উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ।
ফরেস্ট গাম্প ছবির শুরুর দৃশ্যে একটা সাদা পালক হাওয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছিল। সেই সাদা পালকের মতো এখন দিল্লির বাতাসে একটাই প্রশ্ন ভেসে বেড়াচ্ছে: যোগী আদিত্যনাথকে কি উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর গদি থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে?
অরবিন্দ কেজরীওয়াল লোকসভা নির্বাচনের মধ্যেই ‘ভবিষ্যদ্বাণী’ করেছিলেন— ভোটের দু’মাসের মধ্যেই উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে যোগীকে সরানো হবে। যুক্তি ছিল, আগামী বছর সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদী পঁচাত্তর বছরে পা দিলেই তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াবেন। প্রধানমন্ত্রী হবেন অমিত শাহ। শাহি-অভ্যুত্থানে আদিত্যনাথ যাতে বাধা হয়ে না দাঁড়ান, তা নিশ্চিত করতে আগেভাগেই তাঁকে ছেঁটে ফেলা হবে।
লোকসভা ভোটের ফলপ্রকাশের পরে প্রশ্ন উঠেছে, এখন যোগীকে সরাতে কি তাঁর উপরেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভরাডুবির দায় চাপানো হবে? উত্তরপ্রদেশে বিজেপিতে এখন ‘মুষলপর্ব’ চলছে। এই সে দিন পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী-যোগী আদিত্যনাথের ‘ডাবল ইঞ্জিন’-এ উত্তরপ্রদেশ ছিল বিজেপির শক্ত ঘাঁটি। লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে বিজেপির আসনসংখ্যা এক ধাক্কায় ৬২ থেকে ৩৩-এ নেমে এসেছে। বিজেপির হাত থেকে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিটকে যাওয়ার প্রধান কারণ উত্তরপ্রদেশের খারাপ ফল। তার পরেই বিজেপির অন্দরে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। লখনউ থেকে তার ঢেউ আছড়ে পড়েছে দিল্লিতেও। মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন উপমুখ্যমন্ত্রী কেশব প্রসাদ মৌর্য। বিজেপির রাজ্য কর্মসমিতির বৈঠকে তিনি আদিত্যনাথের দিকে ইঙ্গিত করে অভিযোগ তুলেছেন: সরকারের থেকে সংগঠন বড়, সংগঠনের থেকে কেউ বড় নয়।
প্রকাশ্যে যেটা বলা হচ্ছে না, তা হল, যোগীর নির্দেশে তাঁর ঘনিষ্ঠ মন্ত্রী, বিধায়করাই অন্তর্ঘাত করেছেন। উত্তরপ্রদেশে বিজেপির খারাপ ফলের কারণ খুঁজতে টাস্ক ফোর্স তৈরি হয়েছিল। তার রিপোর্টেও এই অন্তর্ঘাতের দিকে ইঙ্গিত রয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, যোগী আদিত্যনাথের গড় গোরক্ষপুরের আশেপাশের সমস্ত লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি জিতল। অথচ নরেন্দ্র মোদীর কেন্দ্র বারাণসীর আশেপাশের যাবতীয় লোকসভা কেন্দ্রে বিজেপি হেরে গেল কী ভাবে! বিজেপির গৃহযুদ্ধ এতটাই তুঙ্গে যে, ভোটের ফলের পর থেকে প্রায় এক মাস লখনউ ছেড়ে দিল্লিতেই বসেছিলেন উপমুখ্যমন্ত্রী মৌর্য। বিজেপির অন্দরমহলে যাঁর পরিচিতি মোদী-শাহের কাছের লোক হিসাবে। যাঁকে উপমুখ্যমন্ত্রী করাই হয়েছে যোগীকে লাগামের মধ্যে রাখতে। যোগীর ঘনিষ্ঠ শিবিরের পাল্টা অভিযোগ, মুখ্যমন্ত্রীকে সরানোর প্রেক্ষাপট তৈরি করতেই দলের মধ্যে এই অস্থিরতা তৈরি করা হচ্ছে।
প্রশ্ন হল, বিজেপি এখন কী করবে? নরেন্দ্র মোদীর পরে অমিত শাহের রাস্তা সাফ করতে যোগীকে লখনউয়ের তখ্ত থেকে সরিয়ে দেওয়া হবে? যাতে তিনি দিল্লির কুর্সির দাবিদার না হয়ে ওঠেন? না কি ২০২৯-এর লোকসভা ভোটের আগে ২০২৭-এ ফের উত্তরপ্রদেশের বিধানসভা ভোটে জিততে যোগীর উপরেই ভরসা করা হবে? লোকসভা ভোটে উত্তরপ্রদেশে খারাপ ফলের দায় বিজেপির রাজ্য সভাপতি ভূপেন্দ্র চৌধরির উপরে চাপিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হবে?
এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল, বিজেপির অন্দরে মুষলপর্ব কী ভাবে থামানো হবে? বলা বাহুল্য, এই গৃহযুদ্ধ শুধু খারাপ ফলের দায় ঠেলাঠেলি নিয়ে নয়। নরেন্দ্র মোদীর উত্তরসূরির দাবিদার হয়ে ওঠার লড়াইও এর মধ্যে অন্তর্নিহিত।
দীনদয়াল উপাধ্যায় মার্গে বিজেপি দফতরের যে কোনও সাধারণ কর্মীও জানেন, গত দশ বছরে যখনই বিজেপির কেউ মোদীর চ্যালেঞ্জার হয়ে উঠতে পারেন বলে মনে হয়েছে, তখনই তাঁর ডানা ছেঁটে ফেলা হয়েছে। কিন্তু যোগীর বিষয়টা আলাদা। ২০১৭ সালে বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় আসার পরে আরএসএস গোরক্ষনাথ মঠের পীঠাধীশ্বর তথা গোরক্ষপুরের সাংসদ যোগী আদিত্যনাথকে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে তুলে এনেছিল। এমন নয় যে যোগী আরএসএসের অন্দরমহলের লোক। তিনি আসলে আরএসএস বা বিজেপি, দুই সংগঠনেই বাইরে থেকে আসা ব্যক্তি। কিন্তু আরএসএসের আশীর্বাদে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার পরে যোগী উত্তরপ্রদেশে প্রবল জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। বিশেষত রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার জন্য রাজ্যের মানুষ তাঁকে কুর্নিশ জানিয়েছে। যোগীর কাঁধে ভর করেই ২০২২-এ ফের বিজেপি উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতায় ফিরেছে। খোদ নরেন্দ্র মোদী লোকসভা ভোটের প্রচারে এ জন্য যোগীর অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছেন। মোদী ও যোগী মিলে উত্তরপ্রদেশ জুড়ে ১৫টি জনসভা করেছেন। এক সঙ্গে পাঁচটি রোড-শো করেছেন তাঁরা। দু’জনে মিলে কাশী বিশ্বনাথ ধাম থেকে কালভৈরব মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদীর প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময়ও যোগী তাঁর পাশে ছিলেন। আর এই সব দৃশ্যই যোগী আদিত্যনাথকে নরেন্দ্র মোদীর ‘স্বাভাবিক উত্তরসূরি’ হিসাবে তুলে ধরেছে। যোগী নিজেও ঠিক নরেন্দ্র মোদীর মতোই, ‘গুজরাত মডেল’ নিয়ে প্রচারের ধাঁচেই সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সামনে তাঁর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে সাফল্য তুলে ধরছেন।
মুশকিল হল, নরেন্দ্র মোদী মুখে যতই কংগ্রেস-মুক্ত ভারতের কথা বলুন, কংগ্রেস নেতৃত্বের ‘বদভ্যাস’ বিজেপির মধ্যেও ঢুকে পড়েছে। কংগ্রেস হাই কম্যান্ড যেমন কোনও রাজ্যে শীর্ষ কংগ্রেস নেতাকে লাগামে রাখতে তাঁর বিপরীতে আর এক নেতাকে খাড়া করে দেয়, উত্তরপ্রদেশেও বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব যোগীকে লাগামে রাখতে দু’জন উপমুখ্যমন্ত্রী নিয়োগ করেছে। লখনউয়ের ভুলভুলাইয়ায় কান পাতলে শোনা যায়, যোগী মুখ্যমন্ত্রী হলেও উত্তরপ্রদেশের পুলিশ-প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে নিয়োগ দিল্লি থেকেই হয়। সেই কর্তাদের দিয়ে দিল্লি থেকে সমান্তরাল প্রশাসন চালানো হয়। বারাণসী শহরের উন্নয়ন প্রকল্পের যাবতীয় বরাত চলে যায় পশ্চিম ভারত (পড়ুন, গুজরাত)-এর ব্যবসায়ীদের হাতে। এমনকি লোকসভা ভোটের প্রার্থী বাছাইয়ের সময়ও বিজেপির মধ্যে এই ‘হাই কম্যান্ড সংস্কৃতি’ প্রকট হয়েছে।
কী রকম? গত ২৯ ফেব্রুয়ারি উত্তরপ্রদেশের ৮০টি লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৫০টির প্রার্থী বাছাই করতে কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছিল। যোগী-সহ বাকি নেতারা দু’ঘণ্টা বৈঠক শুরুর জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। কারণ প্রধানমন্ত্রীর লোক কল্যাণ মার্গের বাসভবনে মোদী, শাহ, নড্ডা প্রার্থী-তালিকা নিয়ে ঘরোয়া আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন। সেখানেই তালিকা চূড়ান্ত হয়ে যায়। বৈঠকে এসে সাংগঠনিক সম্পাদক বি এল সন্তোষ সেই তালিকা পড়ে দেন। বিশ মিনিটে পঞ্চাশ জন প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত হয়ে যায়। যোগী ৩৫ জন সাংসদকে বাদ দিতে বলেছিলেন। ‘ডাবল ইঞ্জিনের সরকার’-এর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর বিজেপি নেতৃত্ব তাতে কান দেননি। দেখা যায়, ২৭ জন সাংসদ ভোটে হেরেছেন।
এখন তিরের মুখে দাঁড়িয়ে যোগী এই ‘অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস’-এর দিকেই আঙুল তুলেছেন। বোঝাই যাচ্ছে, তিনি কাদের দিকে ইঙ্গিত করছেন। সেই সঙ্গে ‘হুঁশিয়ারি’ দিয়েছেন, ২০২৭-এ উত্তরপ্রদেশে বিজেপি যদি হেরে যায়, তা হলে দলের উপর থেকে নীচ পর্যন্ত সবাইকে তার খেসারত দিতে হবে। বার্তা স্পষ্ট। যোগী বোঝাতে চাইছেন, তাঁকে সরানো হলে মানুষের জনসমর্থনও বিজেপির থেকে সরে যাবে। আগামী বিধানসভা ভোটে বিজেপির পক্ষে উত্তরপ্রদেশ দখল কঠিন হয়ে উঠবে। লোকসভায় উত্তরপ্রদেশে খারাপ ফলের পরে মোদী-শাহের গদিও নড়ে উঠবে।
এই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের সামনে প্রশ্ন হল, তাঁরা কি সত্যিই যোগীকে সরানোর ঝুঁকি নিতে পারবেন? না কি যোগীকে মুখ্যমন্ত্রীর পদে রেখে দিয়ে আপাতত উত্তরপ্রদেশে বিজেপির গৃহযুদ্ধ ধামাচাপা দেওয়াকেই তাঁরা অগ্রাধিকার দেবেন?
বাস্তব হল, নরেন্দ্র মোদীর ঝুলিতে এত দিন বিজেপির যাবতীয় সাফল্যের কৃতিত্ব গিয়েছে। তিনি গুজরাত ছেড়ে বারাণসীতে প্রার্থী হয়েছেন বলেই উত্তরপ্রদেশে বিজেপি ফুলে-ফেঁপে উঠেছে বলেও দাবি করা হয়েছে। আর সব রাজ্যের মতো উত্তরপ্রদেশের বিজেপির প্রার্থী-তালিকাও তৈরি হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। অযোধ্যা থেকে বারাণসীর উন্নয়নের কাজ প্রধানমন্ত্রীর দফতরই নিয়ন্ত্রণ করেছে। এখন বারাণসীতে নরেন্দ্র মোদীর জয়ের ব্যবধান কমে যাওয়া ও অযোধ্যায় বিজেপির হারের দায় কী ভাবে যোগী আদিত্যনাথের উপরে চাপানো সম্ভব?
শেষ প্রশ্ন হল, আরএসএস এ ক্ষেত্রে কী ভূমিকা নেবে? গত দশ বছরে সরকার থেকে সংগঠনের যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ প্রধানমন্ত্রীর দফতরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। নাগপুরে আরএসএসের সদর দফতরেও ক্ষোভ জমেছে। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মতামত উপেক্ষা করে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতই যোগী আদিত্যনাথকে লখনউয়ের গদিতে বসিয়েছিলেন। মোদীর উত্তরসূরি কে হবেন, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও আরএসএস নিজের হাতে রাখতে চাইবে।পারবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy