Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৪
Women Empowerment

নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখা চাই

মেয়েদের প্রতি প্রথম অবিচারের শুরু অধিকাংশ বাবা-মায়ের হাতে। পণসামগ্রীর উপর মেয়েটির কোনও হক থাকবে না জেনেও পণের দাবি তাঁরা মেনে নেন।

আফরোজা খাতুন
শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২১ ০৫:৪১
Share: Save:

বিয়ে হলেই নাকি মেয়েদের জীবনের চাকা বসে যায় লাইনের উপর, আর তার পর গড়গড়িয়ে চলতে থাকে। এমনই শুনেছিলেন লিপিকা, তাই উচ্চমাধ্যমিক পাশের পরে বিয়েতে অমত করেননি। মদ্যপ স্বামীর যৌন নির্যাতন, পণের চাপ, অন্য নারীর সঙ্গে সম্পর্ক যখন জীবনকে বেলাইন করে দিল, তখন শুনলেন, সব নাকি ঠিক হয়ে যাবে সন্তান হলেই। এখন লিপিকার দু’টি সন্তান। অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়েছেন স্বামী; মায়ের নির্যাতন দেখে দু’টি শিশু ট্রমা-আক্রান্ত। নিজের উপার্জন নেই, আশ্রয় নেই, তাই স্বামীর বিরুদ্ধে থানায় যাওয়ার উপায়ও নেই। শুধু কেউ যদি স্বামীকে বুঝিয়ে শারীরিক অত্যাচার বন্ধ করতে পারে, এটুকুই চান লিপিকা।

লিপিকা যে পাঠ পেয়েছিলেন মেয়েদের জীবনসত্যের, তা সয়ে যাওয়া, সইয়ে নেওয়ার পাঠ। পরিবার, পাড়া-পড়শি চিরকাল এই পাঠই পড়িয়ে এসেছে মেয়েদের। যে পাঠের শিকড় রয়েছে ‘কন্যাদায়’-এর মানসিকতায়, আর যার লক্ষ্য ‘কন্যাদান’-এর অপমানজনক প্রস্তুতি। এই প্রস্তুতির মূল শর্ত, বিয়ে বাবদ অর্থ সঞ্চয়। জীবনবিমার এজেন্ট এক বার ছেলের উচ্চশিক্ষা আর মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমানোর দুটো পলিসির খবর নিয়ে হাজির হয়েছিলেন। ছেলের বিয়ে আর মেয়ের পড়ার জন্য পলিসি চাই শুনে বড্ড বিস্মিত হয়েছিলেন। আমরাও বিস্মিত হই উচ্চমাধ্যমিক-পাশ মেয়ের বিয়ের জন্য রাজ্য সরকারের প্রকল্প ‘রূপশ্রী’ টাকা দেয় শুনে। সরকারি অর্থে মেয়ের বিয়ে দেওয়ার সুযোগ বহু অভিভাবক কাজে লাগাচ্ছেন। আর তাতে শিক্ষাবিচ্ছিন্ন হবে সেই মেয়েরা।

কেন? কারণ আর্থিক ভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের মেয়েরা কন্যাশ্রীর টাকায় উচ্চশিক্ষা নিতে পারে। কিন্তু ‘রূপশ্রী’ প্রকল্পের টাকায় মেয়ের বিয়ে দিলে সে পথ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ, বিবাহিত মেয়েকে কন্যাশ্রীর টাকা দেওয়া হয় না। এ কি মেয়ের পাঠ-পর্ব চুকিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা নয়? ‘রূপশ্রী’ নামের মধ্যেও রয়েছে লিঙ্গভিত্তিক অসমতার ইঙ্গিত। মেয়ে বলে তার ‘শ্রী’ কর্মে নয়, রূপে। প্রথমে বাবা বিয়ে স্থির করবেন, পরে স্বামী-শ্বশুরবাড়ি নির্ধারণ করবে যে, মেয়েটি পড়াশোনা করবে, না কি গৃহকর্ম। এমন ভাবে পরনির্ভরশীলতার পাঠ মেয়েদের মজ্জায় গেঁথে দেওয়া হয়। ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি, ভিন্ন বোধ নিয়ে গড়ে ওঠে ছেলে ও মেয়েরা। আর্থিক ভাবে স্বনির্ভর হলে তবে বিয়ে করা উচিত, এই বক্তব্য ছেলেদের জন্য। আগে অর্থনৈতিক ভাবে স্বনির্ভরতা, পরে বিয়ে, এই ভাবনা সমাজ মেয়েদের ক্ষেত্রে ভাবতে পারে না। তাই লিপিকার মতো মেয়েরা বিপন্ন হন।

সমাজ দাবি করে ছেলেদের বলিষ্ঠতা, সাহসিকতা, দায়িত্বশীলতা। তাদের মর্যাদা নিজের রপ্ত করা শিক্ষা ও উপার্জনে। আর মনে করা হয়, মেয়েদের সামাজিক মর্যাদা তার স্বামীর ডিগ্রি, অর্থনৈতিক প্রতিপত্তি এবং চাকরির পদের উপর নির্ভরশীল। মেয়েরা প্রশংসিত হয় স্বামীর অনুগত থাকার জন্য, নীরবতা ও ধৈর্যশীলতার পরিচয় দিলে। প্রত্যাশায় এই বৈষম্যও আসলে লিঙ্গবৈষম্য।

কলেজে পড়তে আসা মেয়ের সংখ্যা বেড়েছে ঠিকই। কিন্তু কলেজে থাকাকালীনই মেয়েদের বিয়েও হচ্ছে। “পড়া শেষ হওয়ার আগে কেন বিয়ে করলে?”— এই প্রশ্নের মোটামুটি একই উত্তর পেয়েছি। শ্বশুরবাড়ি লেখাপড়ার অনুমতি দিয়েছে, তাই বিয়েতে আপত্তি হয়নি। সেই অনুমতিটুকুই ওই মেয়েদের কাছে বড় স্বাধীনতা প্রাপ্তি। তাদের বিশ্বাস ছিল, পড়ার গতি বিয়ের আগের মতোই চলবে। কিন্তু বহু মনোযোগী ছাত্রী বিয়ের পর নিয়মিত ক্লাস করতে পারেনি, পরীক্ষার ফল খারাপ করেছে। কেউ বা পড়া আর চালিয়ে যেতেই পারেনি। এর মধ্যে কেউ ভাল ফল করে উচ্চশিক্ষা নিয়েছে ঠিকই, তবে সেটা ব্যতিক্রম। বিবাহিত জীবনের বাড়তি সমস্যার ব্যাঘাতে ছাত্রীজীবন বিচ্ছিন্ন হতে পারে, এই চেতনা তৈরির অনুকূল সামাজিক পরিবেশ তারা পায় না।

মেয়েদের প্রতি প্রথম অবিচারের শুরু অধিকাংশ বাবা-মায়ের হাতে। পণসামগ্রীর উপর মেয়েটির কোনও হক থাকবে না জেনেও পণের দাবি তাঁরা মেনে নেন। অনেকে প্রচুর উপঢৌকন পাঠিয়ে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের গুরুত্ব বাড়ানোর চেষ্টা করেন। বিয়ে বাবদ এত অর্থ হস্তান্তরিত হওয়ার জন্য সেই মেয়েকে পৈতৃক সম্পত্তি নামমাত্র দেন, বা কিছুই দেন না। অর্থাৎ, মেয়েকে নিঃস্ব করা হচ্ছে বিয়ে নামক এক ব্যবস্থাপনাকে কেন্দ্র করে। এর পর যদি মেয়েটি দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চায়, তখন কি সম্পদ ফেরত পাওয়া খুব সহজ হয়? যে মেয়েকে উপার্জন করতে উদ্বুদ্ধ করা হয় না, যে মেয়ের পৈতৃক সম্পত্তির ভাগ বিয়ের নামে শ্বশুর বা স্বামীর হাতে তুলে দেওয়া হয়, বাবার বসত ভিটেতেও ছেলের অধিকারই মান্যতা পায়, সেই মেয়ের নিরাপত্তা কোথায়?

লিপিকারা এই চরম অব্যবস্থার শিকার। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) ‘স্ত্রীজাতির অবনতি’ প্রবন্ধে লিখেছেন, “আমরা যদি রাজকীয় কার্য্যক্ষেত্রে প্রবেশ করিতে না পারি, তবে কৃষিক্ষেত্রে প্রবেশ করিব। ভারতে বর দুর্লভ হইয়াছে বলিয়া কন্যাদায়ে কাঁদিয়া মরি কেন? কন্যাগুলিকে সুশিক্ষিতা করিয়া কার্য্যক্ষেত্রে ছাড়িয়া দাও, নিজের অন্নবস্ত্র উপার্জ্জন করুক।” রোকেয়ার এই বাণী প্রতিটি মেয়ের মর্মে প্রবেশ করুক।

বাংলা বিভাগ, সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন

অন্য বিষয়গুলি:

Women Empowerment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy