Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ২

সংরক্ষিত কামরায় জনমজুরের রেলযাত্রা চলবে আর কত দিন

ব ন্ধু অবিনাশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে দক্ষিণের রাজ্যে চিকিৎসা করিয়ে ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় ফেরার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। বার্থ দখল-করা যাত্রীদের দৌরাত্ম্যে অসুস্থ পিসিমা লোয়ার বার্থের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসেছিলেন সারা দিন।

ঝর্ণা পাণ্ডা
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০১৭ ১৩:১৫
Share: Save:

ব ন্ধু অবিনাশ পশ্চিমবঙ্গ থেকে দক্ষিণের রাজ্যে চিকিৎসা করিয়ে ট্রেনের সংরক্ষিত কামরায় ফেরার অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন। বার্থ দখল-করা যাত্রীদের দৌরাত্ম্যে অসুস্থ পিসিমা লোয়ার বার্থের এক কোণে জড়সড় হয়ে বসেছিলেন সারা দিন। শোয়ার উপায় ছিল না। কামরার ফাঁকা জায়গা থেকে শুরু করে বাথরুম পর্যন্ত বহিরাগতদের ভিড়। রাত দশটায় সিআরপিএফ-কে ডেকে আনায় একটু জায়গা মেলে। রিজার্ভ বার্থ জবরদখল-করা যাত্রীরা প্রায় সবাই ভিন রাজ্যে কাজ থেকে ফিরছেন। পরিযায়ী শ্রমিক।

বছর চল্লিশ আগে বড়দের মুখে শুনতাম, বছরের একটা সময়ে গাঁ-গঞ্জ থেকে সবাই পুব খাটতে যান। তাই সে সময় নাকি বাসে ওঠা যায় না। এখনকার মতো তখনও পুরুলিয়া-বাঁকুড়া থেকে দলে দলে মানুষ বর্ধমান পুব খাটতে আসতেন। অনভ্যস্ত যাত্রার গাদাগাদি ভিড়ে চিৎকার, গালাগাল, বাসের ভেতর বমি করে ফেলা, এ সবের জন্য অন্যরা ওই যাত্রীদের হীন চোখে দেখতেন। ২০০৯ সালে এমন ‘পুব খাটা’ শ্রমিকদের সঙ্গে তিনসুকিয়া থেকে তিরুঅনন্তপুরম-গামী ট্রেনে আড়াই ঘণ্টা সফর করেছি। সে স্মৃতি ভোলার নয়। কোনও উপায়ে দরজার ফাঁকে আড়াআড়ি ভাবে আমি ও সঙ্গী জয় নিজেদের শরীর গুঁজে দিয়েছি। ভিতরের কয়েক জন উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের দাঁড়ানোর জায়গা করে গিয়েছিলেন। কিন্তু দাঁড়াতে পারছি কই, মাথায় কী যেন ঠেকছে। তাকিয়ে দেখি, দুটো দরজার মাঝের ছাদ বরাবর অংশে চাদর টাঙিয়ে তাতেও লোকজন বসে আছেন! বিস্মিত হতে দেখে ওঁরা বললেন পুরো কামরা জুড়ে এ ভাবেই চাদর টাঙিয়ে যাত্রীরা বসে আছেন। এমনকী বাথরুমের ভিতরেও গাদাগাদি ভিড়। দরজার পাশের বেসিনের ওপর থেকে ছাদ পর্যন্ত থরে থরে সাজানো যাত্রীদের ব্যাগগুলি দড়ি দিয়ে বাঁধা।

এ ভাবেই এঁরা সবাই ঠিকাদারের অধীনে কাজ করতে কেরল যাচ্ছেন। লোক ওঠার ভয়ে এঁরা কোনও স্টেশনে দরজা খোলেন না। খুব দরকার হলে ট্রেনের জানালা দিয়ে জল ও টুকটাক খাবার সংগ্রহ করেন। এমন করে চলে এঁদের আড়াই দিনের ট্রেন সফর। আলাপ হওয়ার কিছু ক্ষণ পর হঠাৎ ঠেলাঠেলি। আমাদের চিঁড়েচ্যাপটা অবস্থা দেখে ওঁরা নির্বিকার মুখে আশ্বাস দিলেন, ‘দিদি ভয় পাবেন না, এক জন বাথরুমে যাবেন, ফাঁকা করতে হবে, তাই ভিতর থেকে লোক বেরিয়ে আসছে। আবার ঠিক হয়ে যাবে।’ এমন নির্মম সত্যির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যা মনে হয় তা ভয় না কি অন্য কিছু, তা প্রকাশ করার সাধ্যি নেই।

এক মধ্যবয়স্ক ভদ্রলোক সংসারের গল্প দেখা বলছিলেন। তিরিশ বছরের ভাই বছরখানেক আগে আত্মহত্যা করেছেন। ভাইয়ের স্ত্রী-সন্তান সহ পরিবারের নয় জনের অন্নসংস্থানের খোঁজে কেরল যাচ্ছেন। কেউ চাষে মার খেয়েছেন। কেউ ব্যবসার মূলধন সংগ্রহ করার আশায় চলেছেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এক বাবা মেয়ের বিয়ের টাকা জোগাড় করতে যাচ্ছেন। এক যুবক বাইক কেনার সাধ মেটাতে চলেছে। এক জন বলল, ‘দিদি দেখেছেন ব্যবসায়ীরা লরিতে করে গরু-ছাগল নিয়ে যায়। আমরা গরুছাগলের মতো করেই যাচ্ছি। শুধু সৎপথে রোজগার করব বলে। তবু কিছু ঘটলে আমাদেরই সবার আগে চোর সন্দেহ করে সবাই।’

কতটা ঝুঁকির এই বিদেশযাত্রা, তা-ও দেখেছি। ঠিকাদারের হাত ধরে গ্রামকে গ্রাম উজাড় হয়ে পুরুষরা যায় দিল্লি, মুম্বই, তামিলনাডুতে। পরিবারের সকলে শুধু শহরের নামটা জানেন। কত বড় শহর, কল্পনাও করতে পারেন না। মুর্শিদাবাদের সামসেরগঞ্জে দেখা হয়েছিল রুমাদেবীর সঙ্গে। এক দিন সকালে প্রতিবেশীর কাছে খবর পান তাঁর স্বামী হারিয়ে গিয়েছেন। অন্য শ্রমিকদের শত অনুরোধেও লাইসেন্সহীন ঠিকাদার (তার বেআইনি ব্যবসা ধরা পড়ার ভয়ে) দিল্লির কোনও থানাতে ডায়রি করেনি। রুমাদেবী থানা, পঞ্চায়েত, নেতার কাছে যান, দেবস্থানে হত্যে দেন। মাস তিনেক পর তাঁর স্বামী গ্রামে ফিরে আসতে জানা গেল, ভোর রাতে প্রাতঃকৃত্য সারতে গেলে দিল্লি পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। তিনি ঠিকাদারের নাম ছাড়া পুলিশকে আর কোনও তথ্য দিতে পারেননি। তাঁর জেল হয়ে যায়।

এক প্রজন্ম যখন ট্রেনের সংরক্ষিত বা অসংরক্ষিত কামরায় ভিড় করে, তখন বাঁচার লড়াইয়ে তাদের জায়গা নেয় পরের প্রজন্ম। ছোট ছোট হাতে বিড়ি বাঁধে, মাথায় করে ইট বয়। স্কুলের খাতায় নাম থাকলেও ক্লাসে তাদের উপস্থিতি তেমন চোখে পড়ে না। প্রাইমারি স্কুলের নবীন শিক্ষক সগর্বে বলেন ‘না এলে সারা দিন কী ভাবে কাটবে, তাই আমরা ক’জন স্কুলে আসি। অনেকে তো আসেই না।’ এ ভাবেই শিক্ষাঙ্গন থেকে দাতা ও গ্রহীতা উভয়েই দূরে থাকে। এ ভাবেই ফের ট্রেনের বিনা রিজার্ভেশনের যাত্রী তৈরি হয়।

অন্য বিষয়গুলি:

train journey Reservation seats
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE