Advertisement
১৯ নভেম্বর ২০২৪

ছদ্ম বেকারত্ব কৃষির উন্নতির অন্তরায়

কোনও উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে সেই শ্রমিককে সরিয়ে নিলেও উৎপাদনের পরিমাণ কমে না। ওই অতিরিক্ত শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা শূন্য। এই ছদ্ম বেকারত্বের সমাধানে কৃষিভিত্তিক শিল্প অন্যতম পথ। লিখছেন চন্দন বন্দ্যোপাধ্যায়ভারতের ৬০ শতাংশের বেশি নাগরিক কৃষির উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু দেশের মোট আয়ের ২০ শতাংশ কৃষি থেকে আসে। চাষযোগ্য জমির পরিমাণও অন্য দেশের তুলনায় কম।

কৃষির নানা কাজে মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। ফাইল ছবি

কৃষির নানা কাজে মহিলারা অংশগ্রহণ করেন। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:৫১
Share: Save:

ভারতের ৬০ শতাংশের বেশি নাগরিক কৃষির উপরে নির্ভরশীল। কিন্তু দেশের মোট আয়ের ২০ শতাংশ কৃষি থেকে আসে। চাষযোগ্য জমির পরিমাণও অন্য দেশের তুলনায় কম। ফলে চাষের জন্য যত লোক দরকার তার থেকে বেশি লোক কৃষি কাজে যুক্ত আছেন। অর্থাৎ, কৃষিতে উদ্বৃত্ত শ্রম আছে। একেই অর্থনীতির ভাষায় ‘ছদ্ম বেকারত্ব’ বা ‘disguised unemployment’ বলে।

অর্থনীতিবিদ জোয়ান রবিনসন প্রথম এই ধারণাটির কথা বলেছিলেন। যদিও তা উন্নত দেশের শিল্পক্ষেত্রের প্রেক্ষিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। পরে রোজেনস্টাইন-রোডান, আর্থার লুইস-এর মতো অর্থনীতিবিদেরা অনুন্নত দেশের কৃষিক্ষেত্রে ছদ্ম বেকারত্বের অস্তিত্ব ও তার প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ভারতের কৃষিক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত শ্রমের অস্তিত্বের কথা প্রথম আলোচনা করেন ভীমরাও অম্বেডকর। পরে ভিকেআরভি রাও, অমর্ত্য সেন ভারতের কৃষিক্ষেত্রে এই ছদ্ম বেকারত্ব নিয়ে আলোচনা করেছেন।

কোনও উৎপাদন ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শ্রমিক নিযুক্ত থাকলে সেই শ্রমিককে সরিয়ে নিলেও উৎপাদনের পরিমাণ কমে না। ওই অতিরিক্ত শ্রমিকের উৎপাদনশীলতা শূন্য। একটি উদাহরণের সাহায্যে এই ধারণাটি ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। ধরা যাক, পাঁচ জনের একটি পরিবারে ‘ক’ ব্যক্তি সরাসরি নিজের জমিতে চাষের কাজ করেন এবং বছরে বিঘা পিছু ১০,০০০ টাকা মূল্যের উৎপাদন করেন। ওই পরিবারের বড় ছেলেটি ১৭-১৮ বছর বয়স হলে, অন্য কোথাও কোন কাজ না পেলে বাবার সঙ্গে তাঁদের জমিতেই চাষের কাজে যুক্ত হয়। ছেলেটি চাষের কাজে যুক্ত হওয়ায় ‘ক’ ব্যক্তিটির কিছু সুবিধা হয়তো হল, কিন্তু উৎপাদনের পরিমাণ একই রয়ে গেল। এই ছেলেটিকে তখন অর্থনীতির ভাষায় ‘ছদ্ম বেকার’ বলা হবে। কারণ, সে নিজেকে বেকার বলে মনেই করে না, অথচ বাস্তবে সে উদ্বৃত্ত শ্রমিক। স্নাতক বা স্নাতকোত্তরে পড়াশোনা করছেন এমন গ্রামের ছেলেদের বলতে শুনেছি, পাশ করে চাকরি না পেলে চাষবাস করব। সেখানে তাঁর পরিবারের সদস্যেরা ইতিমধ্যেই চাষ করছেন। আবার বাড়ির মহিলা সদস্যেরা চাষে সহায়তা করেন। কিন্তু তাঁরা এর বিনিময়ে কোনও মজুরি পান। এই মহিলারাও ‘ছদ্ম বেকার’। ভারতে মোট শ্রমিকের ৪২% কৃষির সঙ্গে যুক্ত। মোট মহিলা শ্রমিকের ৫৬% কৃষির সঙ্গে যুক্ত, কিন্তু মোট পুরুষ শ্রমিকের ৩৮% কৃষির সঙ্গে যুক্ত। দেখা গিয়েছে, মহিলা কৃষি-শ্রমিকেরা পুরুষদের তুলনায় কম মজুরি পান।

ছদ্ম বেকারত্মের কারণ হিসেবে প্রথমেই বলা হয়, অত্যধিক জনসংখ্যার কথা। এই জনসংখ্যার বড় অংশই কর্মক্ষম। কিন্তু গ্রামে কাজের সুযোগ কম। শহরে অসংগঠিত শিল্পে কাজের কিছু সুযোগ থাকলেও শিক্ষার হার, কারিগরি শিক্ষার অভাব রয়েছে। ফলে বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। সে ভাবে শিল্পায়ন না হওয়ার ফলেও কৃষিক্ষেত্রে ও শহরে বিভিন্ন পরিষেবা ক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত শ্রমের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে।

এই ছদ্ম বেকারত্ব কৃষির উন্নয়নে অন্তরায়। আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বাড়লেও বর্ধিত জনসংখ্যা তার সুফল ভাগ করে নেওয়ায় অর্থনীতিতে তার প্রভাব সীমিত। এর থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী? এক কথায় কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। ভূমি সংস্কারের ফলে ছোট জোতের সংখ্যা বেড়েছে। এই ছোট ছোট জোতগুলি সমবায়ের আওতায় এনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে উৎপাদনের বৃদ্ধির চেষ্টা করা যেতে পারে। পাশাপাশি, কেবলমাত্র খাদ্যশস্য চাষ না করে, আনাজ, ফল ইত্যাদি চাষ করেও মাথাপিছু কৃষি উৎপাদন বাড়ানো যেতে পারে। গ্রামের উদ্বৃত্ত শ্রমিক শহরাঞ্চলে গিয়ে অসংগঠিত শিল্পে যোগ দিতে পারে। এতে গ্রামে ছদ্ম বেকারত্ব কমলেও এই ‘পরিযায়ী’ শ্রমিকেরা শহরে নানা সমস্যার সম্মুখীন হবেন। এর থেকে কারিগরি শিক্ষায় জোর দিলে গ্রামেই ছোট ছোট শিল্প গড়ে উঠতে পারে।

ছদ্ম বেকারত্বের সমস্যার সমাধানে কৃষিভিত্তিক শিল্প স্থাপন অন্যতম পথ বলে মনে করা হয়। এ ক্ষেত্রে, চাষির স্বার্থও সুরক্ষিত হবে। গ্রামীণ অর্থনীতিরও উন্নতি হবে। কৃষিতে বেসরকারি বিনিয়োগের দিকেও নজর দেওয়া যেতে পারে। যেমন, চুক্তি চাষের কথা ভাবা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বাম আমলে একটি বেসরকারি সংস্থার রিপোর্টের কথা বলা যেতে পারে। তারা জানিয়েছিল, এই প্রথায় চাষির জমির অধিকার সুরক্ষিত থাকবে। চাষির দায় থাকবে উৎপাদন করা পর্যন্ত। এর পর উৎপাদিত পণ্য মাঠ থেকে তোলা, মজুত করা, বাজারে বিক্রি করা এবং প্রয়োজনে কৃষিভিত্তিক শিল্পে উপকরণ হিসেবে ব্যবহারের দায়িত্বে থাকবে বেসরকারি সংস্থা। নির্বাচিত সংস্থা, যেমন পঞ্চায়েত, চাষিদের সঙ্গে বেসরকারি সংস্থার যোগসূত্রের কাজ করবে এবং চাষিদের স্বার্থ যাতে সুরক্ষিত থাকে সেটা দেখবে।

কৃষি এবং শিল্প একে অপরের পরিবর্ত নয়, পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। অর্থনীতিবিদদের মতে, কৃষির উদ্বৃত্ত শ্রমিক, শিল্পের শ্রমিক হিসেবে যোগ দিলে শিল্পের উন্নতির পক্ষে সহায়ক হয়। ছদ্ম বেকারত্ব সরে গেলে কৃষিক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় বাড়বে এবং গ্রামের অতিরিক্ত আয় শিল্পদ্রব্যের চাহিদা বাড়াবে। আবার শিল্পক্ষেত্রে শ্রমিকের আয় বাড়লে খাদ্যদ্রব্যের চাহিদাও বাড়বে। অর্থাৎ, কৃষি এবং শিল্প উভয়েরই উন্নয়ন হবে। ছদ্ম বেকারত্বে সমস্যা দূর হবে এবং সর্বোপরি গোটা অর্থনীতির উন্নয়নের হার বাড়বে।

কাজী নজরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy