প্রতীকী ছবি।
চার দিকে বর্ষার জল থইথই ছবিতে উত্তরবঙ্গে এখন বানভাসির আবহ। ভিন্ন ঋতুর চেনা ডুয়ার্স বর্ষায় প্রতিবার অন্য রূপে অচেনা হয়ে যায়। এমনিতেই প্রকৃতি উপুড়হস্তে আমাদের ডুয়ার্সকে অকৃপণ হাতে সাজিয়েছেন। বর্ষায় যেন তাকে নবরূপে দেখতে পাই।
ডুয়ার্স বলতে চোখের সামনে ভেসে ওঠে পাহাড় আর সবুজ সাজে অরণ্য। আর তার মধ্য দিয়ে বয়ে চলা সরু ফিতের মতো সব পাহাড়ি নদী। বর্ষায় এই চেনা বনাঞ্চল, এই চেনা নদীর আদিম রূপ আমাদের চোখে নেশা ধরিয়ে দেয়।
রাজাভাতখাওয়ার সরস আপ্যায়ন যেমন। তাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা কারও নেই। এই বর্ষায় ভরন্ত তোর্সার উথালপাতাল রূপ আর তার জলের উদ্দাম শব্দ, প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এক অমোঘ আকর্ষণ। কোচবিহার শহরের বুক চিরে প্রবাহিত অবগুন্ঠিত যে নদী, বর্ষায় সে সদ্যযৌবনে পা দেওয়া তরুণীর মতো উচ্ছল!
হাসিমারা থেকে মাদারিহাট যেতেও পথে পড়ে তোর্সা। তার সেতুর উপর দাঁড়িয়ে নীচে তাকালে অতি বড় সাহসীরও বুক কেঁপে ওঠে! হাসিমারা থেকে তোর্সা— এই পর্যন্ত যেন ডুয়ার্সের চেরাপুঞ্জি। বৃষ্টি আর বৃষ্টিতে মুহূর্তে মুহূর্তে বদলে যায় প্রকৃতি। পাহাড়ি কন্যা তখন বাঁধনহীন উতলা হয়ে ছুটে চলে দক্ষিণে।
একেবারে পূর্ব সীমান্তে, অসম রাজ্যের সীমানায় বারোবিশা থেকে সোজা উত্তরে কুমারগ্রাম ছাড়িয়ে শিল্পীর ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো চা-বাগান। তার পাশে সঙ্কোশ। বৃষ্টিভেজা চা-পাতা, পাশে বয়ে যাওয়া অস্থির সঙ্কোশ— এই নয়নাভিরাম দৃশ্যের সামনে থমকে দাঁড়ায় চোখ।
কালচিনির পথে রয়েছে ডিমা নদী। বর্ষায় প্রবল জলোচ্ছ্বাসে রাশি রাশি ফেনা নিয়ে ছুটে চলে এই নদী। তার বহতা শব্দে কম্পিত হয় যেন আস্ত পৃথিবীটাই! পাশেই আছে বসরা। পূর্ণিমারাত আর বসরার যুগলবন্দি নিশ্চিত এক অলৌকিক ক্ষণ! ডুয়ার্সের পাহাড়, জঙ্গল, নদী আর বর্ষা— এই চারের সম্মিলিত রূপ যে কোনও নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে হার মানিয়ে দেয় অনায়াসে!
ডুয়ার্সের একটি ছোট গঞ্জ শামুকতলা। তার আশপাশে রয়েছে জঙ্গল দিয়ে ঘেরা কয়েকটি বনবসতি— শিলটং, টিয়ামারি। এই বসতিগুলির বর্ষা-সৌন্দর্য নিখাদ আদিমতায় ভরা। পূর্ণবর্ষায় জঙ্গলের রাস্তায় হঠাৎ দেখা মিলতে পারে চিতল বা পেখম তোলা ময়ূরের।
কালচিনি থেকে উত্তরে এগিয়ে গেলে পাওয়া যাবে আরও কিছু বসতি— ভাটপাড়া, রায়মাটাং, চিনচুলা প্রভৃতি। রায়মাটাং বসতিকে যদি ডুয়ার্সের শিলং বলা হয়, তবে কিছুমাত্র বেশি বলা হয় না। বৃষ্টি ও প্রকৃতি যেন একে অন্যের সঙ্গে এখানে দিনরাত লুকোচুরি খেলে। এর সঙ্গে আছে ভরা যৌবনের রায়মাটাং নদী। বৃষ্টির শব্দ যে কত রকমের হতে পারে, তা জানা যায় রায়মাটাংয়ে।
পাহাড়-ঘেরা ডুয়ার্স আরও বেশি সবুজ হয়ে ওঠে এই বর্ষায়। বর্ষায় অরণ্যের রূপ যে কেমন মোহিনীশক্তিতে ভরপুর হয়ে ওঠে, তা নিজে প্রত্যক্ষ না করলে অনুমান করা অসম্ভব। ভেজা মাটি, বৃষ্টিস্নাত সবুজ গাছের পাতা, উড়ে যাওয়া পাখির ডানা ঝাপটানো! তার সঙ্গে অরণ্যের নিজস্ব কতরকম যে শব্দ!
ডুয়ার্সের বনাঞ্চলের আরেকটি বিশেষত্ব বর্ষায় প্রতিটি জঙ্গলের এক এক রকম সম্ভার আর আবেদন। বক্সার জঙ্গল যদি হয় আদিম আর বন্য, তা হলে চিলাপাতা ফরেস্ট যেন উদাসীন প্রেমিক। এই ভাবে প্রতিটি বর্ষায় পাহাড়ের সঙ্গে জঙ্গলকে নিয়ে সেজে ওঠে ডুয়ার্স।
তবে, এই দৃশ্যাবলির, এই অপার সৌন্দর্যের উল্টো দিকটাও রয়েছে! এখন সেই বিপ্রতীপ দৃশ্যই প্রবল ডুয়ার্সে! প্রবল বৃষ্টিতে বিপর্যস্ত ডুয়ার্সের পাহাড় ও সমতল। নদীগুলির ভয়ঙ্কর জলোচ্ছ্বাসে প্রতিবারই ভেসে যায় গ্রামের পর গ্রাম। ফি-বছর বন্যায় অনেক নদীর বাঁধ ভাঙা জল ঢুকে পড়ে জনবসতিতে। গৃহহীন হয়ে পড়েন বহু মানুষ। জলে ডুবে যায় কৃষিক্ষেত্র, চা-বাগান। যন্ত্রণা তখন চরমে ওঠে। খোলা আকাশের নীচে অাশ্রয়ের সন্ধানে ছুটে বেড়ায় অসহায় মানুষ আর গবাদি পশু।
সব মিলিয়ে বর্ষা আর এই সময়ে আশীর্বাদ থাকে না! বরং অভিশাপ হয়ে নেমে আসে উত্তরের জনজীবনে! শুধু গ্রামাঞ্চল নয়, শহর এলাকাতেও নিকাশি ব্যবস্থার বেহাল অবস্থায় একদিনের বৃষ্টিতে রাস্তাঘাট জলের তলায় চলে যায়! অতিবর্ষণে পাহাড়ে নেমে আসে একের পর এক ধস। যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায় পাহাড়ি পথে। বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় সড়ক যোগাযোগ। ব্যাহত হয় ডুয়ার্স-রুটের ট্রেন চলাচলও। বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল জলে ডুবে গেলে ক্ষতি হয় নিরীহ পশুদের। আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে তারা। খাদ্যাভাবে মৃত্যুও হয় তাদের।
বর্ষার এই ধ্বংসাত্মক রূপকে অস্বীকার করা যায় না। তবুও যেন প্রতিবারই এই বৃষ্টির অপেক্ষাতেই থাকে ডুয়ার্সের জঙ্গল, পাহাড়, নদী। বর্ষা আসে এবং নবরূপে সজ্জিত হয় তারা। এ এক বিচিত্র অনুভূতি! অদ্ভুত চক্র! সৌন্দর্য আর ধ্বংসের যূথবদ্ধ রূপক যেন! যে রূপক প্রতিবার স্পষ্ট হয়ে ওঠে ডুয়ার্সে!
(লেখক বাণেশ্বর জিএসএফ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy