অগৌরবের চালচিত্রটি প্রকট বলিয়াই আপাত-স্বাভাবিক আচরণ লইয়াও প্রশ্ন উঠিতেছে। উপাচার্যেরা প্রায় সকলে মিলিয়া ‘নিজেদের মধ্যে সমন্বয় বাড়াইবার উদ্দেশ্যে’ একটি পরিষদ গঠন করিয়াছেন, ইহাতে আপাতদৃষ্টিতে অস্বাভাবিক কিছু নাই। তাঁহারা কয়েক জন সিএএ-এনআরসি’র বিরুদ্ধে প্রতিবাদরত ছাত্রছাত্রীদের পাশে দাঁড়াইয়াছেন বা বসিয়াছেন, তাহাও অবশ্যই অসঙ্গত নহে, বরং অভিবাদনযোগ্য। কিন্তু উপাচার্য পরিষদ গঠনের ‘অনেক পুরনো’ পরিকল্পনাটি রূপায়ণের জন্য রাজভবন-নবান্ন দ্বন্দ্বের এই চরম লগনটিকেই বাছিয়া লওয়া হইল! আবার, ওই পরিষদ গঠনের প্রায় অব্যবহিত পরেই দেখা গেল, তাঁহাদের কয়েক জন শাসক দলের অনুগামী ছাত্রছাত্রীদের অবস্থান-মঞ্চের সামনে শিক্ষামন্ত্রীর পাশে উপবিষ্ট, যে শিক্ষামন্ত্রী হাটের মাঝে দাঁড়াইয়া বারংবার ঘোষণা করিয়া থাকেন: শিক্ষকদের বেতন যখন সরকার দেয়, তখন সরকার শিক্ষার পরিচালনায় হস্তক্ষেপ করিবে বইকি! এই ধরনের প্রশ্ন বা সংশয় শিক্ষামন্ত্রী নিশ্চয়ই ফুৎকারে উড়াইয়া দিবেন, উপাচার্যেরাও বোধ করি সেই ফুৎকারে দম লাগাইবেন, অন্তত প্রকাশ্যে। কিন্তু উড়াইয়া দিলেই যে সব সংশয় উড়িয়া যায়, তাহা বলা চলে না। উপাচার্যেরা বলিয়াছেন, তাঁহারা রাজ্য সরকারের সহিত ‘সিমলেস’ বা বাধাবন্ধহীন সম্পর্ক রাখিতে আগ্রহী। উৎকৃষ্ট আগ্রহ। তবে কিনা, আগে হইতেই ‘যথা নিযুক্তো(অ)স্মি তথা করোমি’ স্থির করিয়া রাখিলে ‘চাপ’ সৃষ্টি হইবার অবকাশই আর থাকে না। সংশয় অতএব রহিয়াই গেল।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy