সম্প্রতি দু’টি কারণে বাংলাদেশ শিরোনামে। প্রথমত, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির দ্রুততার মাপকাঠিতে পৃথিবীর প্রথম সারিতে উঠে এসেছে দেশটি। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের বৃহত্তম একক শরণার্থী গোষ্ঠী এ দেশেই আশ্রয় পেয়েছে। রোহিঙ্গাদের শেষ দলটি বাংলাদেশে আসার দু’বছর পূর্ণ হয়েছে ২০১৯-এর অগস্টে। তাঁদের সংখ্যা এখন দশ লক্ষেরও বেশি।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্য অনেককেই অবাক করেছে। কিন্তু অভিভূত করেছে ভিটেহারাদের প্রতি দেশটির মানবিক মনোভাব। তা আন্তর্জাতিক পরিসরে প্রশংসা ও শ্রদ্ধা আদায় করেছে। দেশটি নিজেই জনস্ফীতিতে হাঁসফাঁস করছে। তার পরেও এত কম সময়ে, এমন বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে উদার ভাবে স্থান দিয়েছে! এমনটা কমই দেখা যায়!
তবে, যে পর্যায়ের নিপীড়নের শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা তাঁদের নিজভূমি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের বোধ হয় তাঁদের ঠাঁই দেওয়া ছাড়া উপায়ও ছিল না। সভ্য জাতিমাত্রের তা-ই তো করা উচিত। এক সময় ভারতও এই রকম পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকে এক কোটিরও বেশি শরণার্থী ভারতে এসেছিলেন। একক বাস্তুহারা গোষ্ঠীর ইতিহাসে, সেটিই সর্বকালের সর্বোচ্চ সংখ্যা। তাই, এমন দু’টি উদাহরণের পর, গোটা বঙ্গভূমি এই মানবদরদি ঐতিহ্য নিয়ে শ্লাঘা বোধ করতেই পারে।
যা-ই হোক, দু’টি অবস্থিতি আলাদা। ভারতের বেলায়, বেশির ভাগ বাংলাদেশি শরণার্থী এক বছরের মধ্যেই বাড়ি ফিরতে পেরেছিলেন। ভালই হয়েছিল। বর্তমানে নাগরিক পঞ্জি নিয়ে ভারতে যে ঝড় বইছে, তাঁরা সে দিন না ফিরলে আজ যে কী হত বুঝে নিতে কষ্ট হয় না। এখন বাংলাদেশের আকাশেও প্রায় সমগোত্রীয় মেঘ ঘনাচ্ছে। দু’-দু’টি বছর অতিক্রান্ত। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ ছেড়ে নিজ দেশে ফিরতে চাইছেন না। অদূর ভবিষ্যতে যে চাইবেন, তারও চিহ্ন দেখা যায় না। এ দিকে বাংলাদেশ ও মায়ানমারের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী দু’টি তারিখে রোহিঙ্গাদের এই স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন শুরুর কথা ছিল। ১৫ নভেম্বর ২০১৮ এবং ২২ অগস্ট ২০১৯। দিনগুলি এসে চলে গেল। এক জন বাস্তুহারাও ফেরেননি। রোহিঙ্গাদের নেতৃত্ব ঘোষণা করেছেন, ফেরার আনুষঙ্গিক শর্তগুলি পূরণের ক্ষেত্রটি প্রস্তুত না হলে এক জনও ফিরবেন না। ফলত, বহু বাংলাদেশিই চটেছেন। কিন্তু, ভিটেহীনরা কি কোনও অন্যায্য কথা বলেছেন? ১৯৭১-এ যদি বাংলাদেশ তৈরি না হত, তবে কি পূর্ব পাকিস্তানের ছিন্নমূলরা ভারত ছাড়তেন? রোহিঙ্গারা তো নিজেদের আলাদা দেশ চাইছেন না। তাঁরা শুধু কয়েকটি আশ্বাসের অপেক্ষায়। যে ভূমে তাঁদের পূর্বপুরুষরা শত শত বছর ধরে বাস করেছেন, সেখানে মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার চান তাঁরা। ভরসা চাইছেন যাতে সেখানে তাঁদের বহিরাগতের তকমা দেওয়া না হয়; নির্যাতন বা উৎখাতের ভয় না থাকে; নাগরিকত্বের দাবি গুরুত্ব সহকারে বিবেচিত হয়; জমি চাষের অধিকার দেওয়া হয়; নিজের এলাকা ও আশপাশে নিরুপদ্রবে ঘোরাফেরা করতে পারেন; সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন বৌদ্ধদের আক্রমণ ও অত্যাচার থেকে সুরক্ষার নিশ্চয়তা থাকে; অন্য বাসিন্দাদের মতোই শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকারটুকু মেলে। এর মধ্যে কোন দাবিটি অযৌক্তিক? পৃথিবীর অন্য কোথাও, কোনও অন্য গোষ্ঠী কি এই প্রাথমিক সুযোগসুবিধাগুলি ছাড়া বাঁচতে পারে?
মায়ানমার সরকার যে ‘রাখাইন অ্যাডভাইজ়রি কমিটি’ তৈরি করেছিল (আরএসি), তার শীর্ষে ছিলেন রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রাক্তন মহাসচিব কোফি আন্নান। সেই কমিটি জানিয়েছিল, এই শর্তগুলি পূরণ হয় না বলেই রোহিঙ্গাদের এত যন্ত্রণা। তাঁরা কিছু প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। সেগুলিকে এই সমস্যা সমাধানের নীল নকশা বলা যেতে পারে। সে সব পরিকল্পনা রূপায়ণে প্রকাশ্যেই সম্মত হয়েছিল মায়ানমার সরকার।
তা হলে সেই সব শর্ত কাজে পরিণত হল না কেন? কারণ একাধিক। ইতিহাস বলছে, বেশ কয়েক শতাব্দী আগে থেকেই মায়ানমারের রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বাস। এই প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রাখাইন বৌদ্ধ। দুই জনগোষ্ঠীর বনে না। আবার বাকি দেশের বর্মি জনতাও রোহিঙ্গাদের কখনওই আপন ভাবতে পারেনি। তাঁরা কিছুতেই ভুলতে পারেন না, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান যখন মায়ানমারের দখল নিয়েছিল, তখন রোহিঙ্গারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন। তাই দেখতে গেলে, বর্তমান মায়ানমারের সরকারের পক্ষে বনিবনা করিয়ে দেওয়ার কাজটা একেবারেই সহজ নয়। কিন্তু, শর্তগুলি প্রণয়ন বই আর কোনও উপায়ও তো নেই। আবার, চাপের মুখে বাধ্য হয়ে কাজটায় হাত দিলেও হবে না। সত্যিকারের সদিচ্ছা নিয়ে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ভিত মজবুতির উদ্যোগ নিতে হবে। এই কাজে মায়ানমার সরকারের আন্তর্জাতিক সাহায্য প্রয়োজন। দরকারে সবাই মিলে মায়ানমারকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রাজি করাতে হবে।
মনে রাখতে হবে, এই পরিকল্পনাগুলি এড়িয়ে যাওয়ার পরিণাম কিন্তু ভয়ঙ্কর। এ দিকে, বাংলাদেশও নিজের সাংস্কৃতিক জলহাওয়ায় রোহিঙ্গাদের একাত্ম করার অবস্থায় নেই। ইতিমধ্যেই উদ্বাস্তু ও স্থানীয় জনতার মধ্যে সংঘাত শুরু হয়ে গিয়েছে। অন্য দিকে, আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি কখনওই চাইবে না যে বাংলাদেশ ও মায়ানমার ভিন্ন তৃতীয় কোনও দেশে এই ছিন্নমূলদের পুনর্বাসন দেওয়া হোক। কিছু সংখ্যক রোহিঙ্গা বিদেশে গিয়ে থিতু হতে পারেন। কিন্তু লক্ষ লক্ষ শেকড়-হারাকে তৃতীয় কোনও দেশে নতুন ঘর খুঁজে দেওয়া অসম্ভব।
অতএব, স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনই একমাত্র সমাধান। সেটা যাতে হয়, তার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সকলকে সচেষ্ট হতে হবে। মায়ানমার যাতে আরএসি-র প্রস্তাবগুলি কার্যকর করে, তার জন্য কূটনৈতিক ভাবে চাপ দিতে হবে। মায়ানমার ও বাংলাদেশ উভয় পক্ষেরই বন্ধু যারা, আরএসি প্রস্তাব নিয়ে তাদের ভাবতে হবে। আর কোনও রাস্তা নেই।
আরও একটি বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ জরুরি। ভিটেহারারা যাতে সসম্মানে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন, তার সহায়ক পরিস্থিতির ভিত্তিটা দৃঢ় করতে রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রতিনিধিদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দু’পক্ষের কথা শুনে মধ্যস্থতাকারীর কাজ করবেন তাঁরা। তাই যেখানে যেখানে ছিন্নমূলদের ঘর, যে যে জায়গায় ফিরে আসবেন তাঁরা, সর্বত্র রাষ্ট্রপুঞ্জের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রপুঞ্জ যাতে সুষ্ঠু ভাবে কাজ করতে পারে, তার জন্য মায়ানমারের অনুমোদন ও সহযোগিতা কিন্তু একান্ত প্রয়োজন। সরকারি চুক্তি আছে। তা সত্ত্বেও, ওই সব এলাকায় রাষ্ট্রপুঞ্জ এখনও পূর্ণ প্রবেশাধিকার পায়নি।
ভারত বা চিনের মতো যে যে দেশ মায়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত ভাগাভাগি করে, দায়িত্ব তাদেরও। যে দেশগুলি মায়ানমারের সঙ্গে কোনও আঞ্চলিক সংগঠনের সদস্য, যেমন জাপান, যেমন ‘আসিয়ান’-এর সদস্য দেশগুলি, তাদেরও মায়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক বা অন্য সম্পর্ক আছে। তাই তাদের উদ্যোগও সমান গুরুত্ববহ। হয়তো মায়ানমারের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক চুক্তির জন্য তারা বিষয়টিতে নিরুৎসাহী, নিষ্ক্রিয়, নির্বিকার। কিংবা যতটা মাথা না ঘামালে খারাপ দেখায়, ঠিক সেটুকু মেপেই কথা বলছে। তাদের বুঝতে হবে, রোহিঙ্গা বিষয়ে এই ঔদাসীন্য তাদের দেশেই ব্যুমেরাং হয়ে আঘাত হানতে পারে। রোহিঙ্গা শরণার্থীর সমস্যা একটা টিকটিক করতে থাকা টাইম বোমা। সবাই মিলে এই আগুনে জল না ঢাললে, এক দিন বিস্ফোরণের অভিঘাতে প্রত্যেকের স্বার্থ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে।
কী ভাবে? উদ্বাস্তুদের বেশির ভাগই তরুণ। এঁরা যদি ভবিষ্যতের আলোটুকুর হদিস না পান, তবে অস্থির হয়ে অন্ধকারকেই আঁকড়ে ধরবেন। শরণার্থী শিবিরগুলির সহিংস কর্মকাণ্ডে এই শেষের শুরুটা কিন্তু হয়েই গিয়েছে। বাংলাদেশের শরীর-মনে তার ছিটে লেগেছে। অন্যরাও রেহাই পাবে না। এর পর হয়তো একটু ভাল থাকার লোভে এই তরুণরা শিবির ছেড়ে বেরিয়ে পড়বেন। সে সময় চরমপন্থী শক্তি তাঁদের চেতনা গ্রাস করতেই পারে। মাদক, নারী পাচারের চক্র তাঁদের এক এক করে গহ্বরে টেনে নিয়ে যাবে তখন। তাই বিপদ অনেক রকম।
মাত্র কয়েক বছর আগেই রোহিঙ্গারা জীর্ণ পলকা নৌকা বেঁধে ভেসে পড়েছিলেন মহাসাগরে। গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া, তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ। কিন্তু ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী-বোঝাইয়ের ফলে, অনেক নৌকাই সমুদ্রে ডোবে। শত শত প্রাণ যায়। রোহিঙ্গাদের এই মর্মান্তিক পরিণতিতে আন্তর্জাতিক মহল প্রবল অস্বস্তিতে পড়ে। স্থলপথ ও আকাশপথে সৌদি আরব, পাকিস্তান ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চলে গিয়েছেন বহু শরণার্থী। ভারতেও ঢুকে এসেছেন অনেকে। নানা কারণে বাংলাদেশের শিবিরগুলিতে টিকতে না পারলে, অসহায় মানুষরা তো ভারতের দিকেই হাতটা বাড়িয়ে দেবেন। তাই রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে ভারতের উদ্যমী হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এই সমস্যাকে একা বাংলাদেশের ঝামেলা ভেবে, নিস্পৃহতা দেখালে চলবে না।
রাষ্ট্রপুঞ্জে বাংলাদেশের প্রাক্তন কর্মকর্তা, দিল্লিতে শরণার্থী হাইকমিশনারের প্রাক্তন প্রতিনিধি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy