ঠান্ডা যুদ্ধ কালের নামজাদা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্যামুয়েল পি হান্টিংটন ১৯৯৩ সালে তাঁর যে তত্ত্ব দিয়ে বিশ্বের নীতি নির্ধারক মহলে আলোচনা এবং সমালোচনার ঝড় বইয়ে দিয়েছিলেন তা হল ‘ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজ়েশন্স’ বা ‘সভ্যতার সংঘাত’। ‘সিভিলাইজ়েশন’ ও ‘সভ্যতা’ যে একই অর্থের প্রতিরূপ নয়, সে কথা রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনসায়াহ্নের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘সভ্যতার সঙ্কট’-এ উল্লেখ করেছেন। তবে তার অর্ধ দশক পরে বিতর্কের কেন্দ্র সরে গিয়েছিল অনেক দূর। ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান থেকে ১৯৯১ সালে ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ দ্বৈরথের অন্যতম মহারথী সোভিয়েট ইউনিয়নের পতন। এক দল পণ্ডিত বলছিলেন মার্ক্সবাদী ‘মহা’ শক্তির অবসানের সঙ্গেই হল ‘ইতিহাসের শেষ’। কিন্তু হান্টিংটন বললেন এর পরও লড়াই চলবে, তবে তা আদর্শবাদ-ভিত্তিক না হয়ে হবে ‘সভ্যতা-ভিত্তিক’।
হান্টিংটনের সীমারেখায়নের মূলে রয়েছে ধর্ম এবং সংস্কৃতি। পাশ্চাত্য সভ্যতার সীমা উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপ। সভ্যতার বিচারে রাশিয়া ‘অর্থোডক্স’, চিন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অধিকাংশ দেশ ‘সিনিক’, জাপান ‘জ্যাপনিক’, আরব ও ইরান থেকে শুরু করে দক্ষিণ এশিয়া ও মালয় উপদ্বীপ পর্যন্ত ‘ইসলামিক’, এবং ভারত ‘হিন্দু’। প্রথমে একটি প্রভাবশালী সাময়িকীতে প্রকাশিত প্রবন্ধ হিসাবে, ও পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়ে, হান্টিংটন-তত্ত্বই এক সময়ে ধরে নেওয়া হয় পাশ্চাত্য সভ্যতার সঙ্গে ইসলামের সংঘাতের প্রধান তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা হিসাবে।
সেই ব্যাখ্যা ভুল কি ঠিক, তা এখানে বিচার্য নয়। বরং যা লক্ষণীয়, তা হল বর্তমান অস্থির বিশ্ব পরিস্থিতিতে হান্টিংটন-তত্ত্বের জমকালো পুনঃপ্রবেশ। হান্টিংটন বলেন, এক সভ্যতার সঙ্গে অপর সভ্যতার সংঘাতে চেষ্টা চলবে অন্য জোটের সহায়তা অর্জনের। তাঁর আর এক মত, রাশিয়া ও ভারত হল ‘দোদুল্যমান শক্তি’ (সুইং স্টেট), যারা অবস্থানানুযায়ী সঙ্গী পরিবর্তন করতে পারে।
এ সবই দুই দশক পুরনো ভাবনা, কিন্তু পরিষ্কার বোঝা যায় যে, সোভিয়েট ইউনিয়ন অবসানের পর রাশিয়া ইউরোপ/উত্তর আমেরিকার ‘পাশ্চাত্য’ রীতিপদ্ধতির সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে চায়নি। না পশ্চিমি দুনিয়া মেনে নিতে সম্মত ছিল যে, ভ্লাদিমির পুতিনের জ়ারতান্ত্রিক মনোভাব (যা অর্থোডক্স মূল্যবোধের পক্ষে অসঙ্গত নয়)। পুতিনের সঙ্গে যে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমি জোটের সংমিশ্রণ সম্ভব নয়, তা দিবালোকের মতো স্বচ্ছ হল যখন দেখা গেল সোভিয়েট-উত্তর রাশিয়া পারমাণবিক অস্ত্রের উপর ঘোরতর নির্ভরশীল রয়েই গেছে। ঠিক যেমন আমেরিকা নিজে। বর্তমানে এই দুই মহারথীর মধ্যে যে পারমাণবিক অস্ত্র সংবরণ যুক্তি বলবৎ, তার অনুসারে উভয়েই পারে ১,৫৫০টি ক্ষেপণাস্ত্র মজুত রাখতে। বলা বাহুল্য, আমাদের একমাত্র বাসস্থান এই পৃথিবীতে জীবন নিশ্চিহ্ন করে দিতে উপরোক্ত অস্ত্রভান্ডারের এক ছোট অংশই যথেষ্ট।
এই সর্বক্ষয়ী যুদ্ধ ভয় থেকেই পশ্চিমি জোট রাশিয়ার পশ্চিম ও দক্ষিণে সাজিয়ে রেখেছে নেটো (নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজ়েশন) চুক্তিভুক্ত দেশের অস্ত্রসম্ভার। অপর দিকে তার জন্য রাশিয়ার অস্বস্তি স্বাভাবিক। কিন্তু গণতান্ত্রিক বৃত্তের বাইরের দেশগুলি সচরাচর দেশের সুরক্ষা বিপন্ন মনে হলে আলোচনা বা কূটনীতির মাধ্যমে সেই সমস্যার সমাধান খোঁজে না। বরং ঝুঁকে পড়ে স্বৈরাচারের দিকে। পুতিন তা-ই করেছেন। তাঁর নির্বাচন নিছক ভোট-ডাকাতি। তাঁর রাশিয়ায় বিরোধী নেতারা আকছার প্রাণ হারান বিষপ্রয়োগ দ্বারা। তিনি নিজে সংবিধান পাল্টিয়ে নিজেকে প্রায় পাকাপাকি রাশিয়ান প্রেসিডেন্টে পরিণত করেছেন। জোসেফ স্তালিনের ৩০ বছর ১১ মাসের কর্তৃত্বের রেকর্ড ভাঙতে পারেন পুতিন।
২০০৮ সালে রোমানিয়ার বুখারেস্টে নেটো-র তরফ থেকে ঘোষণা করা হয় যে, পুতিনের দোরগোড়ায় দু’টি রাজ্যে তারা তাদের সদস্যপদ প্রসারিত করতে চলেছে, জর্জিয়া এবং ইউক্রেন। মুহূর্তের মধ্যে পুতিন তুলকালাম বাঁধালেন জর্জিয়ায়, যার ফলে সেই দেশ নেটো-তে যোগদান করবে এমন কথা আর শোনা যায়নি। ইউক্রেনে কিন্তু গড়ে উঠছিল যথার্থ গণ-আন্দোলন, যার জেরে ২০১৩ সালে বিদায় নিতে হল পুতিন-অনুগৃহীত প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকভিচ-কে। তার পর জ়েলেনস্কি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে পুতিন নিশ্চয় আঁচ করলেন কিছু না করলে এ বার দেশটি চলে যাবে তাঁর প্রভাববলয়ের বাইরে। ইতিমধ্যেই শেনগেন ভিসা না নিয়েই সারা ইউরোপ ঘুরবার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল ইউক্রেনীয়দের। উপস্থিতি বাড়ছিল আমেরিকান ব্যাঙ্ক ও আর্থিক সংস্থার। তা ছাড়া জ়েলেনস্কি আগ্রহী ছিলেন নেটোর সদস্যপদ নিয়ে। পুতিনের চোখে নিশ্চয়ই খুব দ্রুত হিরোর ভূমিকায় দেখা যাচ্ছিল চল্লিশের কোঠায় এই বুদ্ধিমান কৌতুকশিল্পীটিকে। অনিবার্য হয়ে পড়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযান।
ভারতকে ‘সুইং’ সভ্যতা বললেও হান্টিংটন কিন্তু কার্যকারণ তেমন বিশ্লেষণ করেননি। তবে তাঁর সিদ্ধান্তটি ছিল ঠিক। ভারতের প্রথন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ছিলেন পাশ্চাত্যপ্রেমী মানুষ, যেমন ছিলেন সংবিধানের রূপকার ভীমরাও অাম্বেডকর। তবে স্বাধীন ভারতকে পশ্চিমি সভ্যতার বলয়ে আনা অসম্ভব ছিল ঠান্ডা যুদ্ধের কারণে। জন্ম থেকেই ভারত ও পাকিস্তান রয়ে যায় শত্রু। তার পর চিনের অগ্রগতির সঙ্গে চিন হয়ে পড়ে আমেরিকার নতুন প্রেম। এ-হেন চিনের সঙ্গে পাকিস্তানের দোস্তি জমে উঠছে দেখে পশ্চিমি জোটের জ্যাঠামশাই আমেরিকা ভারতকে আর পাত্তা না দিয়ে উঠেপড়ে লাগে পাকিস্তানের নেতাদের ‘কাল্টিভেট’ করতে। গণতান্ত্রিক না হয়ে তারা যদি হয় ঘুষখোর সেনাপ্রধান তো বয়েই গেল! পরিণামে হান্টিংটন-কথিত ভারতের ‘হিন্দু সভ্যতা’ জোট বাঁধে মস্কোর ‘অর্থোডক্স’ সভ্যতার সঙ্গে। ‘ইসলামিক’ পাকিস্তান কিন্তু এই ‘হিন্দু’ ও ‘অর্থোডক্স’ দ্বিমুখী আক্রমণ থেকে নিজের ভৌগোলিক অখণ্ডতা বাঁচাতে ‘সিনিক’ ও ‘পশ্চিমি’— কারও প্রত্যক্ষ সাহায্য পায়নি।
কিন্তু ঠান্ডা যুদ্ধের অবসানের সঙ্গে সঙ্গে বদল হল চিত্রনাট্যের। ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ১৯৯১ সালের সংস্কারের পর যখন গতি অর্জন করল, তখন প্রয়োজন হল উন্নত প্রযুক্তির, যা আমেরিকার সাহায্য বিনা সম্ভব নয়। এই সহস্রাব্দের ঠিক শুরুতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে মনমোহন সিংহ বুঝেছিলেন, এ বার ‘অর্থোডক্স’ শিবির ত্যাগ করে ঝাঁপ দিতে হবে পশ্চিমি, অর্থাৎ আমেরিকা শিবিরে। সেটি ছিল মনমোহনের ‘লিপ অব ফেথ’, বিশ্বাসের লাফ। ১৮ জুলাই ২০০৫ তাঁর সঙ্গে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বুশের ‘১২৩ চুক্তি’ (বেসামরিক পারমাণবিক শক্তি-সংক্রান্ত চুক্তি) সই হওয়া এক অর্থে যুগক্রান্তি। সেই প্রথম ভারত গৃহীত হল পশ্চিমি শক্তির নজরদারির অধীন উচ্চপ্রযুক্তির বলয়ে। বিনিময়ে ভারত রাজি হল তার অসামরিক পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্রগুলি আন্তর্জাতিক যাচাই-এর জন্য খুলে দিতে।
শুধু পারমাণবিক বিজ্ঞানই নয়, আমেরিকার দরজা এর পর অবারিত হয়ে গেল ভারতের জন্য। ভারতীয়দের জন্যও। গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাডবি, আইবিএম, টুইটার— এত সব প্রযুক্তি-নির্ভর আমেরিকান ব্যবসা যারা মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে প্রভাবিত করে, তাদের মুখ্য কার্যনির্বাহকরা সকলে ভারতীয়। এর কারণ অবশ্যই ভারতীয়দের যোগ্যতা; কিন্তু ‘১২৩ চুক্তি’র জাদুমন্ত্রটি ঠিক সময়ে মনমোহন ও বুশ উচ্চারণ না করলে আমেরিকার দুয়ার খুলত কি না, তা সন্দেহজনক।
ভারত, যাকে হান্টিংটন বলেছেন দোলায়মান ‘হিন্দু’ সভ্যতা— সে কি তবে ২০০৪-১৪ ইউপিএ-সরকারের জমানায় ‘অর্থোডক্স’ জোট ছেড়ে পশ্চিমি জোটের দিকে পা বাড়িয়েছিল? নিশ্চয়ই তাই। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ২০১৪ সালে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর দেখা দিল দিশা নিয়ে নতুন ভাবনা। যত দিন ওয়াশিংটন-এ ক্ষমতায় ছিলেন ট্রাম্প— যিনি নিজে পশ্চিমি সভ্যতার কেন্দ্রীয় শক্তি, গণতন্ত্রের সম্পর্কে নিরাসক্ত— তত দিন কোনও গন্ডগোল হয়নি, কারণ মোদী নিজেও তত গণতন্ত্রপ্রেমী নন। কিন্তু ট্রাম্প গেলেন হেরে। শুরু হল ভারতের সমস্যা। ঠান্ডা যুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিমি বৃত্ত আশা করে তার অনুগামীদের মূল্যবোধ সম্মান দেবে মানবাধিকারকে। অন্তত ‘রাশিয়া থেকে অস্ত্র কিনি’, এই ছুতোয় বিশ্বসংস্থায় রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা না করে পালিয়ে আসবে না।
ঠিক এই কারণেই পশ্চিমি শক্তি ভারতকে নিয়ে বিব্রত। তাদের নেতারা চেষ্টা করছেন ভারতকে বুঝতে ও বোঝাতে। ‘অর্থোডক্স’ শিবির আর মোটেই ভারতের পক্ষে উপযোগী নয়, কারণ ১৯৯১-এর পর শক্তি হারিয়ে তা হয়ে পড়েছে একান্ত ভাবে চৈনিক শিবিরের উপর নির্ভরশীল। এবং চিন-রাশিয়া জোটে চিনই রইবে বড় তরফ।
ভারতের অবস্থা তাই কিংকর্তব্যবিমূঢ়! সোজা রাস্তাটি পশ্চিমমুখী। কিন্তু সেখানে যে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো সব নাকাবন্দি!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy