প্রশ্ন: এত হুমকি, আপনার লেখায় প্রভাব পড়ে?
অরুন্ধতী রায়: হুমকি সব সময় থাকে। এখন লেখককে প্রতিটি শব্দ লেখার আগে বার বার ভাবতে হচ্ছে। বাক্স্বাধীনতা নেই। এতে সংস্কৃতির ক্ষতি হচ্ছে, মুক্ত চিন্তা থমকে যাচ্ছে। লেখক হিসেবে আমাদের কাজ প্রশ্ন করে তাতিয়ে তোলা, যে কোনও বিষয় নিয়ে কাটাছেঁড়া করা। অথচ, সব কিছু পিছন দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানীই হোন বা অন্য পেশার মানুষ, বোকার মতো কথা বলছেন।
প্র: ‘আজাদি’ লেখা পোস্টার হাতে দাঁড়ানোয় একটি মেয়ের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হয়েছে। নেতারা তো যা খুশি বলে পার পেয়ে যাচ্ছেন।
উ: কেউ বলছেন, প্রতিবাদীদের গুলি করে মারতে। কেউ বলছেন, পোশাক দেখে চেনা যায়। কেউ বলছেন, পাকিস্তানে চলে যাও। উত্তরপ্রদেশে প্রতিবাদ হচ্ছিল, মুখ্যমন্ত্রী বললেন, প্রতিশোধ নেওয়া হবে। লোকের থেকে পয়সা উসুল করা হবে। হচ্ছেও। যুদ্ধক্ষেত্রের থেকেও খারাপ পরিস্থিতি। ডাক্তার চিকিৎসা করতে চাইছেন না। বুলেটবিদ্ধ মানুষ চিকিৎসা পাচ্ছে না। মানুষ পুলিশের হাতে মার খেয়েও হাসপাতালে যাচ্ছে না। ভয়, চিকিৎসা পাবে কি না, তার উপরে যদি দেশদ্রোহিতার চার্জ দেওয়া হয়! যেখানে বিজেপির শাসন, সেখানে গুজরাত তৈরি করতে চাওয়া হচ্ছে। তখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন মোদী, প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী। এখন উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কৌশলটা এ রকম: এক জন আক্রমণাত্মক হয়ে বলবেন, অন্য জন চুপ। এখনও সেটাই হচ্ছে। এই মুহূর্তে একটা লেখার মধ্যে রয়েছি। লেখার সময় একটা অন্য রকম হয়। দেখতে পাই, একটা একটা করে জানালা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মাথার মধ্যে একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে— জানালা খোলো! যে ভাবেই হোক।
প্র: গৌরী লঙ্কেশের ঘটনার পর প্রকাশ্যে কথা বলার আগে কয়েক বার ভাবতে হয়?
উ: এই দেশ আমার, আমাদের মতো সাধারণ মানুষের। কোনও নেতার নয়। আমাকে নিয়ে সমালোচনা করলে অসুবিধা নেই। অসুবিধা অন্য জায়গায়। যেমন, দিল্লিতে আমার বইপ্রকাশ অনুষ্ঠান ছিল। জানতাম হামলা হবে, মঞ্চ ভেঙে দেওয়া হবে। অথচ, এই নেতারাই টিকিট পেয়ে ভোটে লড়তে যান। বস্তার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি— মানুষ ত্রস্ত। তার পরও মানুষ এগিয়ে আসছেন, প্রতিবাদ করছেন, সেটা বড় ব্যাপার।
প্র: দেশ জুড়েই মোদী-বিরোধিতা, কিন্তু বিজেপি তো জনগণের ভোটে জিতেই ক্ষমতায় এসেছে!
উ: ভোটে জেতা দিয়ে সব কিছুর বিচার হয় না। আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় বড় গলদ রয়েছে। অম্বেডকরের ‘পুণে অ্যাক্ট’-এর নীতিকে খারিজ করা হয়েছিল সংখ্যালঘুদের দমিয়ে রাখতে। নয়তো নির্বাচন জেতা কঠিন হত। সেই সময়েও কিন্তু সরকার সকলের মনের মতো ছিল না। আজকের প্রতিবাদ শুধু এনআরসি, সিএএ-র বিরোধিতায় নয়। অর্থনৈতিক মন্দা, উচ্চশিক্ষার অবনতি, বেসরকারিকরণ— পরিস্থিতি ভয়াবহ। নির্বাচন তো ঢের দেরি। তত দিনে দেশের অবস্থা এতটাই বিগড়ে যাবে যে আর আগের অবস্থায় ফেরানো যাবে না।
প্র: আপনি জেএনইউ-এ বলেছেন এনপিআর-এর ক্ষেত্রে ভুল তথ্য দিতে।
উ: এনপিআর কিন্তু আদতে এনআরসি-র ডেটাবেস। আমি বলেছিলাম, ঘরে ঘরে এসে প্রশ্ন করলে কী করা উচিত। সবাই বলছে বয়কট করতে, আমি হাসির ছলে বলেছি: যে কোনও নাম দিয়ে দাও।
প্র: রাজনীতিতে আসার কথা ভেবেছেন?
উ: একেবারেই না। লেখকের ভূমিকাটা উল্টো বলেই আমার মনে হয়। মনে হয়, অপ্রিয় কথাগুলো কে বলবে? কেউ বড় সিনেমা বানালে তাঁকে চুপ থাকতে হয়, কারণ তিনি ব্যবসা করে খাচ্ছেন। বলিউডের বেশির ভাগ মানুষ তাই চুপ। এমন লেখকও আছেন। কিন্তু আমি নিজের কাজটা ভুলতে পারি না। অনেকে মনের মধ্যে সেন্সরশিপ তৈরি করে বসে আছেন। ক্ষমতাতোষণের বাইরে বেরিয়ে কথা বলার সাহস নেই। এটা বিপজ্জনক প্রবণতা।
প্র: আপনার লেখায় সমকালীন রাজনীতির বয়ান কী ভাবে তৈরি হয়?
উ: ফিকশন আমায় রাজনীতি শিখিয়েছে। গড অব স্মল থিংস-এর চরিত্র রাজনীতি বুঝতে শিখিয়েছে লেখার ধাপে ধাপে। আবার দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমোস্ট হ্যাপিনেস লিখছি যখন, তখনও ভাবিনি, এই পরিস্থিতির মধ্যে দিয়েই যেতে হবে! কখনও কখনও ভয় লাগে, যা আমি আগে লিখেছি, এখন হুবহু ঘটছে। কাশ্মীরে গিয়ে দেখি, সব ব্যবসা শেষ হতে বসেছে। রিসার্চ স্কলার কাজ করতে পারছেন না। পর্যটন বসে গিয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ। প্রশাসন বলে কিছু নেই। মনে হচ্ছিল, এই সরকার যদি কাশ্মীরে এনআরসি চায়, কী হতে পারে। ওখানকার মানুষ তো বলবেন, নাগরিকত্ব চাই না! তখন?
প্র: জেএনইউ নিয়ে বিজেপির এত অসন্তোষ কেন?
উ: জেএনইউ-এর পড়ুয়াদের ‘বামপন্থী’ দাগিয়ে দেওয়া হয়। সমস্যাটা ‘বাম’ নিয়ে নয়। সমস্যা হল, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক দলিত পড়ুয়া শিক্ষিত হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছেন। ফলে ব্রাহ্মণ্যবাদ ভয় পাচ্ছে। বার বার ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে তাক করার মূল কারণ জাতপাত। শিক্ষাকে বেসরকারিকরণের অর্থ, আমার মতে, শিক্ষাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী করে তোলা। অন্য দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলছেন, মোদী আর শাহিন বাগের মধ্যে একটা বেছে নিতে। মন্ত্রী প্রকাশ্যে বলছেন, ‘গোলি মারো শালোঁ কো!’ তাই যারা প্রতিবাদীদের গুলি ছুড়ছে, তারা ভাবছে সরকার এটাই চাইছে। তবে এই ভাবে প্রতিবাদ থামানো যায় না। মানুষ প্রতিরোধ তৈরি করে অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্নে।
সাক্ষাৎকার: চৈতালি বিশ্বাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy