অমলাকে আমাদের কাছে রেখে যান। আমরা যখন ফিরব, ও আমাদের সঙ্গে ফিরবে— এই বাক্যটিই যশোরের বাটাজোড় গ্রামের এক কিশোরীর জীবন অন্য খাতে বইয়ে দিল। অমলা নন্দী যে ভবিষ্যতে অমলাশঙ্কর হয়ে উঠবেন, তার সূচনাবিন্দু অজান্তেই উচ্চারিত হয়েছিল সে দিন।
১৯৩০ সালের কথা। প্যারিসে ‘ইন্টারন্যাশনাল কলোনিয়াল এক্সপোজ়িশন’ নামে বড় আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী হচ্ছে। কলকাতার অলঙ্কার-ব্যবসায়ী অক্ষয়কুমার নন্দী সেখানে ডাক পেয়েছেন। স্বদেশিভাবাপন্ন অক্ষয়কুমার আগেও বিদেশে গিয়েছেন, ভারতীয় অলঙ্কারশৈলীকে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছেন। ‘বিলাত ভ্রমণ’ নামে বইও বেরিয়েছে। প্যারিস যাবেন শুনে মেজ মেয়ে অমলার বায়না, সেও যাবে। ১১ বছরের মেয়েটি (জন্ম, ১৯১৯) খেয়ালবশতই বাবার সঙ্গে গেল প্যারিসে। প্যারিসই অমলাকে উদয়শঙ্করের সঙ্গে পরিচয় করাল, প্যারিসই অমলাকে নাচের নেশা ধরাল।
‘হিন্দু ডান্স’-এ উদয়শঙ্করের তখনই বিশ্বজোড়া নাম। তাঁর আর সিমকির (সিমোন বারবিয়ের) জুটি হইচই ফেলে দিয়েছে সর্বত্র। ইউরোপ ট্যুরে বেরিয়েছেন ওঁরা। প্যারিসের প্রদর্শনীতেও অনুষ্ঠান করার কথা আছে। এ দিকে ভারতীয় মেয়েদের নিয়ে সেখানে আর একটি অনুষ্ঠান করাচ্ছেন প্যারিসের নৃত্যশিল্পী নিয়তা-নিয়কা। সেই দলে অমলাও আছেন। উদয় আর ওঁর মা, দু’জনেই অক্ষয়কে অনুরোধ করলেন, অমলা আমাদের সঙ্গেও ট্যুরে চলুক! উদয়ের কাছে সেই প্রথম নাচের তালিম শুরু হল অমলার। ‘কালীয় দমন’ নৃত্যালেখ্যে তিনি কালীয়, কৃষ্ণ উদয়শঙ্কর। আট মাস পরে কলকাতায় ফিরে এই প্যারিসবাস এবং ইউরোপ ট্যুরের অভিজ্ঞতা ‘সাত সাগরের পারে’ বইয়ে লিখে রাখলেন কিশোরী অমলা। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুভাষচন্দ্র বসু, সকলেই খুব প্রশংসা করলেন সেই বইয়ের। সুভাষচন্দ্রই কয়েক বছর পরে আলমোড়ায় উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টারে অমলাকে পাঠানোর ব্যাপারে অক্ষয়কুমারকে রাজি করান।
সে বার প্যারিস, এ বার আলমোড়া। প্যারিসে অমলার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল নৃত্যের, পরিচয় হয়েছিল উদয়শঙ্করের। আলমোড়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক করে দিল, নাচই অমলার ভবিতব্য আর উদয়শঙ্কর তাঁর ভবিষ্যৎ। না, উদয়ের সঙ্গে বিয়ের সম্ভাবনা তখনও জানা ছিল না অমলার। কিন্তু নাচের পাশাপাশি সৃজনশীল চিন্তার ক্ষেত্রেও তিনি ক্রমশ উদয়শঙ্করের সঙ্গী হয়ে উঠছিলেন। যেমন শ্যাডো প্লে ‘রামলীলা’-র জন্য রামায়ণের কোন কোন অংশ বাছা হবে, সেটা অনেকটাই অমলা ঠিক করে দিয়েছিলেন। এই ভূমিকাটি তাঁকে নিতে হয়েছে বার বার। এক দিকে যেমন সিমকি-জ়োহরাকে ছাপিয়ে উদয়ের প্রধান জুটি হয়ে উঠছিলেন, তেমনই নান্দনিক ভাবনার দিক থেকেও উদয়ের সহধর্মিণী তিনিই। ‘কল্পনা’ ছবির জন্য প্রায় ৮০টি সিকোয়েন্স শুট করা হয়েছিল। অনেক কিছুই বাদ দিতে যাচ্ছিলেন উদয়শঙ্কর। ‘কার্ত্তিকেয়’-ও বাদ পড়ছিল। এ রকম বেশ কিছু অংশ ভবিষ্যৎ দর্শকের কথা ভেবে রেখে দিতে জোর করেন অমলাই। আলমোড়া সেন্টার বন্ধ হওয়ার পর কয়েকটা বছর চেন্নাইয়ে ছিলেন ওঁরা। সেখান থেকে বিধানচন্দ্র রায়ের ডাকে কলকাতায় ফেরা এবং ওয়েস্ট বেঙ্গল অ্যাকাডেমি অব ডান্স, ড্রামা অ্যান্ড মিউজ়িকের (ভবিষ্যতের রবীন্দ্রভারতী) দায়িত্ব নিতে রাজি করানোর পিছনেও অমলা। ‘লাইফ অব বুদ্ধ’ তৈরি হল অমলার আঁকা স্লাইড দিয়েই। ১৯৬১-তে রবীন্দ্র শতবর্ষ পালিত হবে। জওহরলাল নেহরু উদয়কে অনুরোধ করেছেন কিছু করার জন্য। অমলাই প্রস্তাব দিলেন, ‘সামান্য ক্ষতি’!
১৯৬৪-তে বিশেষ আমন্ত্রণে কলোরাডোতে মেয়েদের নাচের স্কুল দেখতে গেলেন। কলকাতায় ফিরে ‘উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া কালচারাল সেন্টার’ আরম্ভ করলেন তিনি। পণ করলেন, ‘‘যত দিন না এই প্রতিষ্ঠানের মেয়েদের নাচ দেখে অভিভূত হয়ে আমার চোখে জল আসবে, তত দিন মঞ্চে উঠব না।’’ এই সেন্টারই হয়ে উঠল অমলার সাধনা। উদয়শঙ্করের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েন, যাবতীয় ঝড়-ঝাপটা, কোনও কিছুই তাঁকে লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করেনি। যে নাচের মধ্য দিয়ে তাঁর আত্মপরিচয় গড়ে উঠেছিল, তার প্রতি নিবেদনে ফাঁক রাখেননি। আবার নিজের মধ্যেকার সেই গ্রামের মেয়েটিকে ভোলেননি। বলেছিলেন, ‘‘মেয়েরা কেমন করে কাঁখে কলসি নিয়ে জল ভরতে যায়, কেমন করে পুজোর নৈবেদ্য সাজায়, পুজো করে— এ সব প্রাত্যহিক চলাফেরাই এক দিন ‘নাচ’ হয়ে গেল কী ভাবে আজও জানি না।’’ ‘কল্পনা’ ছবির ‘ধিনাক নাতিন তিনা’ দেখলে, মিলিয়ে নিতে পারবেন কথাগুলো। সত্যজিৎ রায় ‘কল্পনা’ দেখে অমলাকে বলেছিলেন, ‘‘অভিনয় করেন না কেন?’’ অমলা খুশি হয়েছিলেন। কিন্তু নিজের কক্ষপথ ছাড়েননি।
অতি সঙ্কট-মুহূর্তে অক্ষয় নন্দী মেয়েকে সখেদে বলেছিলেন, ‘‘তুমি উদয়কে ভুলে যাও, উদয়শঙ্করকে মনে রাখো।’’ ‘শঙ্করনামা’ স্মৃতিচিত্রে অমলা বলেছেন, ‘‘এই উপদেশ আমাকে জীবনে অনেক জলঝড় সহ্য করতে সাহায্য করেছে।’’ ‘উদয়’-এর সঙ্গে দূরত্বের বাঁধও ভেঙেছিল অবশেষে। ১৯৭৭ সালে প্রয়াত হলেন উদয়শঙ্কর। হাসপাতালে শেষ দিনগুলো অমলা রইলেন পাশে। জমাট বাঁধা মেঘ কাটল অনেকটা। শোক সামলে সুসময়ের আনন্দ-স্মৃতিকে পাথেয় করেই অমলা আবার নিজেকে ডুবিয়ে দিলেন স্কুলের কাজে। মঞ্চেও উঠলেন। পরিবারের পাশাপাশি অগণিত ছাত্রছাত্রীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসা ঘিরে থাকল তাঁকে। শতবর্ষ পার করা জীবনের উপান্তে এসে, কয়েক দিন আগে পর্যন্ত যখনই স্কুলের মেয়েরা তাঁর ঘরে গিয়েছে, প্রায় আচ্ছন্ন অবস্থাতেও মৃদু স্বরে বলেছেন, ‘‘ওরা ক্লাসে এসেছে বুঝি? লাইন করে দাঁড়ায়নি তো!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy