ছবি: সংগৃহীত
রাস্তায় পা বাড়াতে গেলেও দু’বার ভাবতে হচ্ছে, বেরোলে নির্বিঘ্নে পরিবার নিয়ে ফেরা যাবে কি না! দীর্ঘদিনের শান্তিতে থাকার অভ্যাস আশঙ্কাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। কলকাতা থেকে কোচবিহার একই চিত্র। অথচ, যাঁরা এই চিত্রনাট্য লিখছেন, তাঁরা মানুষের অসুবিধার কথা একবারও চিন্তা করছেন না।
হাওড়া স্টেশন, শিয়ালদহ স্টেশনে পা রাখার জায়গা নেই। বিভিন্ন জায়গার ট্রেন বাতিল হওয়ায় পরিবার-পরিজন নিয়ে সঙ্কটে পড়েছেন অসংখ্য মানুষ। তাঁরা নিশ্চিন্ত আশ্রয় থেকে অনেক দূরে রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মে বসে। চোখে আশঙ্কা। বালুরঘাট থেকে এক বাবা রওনা হয়েছিলেন ওড়িশার উদ্দেশে। মেয়ে সেখানকার কলেজে পড়ে। ফোন করে মেয়ে জানিয়েছিলেন, তিনি অসুস্থ। বাবা তৎকালে টিকিট কেটে ভোরের ট্রেনে রওনা হন। কিন্তু কলকাতায় পৌঁছেও ওড়িশায় যাওয়া হল না ট্রেন বাতিল বলে। অসুস্থ মেয়েকে না দেখেই এ বাস ও বাস ধরে ফিরে আসতে হল বালুরঘাটে।
কলকাতা থেকে অনাথ অাশ্রমের জনা পঁচিশেক মেয়েকে নিয়ে এক শিক্ষিকার ফেরার কথা ছিল রাধিকাপুর এক্সপ্রেসে রায়গঞ্জে। ট্রেন বাতিল হওয়ায় তিনিও পড়লেন অথৈ জলে। এতগুলো মেয়ের সুরক্ষার বিষয় নিয়ে আতঙ্ক তাঁর সীমা ছাড়াল। অগত্যা গৌড় এক্সপ্রেসের জেনারেল কামরায় উঠলেন। কিন্তু সেই ট্রেনও মালদহ পর্যন্ত এসে বাতিল হল।
বিয়েবাড়ির একদল মানুষ রাস্তায় বেরিয়েও যথাসময়ে পৌঁছতে পারলেন না। রোগীর অপারেশনের ডেট হয়ে গিয়েছে। বাইপাস সার্জারি হবে বেঙ্গালুরুতে। মালদহ স্টেশনে বসে রোগী নিয়ে হা-হুতাশ করা ছাড়া তাঁর আর উপায় রিল না।
এই ধরনের নানা ছবি, নানান ঘটনা ঘটে চলেছে টানা কয়েকদিন ধরে। উত্তরবঙ্গের সঙ্গে দক্ষিণবঙ্গের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ক’দিন। এখনও যে সে যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়েছে, তা নয়। চার দিকে অশান্তির পরিবেশ। অবিশ্বাসের কলুষ বাতাস। এ কোন রাজ্য! এ কোন দেশ! চেনা যাচ্ছে না!
দেশ জ্বলছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের আগুনে। কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে। মানুষ দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সমস্যাগুলোর সমাধান চাইতে ভুলে যাচ্ছেন রাষ্ট্রীয় হুজুগে। বেকারত্ব, লাভজনক সংস্থার বেসরকারিকরণ, মূল্যবৃদ্ধি, শিক্ষা-স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রত্যাশা বারবার ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে তৈরি করা সমস্যার আড়ালে।
এত বৃহত্তর অব্যবস্থা দেশ বহু দিন প্রত্যক্ষ করেনি। ট্রেন জ্বলছে, স্টেশনে স্টেশনে ভাঙচুর, থানা পুড়ছে। শিক্ষকদের আন্দোলনে জলকামান ছোড়া হয়। কিন্তু এই অরাজকতার আগুনের বিরুদ্ধে কোথাও কোনও জলকামান দেখা যাচ্ছে না। নিরীহ সাধারণ মানুষের সামনে প্রতিবাদের নামে চলছে সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস। চলছে দায় চাপানোর চাপানউতোর।
মানুষকে বোঝা আর বোঝানোর মতো রাজনৈতিক শক্তির বড়ই অভাব দেখা যাচ্ছে। বিভ্রান্ত করার শক্তির অভাব নেই। আর এই সময়কালে মানুষের বোধ হারিয়ে যাচ্ছে, রুচি বদলে যাচ্ছে। মানুষের ভাষা বদলে যেতে শুরু করেছে। এতদিন যারা বলতেন ‘আমাদের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভাইবোনেরা’, আজ তাঁরাই বলছেন ‘ওই কমিউনিটির লোকজন’। দুরত্ব বাড়ছে মানুষে মানুষে। বাংলার জনগণ ভাগ হয়ে যাচ্ছেন হিন্দু-মুসলিমে। এই অশান্ত সমাজ বহুদিন দেখেনি মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শান্তিপ্রিয় বাঙালি। পরষ্পরকে বোঝার ইচ্ছে ও ক্ষমতাটা কোথায় যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। সমরেশ বসুর ‘আদাব’ গল্পের সেই পটভূমি হঠাৎ কী ভাবে চলে এলো বাংলায়! গোটা দেশে! ডাস্টবিনের আড়ালে দাঁড়িয়েও পরষ্পরকে অবিশ্বাস!
বাঙালির একটাই জাতিসত্তা। তা কখনই সম্প্রদায়ে দ্বিধাবিভক্ত নয়। এটা ভারত। এখানে তৃষ্ণার্ত হিন্দুর হাতে জল তুলে দেন মুসলমান। মুসলমানের বুকে ক্ষত হলে হিন্দু কষ্ট পান। বহুদিনের প্রতিবেশীকে এক কথায় ছেড়ে দিতে বললেই দেওয়া যায়? পাশাপাশি থাকতে থাকতে একে অপরের উপর যে নির্ভরশীলতা জন্মে গিয়েছে, তাকে অস্বীকার করা যায়? এতই সহজ বিশ্বাস ভেঙে দেওয়া মানুষের প্রতি মানুষের?
নাগরিক প্রতিবাদ স্বাভাবিক। কারণ, নাগরিকের মনে আশঙ্কা ঘনীভূত হয়েছে। কিন্তু সেই প্রতিবাদ যাতে অন্যের আশঙ্কার কারণ না হয়ে ওঠে, সে দিকে লক্ষ রাখতেই হবে। একজনের উন্মত্ততা আরেকজনকে শুধু দুঃখই দেয় না, গোটা জাতিসত্তাকে অপমান করে। প্ররোচিত হলে আখেরে নিজেদেরই ক্ষতি। স্নিগ্ধ-শান্ত জনপদ আবারও হয়ে উঠবে অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তপলাশি?
দেশের প্রতি, দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা থাকলে অশান্তির হাত ধরলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, আমার প্রতিবাদে একজনও যদি লাঞ্ছিত, বিরক্ত, আহত কিংবা আশঙ্কিত হন, তা হলে সবার আগে সমর্থন হারাব তাঁরই। পারষ্পরিক সহযোগিতা ও সমর্থনের ভীত আলগা হলে দুর্বল হবে বাংলা, দুর্বল হবে বাঙালি, দুর্বল হয়ে পড়লে গোটা দেশের ভিত্তি।
(লেখক দক্ষিণ দিনাজপুরের মহাদেববাটী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy