Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
জুন ২০২১
Christiano ronaldo

নামভূমিকায়

নিজেকে তিলমাত্র রেয়াত না করার প্রাত্যহিক অভ্যাস, সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছেও নিজের শিকড়কে না ভোলা, সব মিলিয়ে খুব আলাদা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো

সুহাসিনী আলি
শেষ আপডেট: ২৭ জুন ২০২১ ০৪:২১
Share: Save:

শতেক টিভি ক্যামেরার সামনে, প্রেস কনফারেন্সে বসে তিনি সরিয়ে রাখলেন কোকা কোলার বোতল। আর, পরের দিনই ধস নামল কোকের শেয়ার দরে। বাজার বিশেষজ্ঞদের একাংশ বলছেন, নিতান্তই সমাপতন। কিন্তু, দুনিয়ার এক প্রান্তে প্রজাপতি পাখা নাড়লে যেখানে অন্য প্রান্তে সুনামি বয়ে যেতে পারে, সেখানে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ইঙ্গিতে কতখানি উথালপাথাল হয়, ফিন্যান্সের শুষ্ক হিসেব তার আন্দাজ পাবে কী করে?

তাঁর আন্দাজ পাওয়া অবশ্য সব সময়ই কঠিন। বড় মাঠে, অসীম চাপের মুখে ঝলসে ওঠাই হোক, পাঁচটা ব্যালন ডি’অর জেতাই হোক, পর্তুগালের হয়ে সর্বকালের সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়াই হোক— সবই তাঁর বাইরের রূপ। সেই গ্ল্যামারের বহিরঙ্গের ভিতরে সযত্নে লুকিয়ে রাখা আছে ইস্পাত— প্রতি দিনের হার না মানা জেদের আগুনে পুড়িয়ে, কঠোরতম পরিশ্রমের হাতুড়িতে পিটে যাকে আরও, আরও অপ্রতিরোধ্য করে তুলেছেন তিনি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কিংবদন্তি ম্যানেজার স্যর আলেক্স ফার্গুসন বলেছিলেন, তাঁর দলে যে ছ’বছর খেলেছিলেন রোনাল্ডো, এক দিনও ট্রেনিংয়ে কামাই করেননি। তাও তো সে অতীতের কথা, যখন মাঠের দখল নেওয়ার লড়াই শুরু করেছিলেন রোনাল্ডো। তার পর দশক পেরিয়েছে, পরিশ্রমের তীব্রতা কমেনি। অ্যাথলিটের ফিটনেসকে নিয়ে এসেছেন ফুটবলের মাঠে।

এমন আগ্রাসী খিদে কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলে অন্য একটা নাম আসবেই— লিয়োনেল মেসি। প্রতি মুহূর্তে তুলনা হয়েছে দু’জনের, আর প্রত্যেক বারই বিশেষজ্ঞরা রায় দিয়েছেন, আর্জেন্টিনার জাদুকর প্রতিভায় এগিয়ে রয়েছেন পর্তুগালের মহাতারকার চেয়ে। কথাটায় ক’আনা সত্যি আছে, সেই তর্কে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, কিন্তু রোনাল্ডো সেই শুরুর দিন থেকে বুঝে নিয়েছেন একটাই কথা— শেষ হিসেবে প্রতিভাকেও পাঁচ গোল দিতে পারে পরিশ্রম, কঠোর পরিশ্রম। নিজেকে এক দিনও রেয়াত না করার অসহ নিষ্ঠুরতা। পরিসংখ্যান বলছে, রোনাল্ডো ভুল করেননি। ক্লাব অথবা দেশ, যখন যে দলের হয়ে খেলেছেন, উজাড় করে দিয়েছেন নিজেকে। জুভেন্টাস, রিয়াল মাদ্রিদ বা ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, যখন যে দলের হয়ে মাঠে নেমেছেন, ট্রফি আনতে ব্যর্থ হননি রোনাল্ডো। দেশের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছেন। সাফল্যের চেয়ে বড় বিজ্ঞাপন আর কিছু হতে পারে না, এই প্রতি দিন এই কথাটার সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে মাঠে নামেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো ডস সান্টোস আভেইরো।

অপরিমিত মদ্যপানের ফলে লিভার বিগড়ে বাবা যখন মারা গেলেন, রোনাল্ডোর বয়স তখন মাত্র কুড়ি বছর। জীবনে কখনও মদ স্পর্শ করেননি তিনি। ২০০৮ সালে এক সংবাদপত্র লিখেছিল, রোনাল্ডোকে নাকি প্রচুর মদ্যপান করতে দেখা গিয়েছে। সটান মানহানির মামলা ঠুকেছিলেন। জিতেছিলেনও বটে— তাঁর মদ্যপানের কোনও প্রমাণ পেশ করা যায়নি। শরীরে কোনও ট্যাটু করাননি তিনি, কারণ নিয়মিত রক্তদান করেন। চার সন্তানের পিতা, প্রথম সন্তানের মায়ের নাম গোপন রেখেছিলেন তাঁর সঙ্গে এক চুক্তির কারণে। ২০০৭ সালে তাঁর মা আক্রান্ত হয়েছিলেন ক্যানসারে। যে হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে সুস্থ হন রোনাল্ডোর মা, সেখানে উন্নততর ক্যানসার রিসার্চ কেন্দ্র গড়ে তোলার জন্য দান করলেন এক লক্ষ পাউন্ড। পর্তুগালের মাদেরা দ্বীপে জন্ম তাঁর— যখন যে ভাবে পেরেছেন, অর্থসাহায্য করেছেন সেই দ্বীপের উন্নয়নে।

অবশ্য, শুধু জন্মভিটের জন্য নয়, মায়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের জন্য নয়, গোটা দুনিয়ার জন্য রোনাল্ডো হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বারে বারেই। ২০১৫ সালে নেপালের বিধ্বংসী ভূমিকম্পের পর দিয়েছিলেন পঞ্চাশ লক্ষ ইউরো। তার পরের বছর, রিয়াল মাদ্রিদ চ্যাম্পিয়নস লিগে জয়ী হওয়ার পর ছ’লক্ষ ইউরো বোনাস পেয়েছিলেন। সেই টাকাও পুরোটাই দান করে দিয়েছিলেন। তারও বহু আগে, ২০০৪ সালে এশিয়ার সুনামির পর একটা ছবি প্রকাশিত হয়েছিল— পরিবারের সবাই মারা গিয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার এক আট বছর বয়সি বালক এমন অবস্থায় আটকে ছিল ১৯ দিন। তার পরনে ছিল একটা পর্তুগালের জার্সি। সেই সূত্র ধরেই রোনাল্ডো জুড়ে গিয়েছিলেন ইন্দোনেশিয়ার ত্রাণ আর পুনর্গঠনে। তালিকা দীর্ঘতর করে চলা যায়— কিন্তু, আপাতত এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, আধুনিক ক্রীড়াবিশ্বে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর চেয়ে বেশি দান করেন না আর কেউ।

শুরুতে বলেছিলাম, তাঁর ভিতরটা নিখাদ ইস্পাত। কথাটা অসম্পূর্ণ ছিল। করুণাধারার প্রবাহকে অপ্রতিহত রাখতে হলে যে ইস্পাতের বর্ম ধারণ করতেই হয়, এই কথাটা না বললে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে সম্পূর্ণ চেনা যায় না। তিনি মাঠে নামার আগেও ফুটবল ছিল, তিনি বুটজোড়া পাকাপাকি ভাবে তুলে রাখার পরও ফুটবল থাকবে। কিন্তু, খেলার ইতিহাসের একটা অধ্যায় বরাদ্দ থাকবে শুধুমাত্র তাঁরই জন্য— এমন এক জন খেলোয়াড় হিসেবে, যিনি প্রতি দিন নিজের সেরাটা নিংড়ে দিয়ে এসেছেন মাঠে, এবং প্র্যাকটিসের গ্ল্যামারহীন প্রাত্যহিকতায়। এই কারণেই যে, এই সাফল্য তাঁকে আরও বেশি করে মানুষের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ করে দেবে।

অন্য বিষয়গুলি:

Christiano ronaldo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE